এক.
আমার কৈশোরে একটি ঘটনা ঘটেছিল। সকাল বেলা হঠাৎ নানা কণ্ঠে হট্টগোল চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেলাম আমাদের প্রতিবেশীর এক বাড়ির সাইতান বা বান্দরের লাঠিগাছ কাটা নিয়ে এই বিবাদ। প্রবীণরা বলছেন, তোমার বাড়ির সাইতান গাছটি কাটা যাবে না। এই বাড়ির মালিকের ছেলে বিয়ে করেছেন, তার জন্য আরো একটা ঘর দরকার। গাছটি কেটে তিনি সেখানে ঘর তুলতে চান। কিন্তু পাড়ার মুরব্বিরা সে গাছ কাটতে বাধা দিচ্ছেন। গাছঅলা ব্যক্তি বলছেন, বাড়ি আমার, গাছ আমার, আমি সে গাছ কেটে ঘর তুলব, তাতে কার কী! কিন্তু মুরব্বিদের যুক্তি হলো, এ গাছ কাটলে গ্রামের লোকজন আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম প্রভৃতি ফল আর খেতে পাবে না। কিন্তু গাছঅলা তা মানতে নারাজ। তার যুক্তি হলো, কাটব সাইতান গাছ তার সঙ্গে গ্রীষ্মকালীন ফলের সম্পর্ক কী? মুরব্বিরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, সম্পর্ক আছে। তারা এক ধরনের চ্যালেঞ্জও করলেন। বললেন, আমাদের গ্রামে যত বেশি মৌসুমি ফল ধরে, পাশের দুই এক গ্রামে এমনটি দেখা যায় না। বিশ্বাস না হলে তুমি গিয়ে পাশের দুই এক গ্রাম দেখে আসো। আমাদের একটু সিনিয়র আরেক ভাই এগিয়ে এলেন। বললেন, আমরা সাইকেল মেরে দুই একটা গ্রাম দেখে আসি। এটা সবাই মেনে নিলেন। আমরা পাশের দুটি গ্রামে সাইকেল নিয়ে ঢুকলাম। খালি গাছ দেখাই তো! সাইকেলের রডে বসে তার সঙ্গী হলাম। আমাদের গ্রাম থেকে যত দূরে যাই ততই দেখি, ফলের গাছগুলোতে ফলন কম। আমরা এসে রিপোর্ট করলাম। গাছঅলা সেটা বোধকরি বিশ্বাস করলেন না। তখন মুরব্বিরা তাকে বললেন, গাছ কাটা দু’দিন বন্ধ রাখো। তারপর নিজে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসো। মুরব্বিরা বললেন, আমরা আমাদের ছেলেবেলা থেকেই এই অবস্থা দেখে আসছি। আমাদের বাপ-দাদারাও দেখেছেন।
আম, কাঁঠালের মৌসুমে আমাদের প্রধান লক্ষ্য থাকত আমগাছ। আমের গুটি মারবেলের মতো সাইজ হলেই ঢিল মেরে গাছ থেকে পাড়ার চেষ্টা করতাম। আমের গুটি পেড়ে শুকনো মরিচ আর লবণ দিয়ে খেতাম আম ভর্তা। সে সময় সাইতান গাছের পাশ দিয়ে হাঁটলে শুনতে পেতাম শত শত ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুঞ্জন শব্দের মতো আওয়াজ। সেটা এক রহস্য ছিল। মা-বাবারা বলতেন, রাতে সাইতান গাছের পাশ দিয়েও হাঁটবি না। এই গাছে জিন থাকে। তবে আমরা কখনো সেই জিন দেখিনি। গ্রীষ্মকালীন সব গাছের বিভিন্ন ফলের মুকুল আসতে শুরু করে। সব গাছেই পোকামাকড় মৌমাছিরা ভিড় করে। সাইতান গাছের ছোট ছোট ফুল। তার মধ্যে এত পোকামাকড় ভিড় করে যে, সাইতান গাছে ক্ষুদ্র বেগুনি ফুলগুলো পোকামাকড়ে ঢেকে যায়। ফলে পরাগায়ন ভালো হয়। আর ফল পাওয়া যায় অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত গাছঅলা এই যুক্তি মেনে নেন এবং গাছ কাটা থেকে বিরত থাকেন। সিদ্ধান্ত হয়, নতুন ঘরটা তিনি অন্য ভিটায় তুলবেন। তারপর আরো তিন-চার বছর গ্রামে ছিলাম। সাইতান গাছ নিয়ে আর বিরোধের কথা শুনিনি। এখনো গাছটি আছে কি না বলতে পারি না।
দুই.
