কাঁঠাল কাহিনী
14 January 2023, Saturday
কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। কেন জাতীয় ফল সে বিতর্ক কোনদিন হয়নি। কাঁঠালের রকম ফের আছে। কোনো কাঁঠালের কোয়া শক্ত, কোনোটা গলা। স্বাদের হেরফের সামান্য। গ্রীষ্মকালে কাঁঠালের মৌসুমে মানুষ ব্যাপকভাবে কাঁঠাল খায়। প্রধানমন্ত্রী সত্য কথাই বলেছেন। কাঁঠাল এবং মুড়ি দিয়ে আমরাও সকালে নাস্তা করেছি। গাছ থেকে পাকা কাঁঠাল পেড়ে আমাদের কৈশোরে অনেকে গোল হয়ে বসে কাঁঠাল খেয়েছি। কিন্তু কোন প্রধান খাদ্যের বদলে কাঁঠাল খেয়েছি এমন মনে পড়ে না। গরুর গোশত দিয়ে কাঁচা কাঁঠালের (ইঁচর) তরকারি অত্যন্ত সুস্বাদু।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত বারোমেসে কাঁঠাল বিষয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে কাঁঠালের বহুবিধ ব্যবহার সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কাঁঠালের কোন কিছু ফেলনা নয়। কাঁঠাল তো মানুষ খায়ই, কাঁঠালের বীচি দিয়ে মুরগি রাঁধলেও তা সুস্বাদু হয়। কাঁঠালের চোঁচাও গরুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য এবং গরু তা খেতে পছন্দও করে। তিনি আরো বলেছেন, সুতরাং আমাদের গোশতের বদলে কাঁঠাল খাওয়া উচিত। আইডিয়া হিসেবে মন্দ না। এক কেজি গরুর গোশতের দাম এখন সাড়ে সাত’শ টাকা। খাসির গোশত প্রতি কেজি হাজার টাকা। কোরবানির ঈদের সময় ছাড়া সাধারণ মানুষ গরুর গোশতের আস্বাদ নিতে পারে না। মানুষের সেই ক্রয়ক্ষমতা নেই। মধ্যবিত্ত শ্রেণী গরুর গোশত কেনেন হঠাৎ। আগে যারা নিয়মিত গরুর গোশত খেতেন এখন হয়তো মাসে দু-একদিন খান।
আমি গত তিন মাসে মাত্র একবার গরুর গোশত কিনেছি। তার অর্থ এই নয় যে, আমার পরিবার গরুর গোশত খেতে চায় না। দ্রব্যমূল্যের অত্যধিক বৃদ্ধির ফলে গরুর গোশত কেনার সাধ্য আমার কমেছে। এখন নিয়মিত গোশত হলো ব্রয়লার মুরগি। কিন্তু মুরগি খেতে খেতে এখন আর বাসায় কেউ মুরগি খেতে চায় না। রুই মাছের কেজিও চার’শ টাকা। পাবদা সাত’শ টাকা, টাকি মাছ পাঁচ’শ টাকা। কোনো ধরনের গুঁড়া মাছই চার’শ টাকার নিচে নেই। বাজারে গেলে বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত মানুষকে গোশতের দোকানের পাশে ঘুরতে দেখি। কিনতে দেখি কমই। কসাইরা বলেছেন, গরুর গোশত তেমন বেচা বিক্রি নেই। আগে যেখানে এক দিনে দু’টি গরু বিক্রি করতেন এখন সেখানে একটি গরু বিক্রি করতেও তাদের সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। তারা বলেছিলেন, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে তারা চার’শ টাকা কেজি গরুর গোশত বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু এই চাঁদাবাজি বন্ধ করবে কে?
