শাপলা চত্বরে তাহলে আপনারা কী করেছিলেন
26 November 2022, Saturday
এখন সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিএনপিকে এই বলে হুঁশিয়ার করছেন যে, ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ঢাকার গণসমাবেশে বিএনপি যদি গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করে তাহলে শাপলা চত্বরে হেফাজতের যে পরিণতি হয়েছিল বিএনপিকে তার চেয়েও মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে। এমনিতে হেফাজতের সমাবেশে জনশ্রুতি আছে যে- গণহত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাতভর বিভিন্ন বাহিনী হোসপাইপ দিয়ে গোটা মতিঝিলের ভবনগুলোর দেয়াল ও রাস্তাঘাট ধুয়ে ফেলেছিল; যাতে রক্তের কোনো চিহ্ন না থাকে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল- কওমি মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে ওই বিশাল সমাবেশ ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ নিয়ে বরং কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বহু মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু এর নেতাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ সরকার নেয়নি।
২০১৩ সালের ৫ মে কিছু দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলাম মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এক সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশে কওমি মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষার্থী সমবেত হয়েছিল। কিন্তু কী ঘটেছিল সেখানে, সেটি আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। তখন সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়া বলতে গেলে একেবারে নিশ্চুপ ছিল। এর মধ্য দিয়ে সরকার বলতে গেলে হাজারও কওমি সমর্থকের লাশ গুম করে ফেলেছিল বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত এ অভিযোগের কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি। কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি, সেই দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কত হেফাজতকর্মীর মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু এ ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। সর্বত্র একটি সংশয়, একটি ভীতি কাজ করতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হেফাজতকর্মীদের সেখান থেকে হটিয়ে দিলেও ওই ঘটনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করেছিল।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সেই সমাবেশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বেশ বিচলিত করে তোলে। তবে সরকার কৌশল হিসেবে মামলার ক্ষেত্রে হেফাজতের বড় বড় নেতাকে এড়িয়ে যায় ও বড় নেতাদের ধরপাকড়ের চেষ্টা করেনি। সংগঠনটির কিছু কেন্দ্রীয় নেতাকে আটক করা হলেও অল্প দিনের মধ্যে তাদের জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর সরকার ধীরে ধীরে হেফাজতের সাথে সমঝোতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে থাকে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা দফায় দফায় গিয়ে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফীর সাথে দেখা করেন এবং তার হাত ধরে বসে থাকেন। তাদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছিল সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে সরকার যে ওই হামলার পর নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল, সেটি তাদের তৎপরতায় বোঝা যায়। এর আট বছর পর সরকার আবারো সম্পূর্ণ উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর বেশ কঠোর হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হেফাজতের প্রায় ডজনখানিক কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্য দিয়ে হেফাজত তার কমিটি বিলুপ্ত করে দেয়।
কিন্তু তারও আগে ২০১৮ সালে ৪ নভেম্বর সরকারি উদ্যোগে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতের এক ‘বিশাল’ সমাবেশ ডাকা হয়। সেই সমাবেশে শেখ হাসিনা ও আল্লামা শফী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন। আর শফী সাহেব শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাতেও হেফাজতে ইসলামের শেষ রক্ষা হয়নি; কিন্তু সরকারের সাথে হেফাজতে ইসলামের এই সখ্য হেফাজতের বহু নেতাকর্মী পছন্দ করেনি। আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের ঐক্যে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়। এরপর ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকার আগমনকে কেন্দ্র করে সরকার ও হেফাজতের মধ্যে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। এখন হেফাজতে ইসলামের নেতারা পুলিশের ধরপাকড় সামাল দিতে ব্যস্ত। তারা বারবার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন।
এ কথা প্রায় সর্বজনস্বীকৃত যে, শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযান হেফাজত বোধ করি কল্পনাও করেনি। সে অভিযান প্রতিহত করার কোনো ইচ্ছা বা প্রস্তুতি তাদের ছিল না। এখন সরকার যে চাপ সৃষ্টি করেছে সেটি তাদেরকে পোষ মানানোর একটি কৌশল হতে পারে। আপাতত হেফাজত তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। কিন্তু শাপলা চত্বরের ঘটনায় তাদের মনে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, সেটি এখনো টাটকাই রয়েছে। সরকার যদি হেফাজতে ইসলামের ব্যানার গুটিয়ে ফেলার চাপ প্রয়োগে সফলও হয় তা হলেও তাদের আন্দোলন কিংবা এ সরকারের প্রতি তাদের ঘৃণা দূর হবে বলে মনে হয় না।