এক যুগেরও বেশি সময় আগে ব্রিটেনে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এদিক ওদিক ঘোরাফেরা ছাড়া আর সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ ছিল না। উইন্ডসরে থাকেন আমার এক আত্মীয়। একদিন তাদের ওখানে বেড়াতে গেলাম। বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে দেখলাম বেশ কিছু আপেল গাছ। একটি গাছ অত্যন্ত জীর্ণশীর্ণ। সেখানে একটি বড় বড় অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড! ‘এই গাছটি কাটা হবে। এ ব্যাপারে কারো কোনো আপত্তি থাকলে নিম্নোক্ত টেলিফোনে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হচ্ছে।’ একটি নাম্বার আমার এই আত্মীয়ের তার নিজের, অপর নম্বরটি মিউনিসিপ্যালিটি বা সিটি করপোরেশনের। আমি জানতে চাইলাম, আপনার একটি জীর্ণশীর্ণ আপেল গাছ কাটার জন্য কেন এত আয়োজন? তিনি জানালেন, এই শহরে বসবাস করার এটাই তরিকা। জানতে চাইলাম, কেন? জবাবে জানলাম, হয়তো কোনো সিনিয়র সিটিজেন সকালে ঘুম থেকে উঠে এই গাছটির দিকে তাকিয়ে আনন্দ পান কিংবা এই গাছের ফাঁক দিয়ে তিনি হয়তো দেখেন সকালের আলো। গাছটি কাটলে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হতে পারে। সে কারণে এই নোটিশ দেয়া। নোটিশ তিন মাস বাড়ির সামনে পেছনে ও আপেল গাছে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। কোনো নাগরিক যদি আপত্তি জানান তাহলে এই গাছটি কাটার অনুমতি দেবে না সিটি করপোরেশন। যে কেউ এসে তাদের আপত্তির কথা জানাতে পারেন। সে ক্ষেত্রে গাছ কাটা স্থগিত থাকবে। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার বাড়ি আমার গাছ এবং জরাজীর্ণ। তা সত্ত্বেও আমি কেন আমার গাছ কাটতে পারব না? সব ঠিক আছে কিন্তু আমার অন্য কোনো নাগরিকের আনন্দ বিনোদন ক্ষু্ণ্ন করার কোনো অধিকার নেই। এভাবেই ব্রিটেনে সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। জাতি হিসেবে ব্রিটিশরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
তিন.
বৃক্ষনিধন এই সরকারের মোটামুটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গাছ কাটলে কী ক্ষতি হয়, বন বিনাশে এই সরকার একেবারেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রথমে তারা সুন্দরবন বিনাশ করে রামপালে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। তখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করতে থাকেন। কারণ, এই কেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবনের বিরাট এলাকা যে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিরান হয়ে যেতে পারে, সরকার সে দিকে মনোযোগ না দিয়ে বরং ভারতীয় কোম্পানির সাথে রামপাল প্রকল্পের পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরতে থাকে। এখানে রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনেই বিস্তৃত হতে পারে, পরিবেশবিদরা তার বিস্তারিত গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য সরকার নানা রকম কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। চলে দমননীতিও।
আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন এলাকায় নদী ভরাট করে গড়ে তুলেছে দোকান, মার্কেট বা বসতবাড়ি। তারা অবৈধভাবে নদী থেকে বালু তুলে নদীর মৃত্যুকে যেমন ত্বরান্বিত করেছে, তেমনি পরিবেশের জন্য সৃষ্টি করেছে মারাত্মক হুমকি। কোথাও কোথাও বালুখেকো আওয়ামী নেতাকর্মীরা নিকটবর্তী সেতুর জন্য হুমকির সৃষ্টি করেছেন। সেতুর পিলারের নিচের বালু সরে গিয়ে সেতুকে দুর্বল করে ফেলেছে। ফলে যে উদ্দেশ্যে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখলাম, অপরিকল্পিত স্লুইস গেট নির্মাণের ফলে দুটি নদ-নদী একসাথে মারা যাচ্ছে। নদী মরে যাচ্ছে কি না, পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সরকারের ভেতরে এমন কেউ কি নেই, যারা পরিবেশের বিপর্যয় ও দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারেন?