এরকম অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী গোশতের বদলে কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কাঁঠাল দিয়ে বারগার, রোল, কাবাব তৈরি করা যায়। আমাদের দেশের ছেলে-পেলেরা আজকাল ভাত খেতে চায় না। তার বদলে তারা রোল, বারগার, ফ্রাই খেতে পছন্দ করে। তার বাড়িতেও নাকি কাঁঠালের এসব জিনিস তৈরি হয় এবং তারা এগুলোই খান। এ কথা সত্য যে, ছেলে পেলেরা ফাস্ট ফুডের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে তাদের মধ্যে মোটা হয়ে যাওয়ার রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো তাদের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। আর অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়া কোনো মতেই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। আর একবার মোটা হয়ে গেলে তরুণ তরুণীদের সহজে সেটি কমিয়ে ফেলাও সম্ভব হয় না। পরবর্তীকালে এই মোটা হয়ে যাওয়া (ওবেইস) রোগ তাদের আরো নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত করে। সুতরাং অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড কিংবা ফাস্ট ফুড গ্রহণের স্বভাব তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
কাঁঠালের ফাস্ট ফুড তৈরিতে যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয় সেগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আবার এটিও সত্য যে আম, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি মৌসুমি ফল প্রক্রিয়া করে বাজারজাতও করতে পারলে এসব ফলের অপচয় হতো না। প্রাথমিকভাবে একজন উদ্যোক্তা কলার চিপস বাজারজাত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পটেটো চিপসের ধারে কাছেও তা যেতে পারেনি। ফলে সে উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে শরীর গঠনে গোশতের যে ভূমিকা কাঁঠাল তা কিছুতেই পূর্ণ করতে পারবে না। কাঁঠালের বারগার বা রোল শৌখিন পণ্য হিসেবে দুই একটা বিক্রি হতে পারে বটে কিন্তু সাধারণ বারগারের মতো সেই পরিমাণে বিক্রি হবে না। কারণ এগুলোতে আমরা অভ্যস্ত নই। যারা শামুক ঝিনুক খায় তারা তাতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমি আপনি শামুক ঝিনুক খেলে পেট তা মানবে বলে মনে হয় না। আমি নিজেও তার শিকার। শরীরে গোশতের কাজ গোশত করে। ফলের কাজ ফলে করে। সবজির কাজ সবজি করে। একটির বদলে আরেকটি দিয়ে বেশি দিন চলা যায় না।
প্রধানমন্ত্রী এ কথাও বলেছেন যে, তারা নাকি কাঁঠালের বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে খান এবং বিদেশেও নাকি লোকে কাঁঠালের রোল, বারগার, কাবাব এসব খেয়ে থাকে এবং সেগুলোর দাম নাকি অনেক বেশি বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। আমরা ভাতই পাই না সেখানে এসব মহামূল্যবান কাঁঠালের পণ্য কিভাবে কিনব।
আমাদের যতই বলা হোক না কেন দেশে খাদ্য সঙ্কট নেই কিন্তু বাজারে গেলে টের পাই সব পণ্যের দাম বেশি। সরকারি ওয়েবসাইটে মোটা চালের দাম লেখা আছে ৪০ টাকা। কিন্তু ৬০ টাকার নিচে বাজারে কোনো চাল নেই। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, মিল মালিকরা এবং খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা মিলে প্রতি কেজি চালে ১৪ টাকা লাভ করে। তাহলে আমরা কোথায় যাই। তাদেরকে কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ তারা সবাই সরকার দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে খাদ্য হিসেবে কাঁঠাল একটা বিকল্প হতে পারে বটে। আমাদের ছেলেবেলায় আকালের মৌসুমে আমরা সকালের নাস্তার বদলে মিষ্টি আলু খেয়েছি। এখন যদি আমরা বলি আটার কেজি যেহেতু ৮০ টাকা সুতরাং রুটির বদলে মিষ্টি আলু খেতে শুরু করেন। কিংবা গোল আলুর দাম ৪০ টাকা। গোল আলুর ঘণ্ট খেতে শুরু করুন। তা কি কেউ মানবে? এক দিন দুই দিন। তারপর আটার রুটি ও সবজি দাবি করবে। আমরা শৈশবে পান্তাভাত খেতাম। এখন যেহেতু গ্যাসের সঙ্কট তাই দুপুরে রান্না করে খেয়ে ভাতে পানি দিয়ে রাখুন। রাতে বা সকালে সেই পান্তাভাত কাঁচা মরিচ ডলে পেঁয়াজ দিয়ে খেয়ে ফেলুন। এটা কি কেউ মানবে? না, এটা আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