সে সময় বিএনপি রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছিল, সরকার চায়নি হেফাজতে ইসলাম তাদের নতুন আরো একটি প্রতিপক্ষ হয়ে সামনে আসুক। হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবি করলেও ২০১৩ সালে তারা যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক চরিত্র ছিল। সে জন্য হেফাজতে ইসলামকে জামায়াতে ইসলামীর বিকল্প হিসেবে একটি ইসলামী দল হিসেবে ক্ষমতাসীনরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল বলে মনে করা হয়। হেফাজতে ইসলাম যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দিয়ে গৌরবান্বিত করেছে বা হয়েছে; তেমনি তাদের দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে একটি ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া হয়। সরকার যাই বলুক না কেন, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। গুগল ঘাঁটলে তার চিত্র পাওয়া যায়।
শাপলা চত্বর ঘটনার পর বিএনপি এক বিবৃতিতে রোববার (৫ মে) মধ্যরাতে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে বলে এ ঘটনার নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছে। বিএনপির দাবি ওই রাতে আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছে। এ ছাড়া লাশের ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চালিয়ে দেয়া এবং ট্রাকভর্তি লাশ সরিয়ে নেয়ার দৃশ্য বিভিন্ন আলোকচিত্রে ও ভিডিওতে দেখেছে। বিএনপি বলেছে, এই হত্যাকাণ্ড শুধু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রির সাথে তুলনীয়। এটি ভারতের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডকেও হার মানিয়েছে। আওয়ামী লীগ ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে বলেও বিএনপির দাবি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজাম্মান দুদুর স্বাক্ষর করা ওই বিবৃতিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকার গত ৫ মে রোববার মধ্য রাতের পর রাজধানী ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর ভয়াবহতম যে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাতে দেশবাসী ও সচেতন বিশ্ব বিবেকের সাথে আমরা স্তম্ভিত ও গভীরভাবে মর্মাহত। নিজেদের দেশের মানুষের ওপর কোনো সভ্য সরকার এমন জঘন্য বর্বর হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে, তা আমাদের কাছে কল্পনাতীত। এ নৃশংস মারণযজ্ঞের প্রতিবাদ জানানোর ও শোক প্রকাশের ভাষা আমাদের নেই। বিএনপি স্থায়ী কমিটি মনে করে এই হত্যাযজ্ঞ সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। আওয়ামী সশস্ত্র ক্যাডারদের আগে থেকে মোতায়েন করা হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা। অভিযানের আগে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের ঘটনাস্থল থেকে বিতাড়িত করা থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিরস্ত্র জনগণের সমাবেশ ভাঙতে সরকার আর্মার্ড পারসনেল ক্যারিয়ারসহ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভয়ঙ্কর বিভিন্ন মারণাস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করে বলে অভিযোগ করে বিএনপি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আক্রমণকারীদের সুরক্ষা দিয়ে হেফাজত কর্মীদের ওপর যৌথভাবে হামলা চালায়। তারা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। সরকারি দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পল্টন মোড় ও বায়তুল মোকাররম এলাকা দখলে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দোকানপাট বাণিজ্যকেন্দ্র ফুটপাথের বইয়ের দোকান ও যানবাহনে বেপরোয়া হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। তারা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এমনকি পবিত্র কুরআনেও অগ্নিসংযোগ করে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত বিভিন্ন ভিডিওফুটেজে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদবিধারী বেশ কয়েকজনকে এসব সন্ত্রাসী তৎপরতায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। বিবৃতিতে বিএনপি বলে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে ঘুমন্ত মানুষের ওপর যে গণহত্যা এ অঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তুলে ছিল, ৫ মে’র কালো রাতের গণহত্যা কেবল তার সাথে তুলনীয়। আমরা এ গণহত্যার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছি।’
মোটামুটি এই ছিল ৫ মে শাপালা চত্বরের গণহত্যার বিবরণ। এখানে নানা প্রশ্ন আছে, কেন আল্লামা শফীকে আজিমপুর থেকে শাপলা চত্বরে বক্তৃতা দিতে আসতে দেয়া হলো না সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। সরকার যতই বলুক ৫ মে শাপলা চত্বরে কিছুই ঘটেনি। কিন্তু সে কথা কেউ বিশ্বাস করে না। এখন বিএনপিকেও শাপলা চত্বরের পরিণতির হুমকি দেয়া হচ্ছে। বিএনপি দেশের বেশ কয়েকটি বিভাগীয় শহরে জনসমাবেশ করেছে। সরকার নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, যাতে সাধারণ মানুষ জনসমাবেশে আসতে না পারে। কিন্তু শত বাধা পেরিয়ে জনসমাবেশে দু-তিন দিন আগে থেকে নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ হাজির হয়েছে। এক একটি জনসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। সমাবেশের সবাই বিএনপির কর্মী নয়। সাধারণ মানুষও আছে বিস্তর। তাদের পেট চলে না। অসহনীয় দ্রব্যমূল্যে অতিষ্ঠ। তারাও পরিবর্তন চায়। সরকার যদি বিএনপির সমাবেশে শাপলা চত্বরের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়, তা হলে তা হবে মারাত্মক আত্মঘাতী।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন