
হঠাৎ দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় মামলা হতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি এরকম তিনটি মামলায় ২৭ জন অভিনেতা ও অভিনেত্রীকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার বাদী সরাসরি বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা মনে করেন, এ শিল্পীরা সরাসরি অপরাধে জড়িত না থাকলেও তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক ও অর্থের জোগানদাতা। সেজন্য তাদের আসামি করা হয়েছে। যদিও আইনজীবীরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও ডকুমেন্টস ছাড়া কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে সেটি আইনের অপব্যবহার হবে। এটি সমাজে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
জানা গেছে, গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর ভাটারা থানাধীন এনামুল হত্যাচেষ্টা মামলায় ১৭ শিল্পীকে আসামি করা হয়। ২০ এপ্রিল অভিনেতা ইরেশ জাকেরকে মাহফুজ আলম শ্রাবণ হত্যা মামলায় ১৫৭ নাম্বার এজাহারনামীয় আসামি করা হয়। ৩০ এপ্রিল ১৪ জন শিল্পীর বিরুদ্ধে আদালতে দায়ের করা সাইফুদ্দিন মো. এমদাদ হত্যাচেষ্টা মামলাকে আদালত আমলে নিয়ে শাহবাগ থানাকে এজাহার গ্রহণের নির্দেশ দেন।
এছাড়া, গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে অভিনেত্রী শমী কায়সারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরের দিন উত্তরা পূর্ব থানার ইশতিয়াক মাহমুদ হত্যাচেষ্টা মামলার সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে তাকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। পরের দিন তার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। পরে আরও কয়েকটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
গত মাসের ২৯ তারিখে অভিনেতা সিদ্দিককে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে মারধর করে পুলিশে ধরিয়ে দেয় বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। পরের দিন গুলশান থানার ভ্যানচালক জব্বার আলী হাওলাদার হত্যাচেষ্টার মামলার সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শুনানি শেষে 'তারেক রহমানকে গালি দিছোস কেন' এই অভিযোগ তুলে তার সঙ্গে মারমুখী আচরণ করা হয়।
মামলাগুলো করছেন কারা?
১৭ এপ্রিল ভাটারা থানার ১৭ জন শিল্পীসহ হত্যাচেষ্টা মামলায় ২৮৩ জনকে আসামি করা হয়। ২০৭ থেকে ২২২ ও ২২৪ নাম্বারে এজাহারনামীয় হিসেবে শিল্পীদের নাম রয়েছে। মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী এনামুল হক। তিনি একজন ব্যবসায়ী ও ছাত্রদলের নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ১০ থেকে ২৮৩ নাম্বার এজাহারনামীয় আসামিদের গুলিতে বাদী আহত হয়েছেন।
মামলার এজাহার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিল্পীরা স্পটে না থাকলেও তারা আওয়ামী লীগের অর্থের জোগানদাতা ছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের অর্থের জোগানদাতা, এটার কোনও প্রমাণ আছে? জবাবে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সবাই জানে, তারা আওয়ামী লীগের অর্থের জোগানদাতা। তারা আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করেছে। তাদের পক্ষে বিভিন্ন স্থানে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। সেজন্য তারাও অপরাধী। তবে তদন্ত কর্মকর্তা যদি এ মামলার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা না পায় তাহলে তাদের নাম বাদ দিতে পারবে।
১৪ শিল্পীসহ ২০১ জন এজাহারনামীয় আসামি করে আদালতে মামলা হয়। পরে গত ৩০ এপ্রিল আদালত রাজধানীর শাহবাগ থানাকে এজাহার গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার বাদী এম এ হাশেম রাজু নিজেকে বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। মামলায় এজাহারে পরিচয় হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ফ্যাসিবাদ উৎখাত কমিটির প্রধান সমন্বয়ক, ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পরিষদের সাবেক সদস্য, জিয়া শিশু ও কিশোর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন চ্যাপ্টার বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট।