এদিকে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান কিছু দিন আগে কচুরি পানা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, গরু যদি কচুরি পানা খেতে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না। ভালো কথা বলেছেন মান্নান। গরু তো ঘাসও খায় তাহলে আমরা কেন ঘাস খেতে পারব না। ঘাস জাতীয় অনেক শাকসবজি তো আমরা খাই। তাহলে মন্ত্রী মান্নানের দেখানো উচিত ছিল কচুরি পানা কিভাবে খেতে হবে। গরু তো খড়ও খায়, তাহলে আমাদেরও খড় খেতে অভ্যস্ত হতে হবে! তিনি যদি একদিন কচুরিপানার শাক বা সবজি নিয়ে এসে এটা প্রক্রিয়া করা থেকে শুরু করে খাওয়া পর্যন্ত টিভিতে দেখিয়ে দিতেন তাহলে ইতোমধ্যে বোধহয় মানুষ কচুরিপানা খেতে শুরু করত।
১/১১’র সরকার মঈন উদ্দিন আহমেদের সময় দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। মঈন স্লোগান তুলেছিলেন, ভাতের বদলে আলু খান। তখন টিভিতে আলুর বিভিন্ন পদ কিভাবে রান্না করতে হয় তা নিয়মিত দেখানো হতো। আলু আমাদের দেশে সবজি কিন্তু প্রধান খাদ্য নয়। ফলে মইনের সে আহ্বান কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি।
১৯৮৭ সালে আমি চীন সফরে গিয়েছিলাম। সেখানে তখন খাদ্য সঙ্কট চলছিল। চীনা সরকার সে সময় বিকল্প খাদ্য গ্রহণে জনসাধারণকে উৎসাহিত করছিল। তারা টেলিভিশনে নিয়মিত অনুষ্ঠান করে দেখাত কিভাবে ইঁদুর রান্না করে খেতে হয়। চীনারা খাদ্যের ব্যাপারে ছুঁচিবাইগ্রস্ত নয়। তারা, শুনেছি, ইঁদুর ধরে খেতে শুরু করেছিল। বহু দেশে প্রোটিনের সাধারণ উৎস শূকর। কিন্তু বাংলাদেশে শূকরের মাংস প্রকাশ্যে বিক্রিও হয় না। খাওয়া তো দূরের কথা। ফলে আগে গ্রামগঞ্জে শূকরের বাথান দেখা যেত এখন তা বিরল হয়ে গেছে।
সুতরাং বললেই মানুষ ভাতের বদলে আলু, কচুরিপানা বা কাঁঠাল খেতে শুরু করবে না। কাঁঠাল যদি বারো মাসও পাওয়া যায় তাহলেও মানুষ গোশতের বদলে কিছুতেই কাঁঠাল খাবে না। প্রধানমন্ত্রী গোশতের বিষয়টা একেবারে বাদ দেননি। তিনি বলেছেন, কাঁঠালের বীচি রাঁধতে হবে মুরগি দিয়ে। মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য তাই শুধু কাঁঠাল খেলেই হবে না। তার সঙ্গে প্রাণিজ আমিষও দরকার। বলা যায়, যারা ভেজেটেরিয়ান তারা আমিষ ছাড়া কিভাবে বাঁচে এবং সুন্দর স্বাস্থ্য নিয়ে জীবনযাপন করে। আমরা হয়তো খেয়াল করি না যে, ভেজেটেরিয়ানরা গোশত খান না বটে তবে প্রচুর পরিমাণে দুধ মাখন পনির খান। অর্থাৎ আমিষ তারাও গ্রহণ করেন।
এ প্রসঙ্গে গোপালভাঁড়ের একটি কাহিনী এখানে উল্লেখ করা যায়। গোপালভাঁড়ের মেয়ে-মেয়ের জামাই তার বাসায় বেড়াতে এসেছে। গোপালভাঁড়ের স্ত্রী বললেন, এত দিন পরে জামাই এসেছে বাজারে যাও গোশত নিয়ে এসো। গোপালভাঁড় বললেন, জামাইকেই পাঠাও। গোপালের স্ত্রী তো হা হা রে রে করে উঠলেন। বললেন, জামাইকে কিভাবে বাজার করতে বলব। পরে সিদ্ধান্ত হলো গোপাল ও তার মেয়ের জামাই দু’জনই এক সঙ্গে বাজারে যাবেন। গোপালের মেয়ের জামাই খুবই হাড়কিপটে। সে এক পয়সাও খরচ করবে না। গোশতের দোকানে গিয়ে গোপাল বলল নাও। কতটুকু গোশত নেবে নাও, টাকা দাও। টাকার কথা শুনে জামাই কুঁকড়ে গেল। তখন জামাই বুদ্ধি দিলো। গোশতের বদলে কাঁঠাল কিনে নিলে কেমন হয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো কাঁঠালই কেনা হবে। কাঁঠাল নিয়ে গোপাল বাড়ি গেল। বউ তো অগ্নিশর্মা। গোপাল বলল, কাঁঠালের চামড়া ছুলে গোশতের মতো টুকরো করে রান্না করে ফেলো। মনে হবে গোশতই খাচ্ছি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন