
চার বছরের বেশি সময় ধরে আড়ালে আছেন পপি। একসময় শোনা যায়, বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন এই চিত্রনায়িকা। সম্প্রতি একটি জিডিকে ইস্যু করে আবার আলোচনায় পপি। তখনই জানিয়েছিলেন, বিয়ে-স্বামী-সন্তান নিয়ে আপাতত কিছুই বলবেন না। অবশেষে মুখ খুললেন এই তারকা। গত রোববার দুপুরে বিয়ে, মাতৃত্ব ও সিনেমা নিয়ে তাঁর কথা শুনলেন মনজুর কাদের
গোপনে বিয়ে করতে হলো কেন?
পপি: বিয়ের খবর মোটেও গোপন করিনি। মা-বাবা, ভাইবোন, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, ফিল্মের বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই আমার বিয়ের খবর জানত। ফিল্মের পপির ব্যাপারে সবার আগ্রহ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমারও তো একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। সে জীবনের কতটুকু কী আমি পাবলিকলি জানাব, কতটুকু জানাব না, সেটা একান্তই আমার বিষয়। এ খবর জানাতে আমার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার বিয়ের খবরটা পরিবার ও ফিল্মের কাছের মানুষেরা জানলেই চলবে। রিয়াজ, নিপুণ, ফেরদৌসসহ সিনেমার বন্ধুরা জানত।
প্রথম আলো :
যত দূর জানতে পেরেছি, বর আদনান কামাল আপনার পূর্বপরিচিত।
পপি: আমাদের সাত বছরের পরিচয়। পরিচয়ের তিন বছর পর আমাদের বিয়ে হয়। তবে বিয়ে নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। সেই অর্থে প্রেমের বিষয়টা ছিল না। আদনানের সঙ্গে আমার মা-বাবাসহ পরিবারের সবার চমৎকার সম্পর্ক ছিল। দুই পরিবারে যাওয়া-আসা ছিল। আমরা সবাই মিলে ঘুরতেও গেছি। পারিবারিক বন্ধু, আমার অসাধারণ একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আমার যেকোনো বিপদে সে ছায়ার মতো পাশে ছিল। আমাকে সুরক্ষিত রেখেছে। আমি ও আদনান কিন্তু কখনো বিয়ের কথা ভাবিনি। তবে চারপাশের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।
কী সেই পরিস্থিতি?
পপি: ২০১৯ সালে আমার বাসায় অনেক বড় অঙ্কের টাকা চুরি যায়। থানায় জিডি করলাম। আমাদের রমনা থানায় ডাকা হয়। সেদিন আদনানকেও ডাকি। থানায় গিয়ে দেখলাম, আমার ভাইবোনেরা। সেদিন থানায় গিয়ে জানলাম, আমাকে মেরে ফেলার জন্য খুনি ভাড়া করা হয়েছে। আমাকে থানা থেকে বলা হলো, ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। এরপর জীবন নিয়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। মনে হলো, আমি কারও কাছে নিরাপদ নই। ফিল্মের কাজে সবার সঙ্গে মিশেছি ঠিকই কিন্তু আপনজন কেউ ছিল না। বরাবরই আমি পরিবার অন্তঃপ্রাণ মানুষ। অথচ এই আমার কাছে পরিবারের সবাই অচেনা হয়ে গেল। সম্পত্তি ও টাকাপয়সা নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। জটিলতার এই পুরো সময়ে আদনান আমাকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছে। কোনো জটিলতাই আমাকে স্পর্শ করতে দেয়নি। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল, ‘আমি আছি, নো টেনশন।’ ওই সময়ে এমন একজন বন্ধুকে যদি না পেতাম, আমার জীবনটাই বিপন্ন হয়ে যেত।
২০২০ সালের দিকে আবার জটিলতা শুরু হয়। বাসা থেকে বের হয়ে পড়ি। আদনানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরপর আমার জায়গাজমির দলিল, ব্যাংকের কাগজপত্র ও প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট পুলিশের সহযোগিতায় উদ্ধার করি। আদনানই তখন আমাকে বাঁচিয়েছে। পরিস্থিতির কারণে আমরা বিয়ে করতে বাধ্য হই। ২০২০ সালের নভেম্বরে বাসায় কাজি ডেকে বিয়ে করি। আমার আত্মীয়স্বজন ছিলেন। আত্মীয়দের অনেকের নাম এখন বলব না; কারণ, নাম প্রকাশ পেলে তারা আমার মায়েরও শত্রু হয়ে যাবে। এটা সত্য, বিয়েতে আমার মাকে ডাকিনি। হয়তো এটা বিশ্বাস করবে না কেউ, কিন্তু এটাই সত্য, আমার মা চাইতেন না আমি বিয়ে করে সংসারী হই।
এরপর...
পপি: বিয়ের পর আমি আমার মতো সংসার শুরু করি। আলাদা থাকি, স্বামীর সঙ্গে ধানমন্ডিতে। আমার সংসার বাঁচানোর জন্য আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর আমার স্বামী যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছি। আমি কিন্তু অনেকবার বলেছিও, বিয়ের পর আমি সিনেমা ছেড়ে দেব। আমার স্বামী না চাইলেও সিনেমায় কাজ করব না।
মা হলেন কবে?