বাদী অভিযোগে উল্লেখ করেন, ১৩৫ হতে ১৪৭নং আসামিরা আওয়ামী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের যোদ্ধা। তারা অনলাইন-অফলাইনে, ফেসবুক, টুইটার, সামাজিক মাধ্যম ও হোয়াটস অ্যাপে আলো আসবেই গ্রুপে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর হত্যা-নির্যাতন গ্লোরিফাই করতে বিষোদ্গার ছড়ায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর সর্বস্তরের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা উদ্বুদ্ধ হয়ে হামলা করে। সেখানে ১৩৭নং আসামি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গরম পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য বলে। ওই গ্রুপের বাকি সদস্যরা তা বাস্তবায়ন করিতে অনুসমর্থন জানায়। ১৪৫নং আসামি থেকে বাকি সদস্যরা মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়নে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর এবং মামলার বাদী এবং ভিকটিমের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অভিনেতা ইরেশ জাকেরকে আসামি করা হত্যা মামলার বাদী ও নিহতের বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী একজন বিএনপি কর্মী। তিনি ৪০৭ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে আদালতে মামলা করেন। পরে আদালত গত ২০ এপ্রিল মামলাটি মিরপুর থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। এ মামলায় এজাহারনামীয় ১৫৭ নাম্বার আসামি ইরেশ জাকের। মামলায় ১৫০ থেকে ২১১ নাম্বার এজাহারনামীয় আসামিদের বিরুদ্ধে তিনি এজাহারে উল্লেখ করেন, আসামিরা অধিকাংশই ইচ্ছেমতো ব্যাংকের টাকা লোপাট করে। তারা সকলেই অবৈধভাবে উপার্জিত নিজেদের ও শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের বিপুল পরিমাণের অর্থ বিদেশে পাচারের সঙ্গে জড়িত। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা, ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখা ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা প্রদানের জন্য তারা অবৈধ অর্থের জোগানদাতা ও অর্থপাচারে সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন তারা স্বৈরশাসকের চিহ্নিত অর্থ জোগানদাতাদের মাধ্যমে অর্থের জোগান দিয়ে আন্দোলন নস্যাৎ করার পক্ষে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আমার নিরীহ ছোট ভাইকে হত্যা করাসহ দেশব্যাপী সংঘটিত গণহত্যার ইন্ধনদাতা হিসেবে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২৭ অভিনেতা ও অভিনেত্রী হলেন— নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, নিপুন আক্তার, কামরুন নাহার শাহনূর, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সোহানা সাবা, তানভীন সুইটি, মেহের আফরোজ শাওন, জাকিয়া মুন, জ্যোতিকা জ্যোতি, সুবর্ণা মুস্তফা, আসনা হাবিব ভাবনা, রোকেয়া প্রাচী, তারিন জাহান, অরুণা বিশ্বাস, শামীমা তুষ্টি, শমী কায়সার, সাজু খাদেম, সোহানা সাবা, জায়েদ খান, ফেরদৌস, রিয়াজ, চঞ্চল চৌধুরী, আজিজুল হাকিম, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান, ইরেশ জাকের।
এ তিন মামলার মধ্য ২ মামলার আসামি হিসেবে নাম রয়েছে রোকেয়া প্রাচী, মেহের আফরোজ শাওন, জায়েদ খান, আসনা হাবিব ভাবনা, জ্যোতিকা জ্যোতির।
যদিও গত বছরের ৯ অক্টোবর বিএনপির কাউন্সিলর পদপ্রার্থী সৈয়দ হাসান মাহমুদকে ২০২২ সালের ২৫ জুন হত্যাচেষ্টা ও গুমের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অভিনেত্রী তারানা হালিম, মমতাজ ও শমী কায়সারকে আসামি করা হয়। তবে সেটি জুলাই আন্দোলন কেন্দ্রিক মামলা ছিল না।
শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা সম্পর্কে যা বলছেন আইনজীবীরা
ঢাকা মহানগর আদালতের আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখী বলেন, যেকোনও মামলা করতে হলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও ডকুমেন্টস লাগবে। শিল্পীদের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ দেখা যাচ্ছে, একটা অর্থের জোগানদাতা ও অপরটি আওয়ামী লীগের সমর্থক। কোনও শিল্পী অর্থের জোগান দিলে সেটা তো ডকুমেন্টস থাকবে। এ ধরনের কোনও ডকুমেন্টস তো মামলায় নেই। ডকুমেন্টস না থাকার পরও কীসের ওপর ভিত্তি করে মামলা নেওয়া হচ্ছে? আর আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়া তো কোনও অপরাধ না। দল করার অধিকার তো সংবিধান দিয়েছে। বর্তমান সমস্যা হচ্ছে, যাকে আপনার পছন্দ না তার নামে ঢালাও মামলা দিয়ে দিলেন। আদালত ও রাষ্ট্রও সেটা যাচাই করলো না। আপনি অপরাধী হয়ে গেলেন। এটাতো আইনের অপব্যবহার।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, বর্তমানে সারা বাংলাদেশে মামলার একটা হিড়িক পড়েছে। গণহারে মামলা দেওয়া ঠিক না। দেশের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের সমর্থক। সেজন্য তো সবার নামে মামলা দেওয়া যাবে না। দেওয়া হলে আইন ভাঙা হবে। পরে আওয়ামী লীগ এসে আবার একই কাজ করে বিএনপি-জামায়াতের নামে মামলা দেবে। আইন ভাঙা সহজ, আইনের সমাজ গড়া কষ্টকর। সেজন্য যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। আর সরকারকে বলবো, মামলায় নাম থাকলেই কাউকে যেন গ্রেফতার না করে।