
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। এরপর ক্ষমতার পালাবদলে পরিবর্তন হতে দেখা গেছে অনেক কিছু। দেশের বিভিন্ন সেক্টরের মতো বিনোদন জগৎও এ নিয়ে অস্থির সময় পার করছে।
প্রকাশ্য রাজনৈতিক পরিচয় ও আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা থাকায় অনেক শিল্পী পড়েছেন সংকটে। বিশেষ করে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার গণহত্যায় সমর্থন দিয়েছেন, আন্দোলন চলাকালীন ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, তারাই আজ বিপাকে। যদিও এদের কেউ কেউ ভোল পালটে বর্তমান স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছেন, তবু বড় অঙ্কের শিল্পী কিন্তু আড়ালে। কেউ কেউ হয়েছেন গ্রেফতার। মিডিয়ার ইতিহাসে শিল্পীদের এ করুণ দশা এর আগে আর ঘটেনি।
কারণ, শিল্পীদের রাজনীতি চর্চা করাটা নতুন নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এমন চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু আওয়ামী ঘনিষ্ঠ শিল্পীরা লেজুড়বৃত্তি রাজনীতিতে এতটাই বুঁদ ছিলেন যে, ভুলে গিয়েছিলেন শিল্পের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ। দলকানা হিসাবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার লোভে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে আজ অনেককেই। আজ এদের অনেকের হাতেই নেই কোনো কাজ। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও নেই সরব উপস্থিতি। প্রকাশ্য রাজনীতি চর্চার কারণে এদের অনেকেই হচ্ছেন হামলা-মামলার শিকার, আবার কেউ হচ্ছেন নিন্দিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতার রাজনীতি। জনকল্যাণের রাজনীতি খুব কমই হয়েছে। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যারা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকেন, তারা ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নিগৃহের শিকার হন।’
সম্প্রতি প্রায় দুই ডজনের বেশি শিল্পীর নামে হয়েছে মামলা, আবার অনেকেই গ্রেফতার হয়ে রয়েছেন কারাগারে। এসব শিল্পীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগ গৃহীত হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আসাদুজ্জামান নূর, মামুনুর রশীদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, মমতাজ বেগম, চঞ্চল চৌধুরী, ফেরদৌস, অরুণা বিশ্বাস, শামীমা তুষ্টি, মেহের আফরোজ শাওন, নুসরাত ফারিয়া, চিত্রনায়ক রিয়াজ, জায়েদ খান, অপু বিশ্বাস, আশনা হাবিব ভাবনা, আজিজুল হাকিম, নিপুণ, শমী কায়সার, সাজু খাদেম, জ্যোতিকা জ্যোতি, সোহানা সাবা, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, তানভীন সুইটি, জাকিয়া মুন, সাইমন সাদিক, রোকেয়া প্রাচী, তারিন জাহান, সিদ্দিকুর রহমানসহ অনেকেই। এদিকে জনগণের রোষানলে পড়ে হামলার শিকার হয়েছেন এমন কয়েকজন শিল্পীও রয়েছেন।
বিষয়গুলো নিয়ে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে শিল্পীর ওপর হামলা বলে প্রতিবাদও জানাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনরা বলছেন, ‘যেসব শিল্পীর ওপর হামলা হয়েছে, সেটাকে ‘শিল্পীর ওপর হামলা’ না বলে তিনি যে দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেই দলের কর্মী বা নেতানেত্রী উল্লেখ করা উচিত।’
এদিকে অনেকেই বলছেন, সমাজের আয়না হচ্ছেন শিল্পীরা। কিন্তু তারা যখন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠেন, তখন সেই আয়নায় দাগ পড়ে। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে বহু নামকরা শিল্পী রাজনৈতিক মামলায় জড়িয়েছেন। কেউ সরকারবিরোধী মন্তব্য করে বিপাকে পড়েছেন, কেউ আবার দলীয় কোন্দলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ পরিস্থিতি তাদের ক্যারিয়ার এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শিল্পীদেরও উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেছেন নেটিজেনদের অনেকে। তাদের মতে, নির্দিষ্ট কোনো দলের হয়ে কাজ করা, রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়ানো কোনো শিল্পী নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। তবে শিল্পীদের রাজনৈতিক দর্শন থাকাটা দোষের কিছু নয়ও বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম গণমাধ্যমে বলেন, ‘সক্রিয় রাজনীতি শিল্পীদের কাজ নয়। শিল্পী হবেন সার্বজনীন। তিনি তার শিল্পকর্মটা ঠিকমতো করবেন। এটাও ঠিক, মানুষ যখন কোনো রাষ্ট্রে বসবাস করেন, তিনি নিরপেক্ষ হতে পারেন না। কোনো না কোনো পক্ষের প্রতি তার সমর্থন থাকেই। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যেন অন্ধের মতো না হয়।’
এদিকে রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও অনেক শিল্পী ব্যক্তিগত ইস্যু ঘিরেও মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়েছেন। যা কমিয়ে দিচ্ছে কাজের গতি। ছিটকে পড়ছেন মিডিয়া থেকে। এভাবেই রাজনৈতিক চাপ, সামাজিক হয়রানি এবং ব্যক্তিগত দুর্ভোগ মিলে মিডিয়া থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন অনেক প্রতিভাবান শিল্পী। তাতে করে নাটক কিংবা সিনেমায় এখন দেখা দিচ্ছে শিল্পী সংকট। এভাবে চলতে থাকলে দেশীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গন তারকাশূন্য হয়ে পড়বে। তাই শিল্পীদের শিল্পকর্মেই বেশি মনোনিবেশ করাটাও জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।