পপি: ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবরে মা হয়েছি।
প্রথম আলো :
পপি উধাও। এমন খবর নিশ্চয় আপনার কাছ পর্যন্ত পৌঁছেছে?
পপি: আমি উধাও হইনি। আমার জীবনটা বাঁচাতে কিছুদিন আড়ালে ছিলাম। বিয়ের পর ধানমন্ডিতে থাকা শুরু করি। সামাজিকতা রক্ষার জন্য যা যা করার, সবই করেছি। আমার আত্মীয়স্বজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল আমার বাসায়। আমার আব্বুও দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে ছিলেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালেও গিয়েছি। আমার ছোট ভাই দীপুও বেশ কিছুদিন আমার বাসায় ছিল। দীপুর আমার বাসায় থাকার ব্যাপারে আব্বু না করেছিলেন, পরে আব্বুর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়।
আপনার কয়েকটি ছবির কাজ অসম্পূর্ণ ছিল। এসব ছবির ভবিষ্যৎ কী?
পপি: এটার জন্য আমার পরিচালক ও প্রযোজকদের কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। ওই মুহূর্তে আমার কাছে জীবন বাঁচানোটা জরুরি ছিল। আমি আমার কষ্টের কথা তখন কাউকে বলতে পারছিলাম না। কাউকে বলার মতোও পরিস্থিতি ছিল না। মানসম্মানের ভয়ে চুপ ছিলাম। তাই ওই মুহূর্তে বিয়ে করে বাঁচতে চেয়েছি। একটু নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করেছি।
প্রথম আলো :
এখন যদি ওই পরিচালক ও প্রযোজকেরা ছবির কাজ শেষ করতে চান...
পপি: এটা দেখা যাক। আমরা আলোচনার ভিত্তিতে একটা সমাধানের পথে আসব। আমার একটা প্রোডাকশন হাউস আছে, ক্যামেরার সামনে আসব কি না, জানি না। তবে নির্মাণের সঙ্গে জড়িত হব।
প্রথম আলো :
অভিনয়ে ফেরার কোনো পরিকল্পনা নেই?
পপি: আমার স্বামী আমাকে একটা সুন্দর জীবন দিয়েছে। সমাজে মর্যাদা দিয়েছে। সব প্রতিকূলতা থেকে আমাকে আগলে রেখেছে। অথচ ২৮ বছর আমি যাদের জন্য করেছি, পরিবারের তারাই আমার ক্ষতি করেছে। আর যে মানুষটার জন্য কিছুই করিনি, সেই আদনান আমার জীবন বাঁচানোর জন্য আমার হাত ধরেছে। সে যদি না চায়, আমি কখনোই অভিনয় করব না। তবে এটা নিয়ে সে কখনো কিছু বলেনি। এখন আমার চিন্তা সন্তানকে সুশিক্ষায় গড়ে তোলা। তবে আমার জীবনী নিয়ে সিনেমা বানাবই বানাব। সিনেমাটি আমি পরিচালনা না করলেও প্রযোজনা করব, এটা নিশ্চিত।
এই পর্যায়ে এসে জীবন নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?
পপি: ছোটবেলা থেকে আমি ভালোবাসার পাগল। চুপচাপ থাকতাম। অনেকে ভাবত আমি অহংকারী, কিন্তু মোটেও আমি তা ছিলাম না। সেই ভালোবাসা যখন আমার পরিবার থেকে না পেয়ে স্বামী-সন্তানের কাছ থেকে পাই, নীরবে কাঁদি। পৃথিবীতে এখন নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করি। আমি দর্শকের কাছ থেকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়েছি। এই চলচ্চিত্র অঙ্গনের প্রত্যেকটা মানুষ, এফডিসির ইটপাথরের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ, আমি যা-ই হয়েছি, ইন্ডাস্ট্রির মানুষের সাপোর্ট না পেলে এতটা সাফল্য পেতাম না। ভালো ভালো ছবিতে কাজ করতে পারতাম না। ভালো কাজ না করলে অর্থনৈতিকভাবে সফল হতে পারতাম না। আমি ফিল্ম ব্যাকগ্রাউন্ডের মেয়ে নই। আমাকে নিজে থেকে সব শিখতে হয়েছে। অল্প বয়সে সিনেমায় অভিনয় শুরু করি। তখনই আয়রোজগার শুরু। সত্যি বলতে, পরিবারের কোনো ভালোবাসা পাইনি। তাদের কাছে আমি টাকা কামানোর মেশিন ছিলাম। অথচ আমি ভাইবোনদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি। নিজের কোনো শখ-আহ্লাদও পূরণ করিনি। যাক, এখন আর এসব মনে করতেও চাই না। এখন যখন আমার সন্তান আমাকে জড়িয়ে ধরে, নিজেকে পৃথিবীর সুখী একজন মানুষ মনে হয়। আমার স্বামীর সঙ্গে সবচেয়ে শান্তিতে আছি। গত চার বছর আমার জীবনের সেরা সময়। আমি অনেক দেরিতে বিয়ে করেছি। এমন একজন স্বামী পেয়েছি, যার কারণে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে করি।