সরকারি লোকেরা মাঝে মধ্যেই বলে থাকেন যে, অতি মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে নেমে গেছে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে কৃষকের সেচ কাজে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এ দিকে আবার ভারত গঙ্গা ও তিস্তায় আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী আমাদের যেই হিস্যা দেয়ার কথা, এ বিষয়ে সরকার একেবারেই নিশ্চুপ। সরকার ভারতীয় স্বার্থের অনুক‚লে। এই বলে বিবৃতি দেয় যে, ভারত নিজেই পানি পায় না আমাদের দেবে কোত্থেকে? ভারত যখন তিস্তার পানি নিয়ে আমাদের ভোগাচ্ছে, নতুন নতুন খাল খনন করে পানি প্রত্যাহার করছে তখন আমরা ভারতকে ফেনী নদীর পানি ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছি। তার জন্য সরকার কত যে যুক্তি এনে দাঁড় করাচ্ছে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
সাংবাদিকদের কেবলি ভয়, এই বুঝি, সরকার দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে দিলো। তারপর সরকারসংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের টুঁটি চেপে ধরে ঢুকিয়ে দিলো গারদের ওপারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
তার নমুনা দেখলাম সাত মসিজদ রোডে ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের মধ্য দিয়ে। সেই বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে মানববন্ধনের খবর ছাপা হয়েছে। কিন্তু ছাপা হয়নি অসহায় গাছগুলোর আর্তনাদের কোনো ছবি। ভিডিওতে সেই ছবি দেখে কেঁপে উঠেছে অন্তরাত্মা। মনে হচ্ছিল, যেন শিশুদের কোমর থেকে কেটে ফেলে পাগুলো মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়েছে। মন হু হু করে ওঠে। এত নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ! বুকটা হা-হা-কারে ভরে গেল।
গত ৩০ এপ্রিল থেকে মধ্যরাতে চোরের মতো এই গাছগুলো কেটেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। প্রতি দিন গাছ কমেছে। জনগণ বিষয়টা টের পেয়েছে আরো দু-এক দিন পরে। সাত-আট দিন পর বিক্ষুব্ধ শোকাহত বিপন্ন মানুষের সামনে এসে হাজির হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, ধানমন্ডিতে গাছ কাটা নিয়ে কেউ কেউ মর্মাহত হতেই পারেন, কষ্ট পেতেই পারেন, এটা তাদের আবেগের বিষয়। আবার অনেকের ঢালাওভাবে অনেক কথা বলছেন। কোনো তথ্য না নিয়েই কথা বলেন। আসলে উন্নয়ন কাজে অনেক সময় গাছ কেটে ফেলতে হয়, ফেলে দিতে হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক কিন্তু আমরা তখনই এ কাজ করি যখন নিতান্তই আর উপায় থাকে না। যে গাছগুলো ফেলে দিতে হয়েছে বা কেটে ফেলতে হয়েছে সেখানে আমরা একটি গাছের জায়গায় তিনটি গাছ লাগানোর লক্ষ্যে কাজ করছি। আমরা বর্ষা মৌসুমে ১০ হাজার গাছ লাগাব। সুতরাং এটা আমাদের চলমান প্রক্রিয়া। মেয়রের বক্তব্যে বোঝা গেল তারা আরো গাছ কাটবেন। গাছ কাটতে কাটতে তারা ঢাকা শহরকে বিরান ভূমিতে পরিণত করে ছাড়বেন। এই গাছ কাটতে নাকি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হয়েছে। যে বিশেষজ্ঞ গাছ রেখে দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে পারে না, সেরকম বিশেষজ্ঞ আমাদের প্রয়োজন নেই।
ঢাকা শহরের এই পথে আমি নিয়মিত চলাচল করি। প্রথম দিকে আমি মোটেও খেয়াল করিনি যে, এখানকার গাছ এরকম নির্মমভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এই দারুণ গরমে হঠাৎ লক্ষ করলাম, ছায়াঘেরা এই সড়কে ছায়া নেই। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, ঢাকা শহরের গাছগুলো পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঘাতকের নিষ্ঠুর করাত পুরো এলাকাটাকে ফাঁকা করে দিয়েছে।
রাস্তার পাশে গাড়িটা রেখে সেই পরিবেশবিনাশী ছায়াবিনাশী গাছগুলোর গুঁড়ির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনে হলো, কোনো ঘাতক এই সর্বনাশ করেছে। যে ‘উন্নয়ন’ কয়েক রাতে প্রায় ৪০০ গাছকে হত্যা করেছে, যে উন্নয়ন বৃক্ষ বিনাশ করে সে উন্নয়ন আমরা চাই না, যে উন্নয়ন নগরবাসীর নিঃশ্বাসের পথ বন্ধ করে গলাটিপে ধরে, আমরা তেমন উন্নয়ন চাই না। ক্ষুব্ধ পরিবেশ রক্ষাবিষয়ক সংগঠন বেলার প্রধান নির্বাহী এক প্রতিবাদ সভায় বলেছেন, এতে ব্যবহৃত সব ধনসম্পদ আপনারা নিয়ে যান। শুধু গাছগুলো ফিরিয়ে দিন। মেয়রের বক্তব্যে শুধু মনে হলো, কী অপরিসীম নিষ্ঠুর মানুষ তিনি। বছর বছর ফুটপাথ নতুন করে সাজানো; কী উন্নয়ন হয়েছে এই নগরীর? প্রাকৃতিকভাবে যেটুকু ছায়া ছিল, তাও বিদায় করে দেয়া হলো। এখন মধ্যরাতে হঠাৎ যান্ত্রিক করাতের শব্দ শুনি, শব্দ শুনি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন