রেড়ি বা ভেন্নার তেল ও কুপিবাতি
13 October 2022, Thursday
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে আমাদের একেবারে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এবং ধারণা দিয়েছেন যে, শতবর্ষ আগে আমাদের জ্বালানি ও আলোর জন্য যেসব উপকরণ ব্যবহার করতে হতো সম্ভবত সবাইকে সেখানেই ফিরে যেতে হবে। দেশে এখন বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, গ্যাসের চাপ খুব কম। বাজারদরের কথা না হয় না-ই বললাম। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এসব না থাকায় আমাদের কী আর দুরবস্থা তার চেয়ে অনেক কষ্টে আছে উন্নত দেশের মানুষ। তাদেরও আছে জ্বালানি সঙ্কট, তবে সে সঙ্কট মোকাবেলায় তারা রান্না করতে খড়ি ব্যবহার করছে কি না সেটি প্রধানমন্ত্রী জানাননি।
তারা বিদ্যুৎসাশ্রয়ের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন তা আমাদের জানা নেই। সেখানেও সম্ভবত নিয়মিত লোডশেডিং হচ্ছে। কিংবা এখনো আমরা যে পরিস্থিতিতে পড়েছি তেমন অবস্থায় তারা পড়েনি। পড়তে হয়তো সময় লাগবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেক প্লাস সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, তারা জ্বালানি তেলের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমিয়ে দেবে। তা না হলে দরপতন রোধ করা যাবে না এবং উৎপাদক দেশগুলো আর্থিক সঙ্কটে পড়বে। কে চায় নিজের হাতে নিজের দেশের মানুষকে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে ফেলতে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ওপেকের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। তাতে খুব সুবিধা হবে না। কিছুকাল আগে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১২০ থেকে ১৪০ ডলার হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে উৎপাদক দেশগুলো অধিক লাভের আশায় জ্বালানি তেল উত্তোলন বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন আবার কমিয়েছে। এ খেলা দীর্ঘকাল চলে আসছে। প্রধানত আরব দেশগুলো তেল উৎপাদন করে। তারা বিশ্বে বেশি তেল ব্যবহারকারী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তেলাস্ত্র ব্যবহার করে।
এই যেমন রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইউরোপের বহু দেশ নির্ভরশীল; কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করে তার প্রায় ১৫ শতাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে। আধুনিক বিশ্বে এটি অত্যন্ত জবরদস্তি। কেউ কোনো ছোট দেশকে বা তার অংশবিশেষকে দখল করে নেবে, বিশ্বের কোনো দেশই তা প্রকাশ্যে মেনে নেবে না। নেয়ও নি। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ করেছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছেই। এটি আর গোপন নেই যে, ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো এখন প্রকাশ্যে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিচ্ছে। ফলে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে ইউক্রেন কোথাও কোথাও সফল হচ্ছে। তাদের হটিয়ে দিয়ে নিজের ভূমি পুনর্দখল করছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে মোকাবেলার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তিন লাখ রুশ তরুণকে যুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই আশপাশের দেশে পালিয়ে গেছে। এই অন্যায় যুদ্ধে তারা পুতিনের সাথে থাকতে কিংবা তার নির্দেশ পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
কিন্তু রাশিয়ার হাতে অস্ত্র আছে, সেটি হলো- প্রাকৃতিক গ্যাস, আর আছে জ্বালানি তেল। জ্বালানি তেলের জন্য রাশিয়ার ওপর কেউ নির্ভরশীল নয়। রাশিয়াকে কিছুটা রিলিভ দেয়ার জন্য ভারত রাশিয়া থেকে কিছু তেল আমদানি করেছে। আর সাথে সাথে আমাদের সরকার বলে বসল যে, ভারত যদি রাশিয়ার তেল আমদানি করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? অর্থাৎ অবরোধের কথাটি মাথায় রেখেই এই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেল, আমাদের রিফাইনারিতে রাশিয়ান তেল পরিশোধন করা সম্ভব নয়। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ থেকেই আমাদের প্রধান আমদানি পণ্য গম। সেটিও খুব নির্বিঘ্ন নেই। ইউক্রেন দখলের পরও রাশিয়ার প্রতি আমাদের সরকারের ভালোবাসা অটুট আছে ও সুতীব্র হয়েছে। ইউক্রেনের অংশবিশেষ রাশিয়া দখল করে নেয়ার বিষয়টি বিশ্বের কোনো দেশ সমর্থন করেনি। সে প্রসঙ্গ এক পাশে সরিয়ে রেখে বাংলাদেশ সরকার বলেছে, রাশিয়ার অবরোধ দেয়াটা মানবতাবিরোধী কাণ্ড হয়েছে। কিন্তু, রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলা ও এর অংশবিশেষ দখল কি ন্যায়সঙ্গত হয়েছে?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন, আগামী বছর বিশ্বব্যাপী তীব্র খাদ্যসঙ্কট অথবা দুর্ভিক্ষ হতে পারে। কী সাঙ্ঘাতিক খবর। আমরা যারা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ দেখেছি, না খেয়ে থেকেছি, শত শত মানুষকে খাদ্যাভাবে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা দেখেছি, আধপেটা খেয়েছি কী খাইনি। তাদের কাছে এটি একটি আতঙ্কের সংবাদ। সরকার যদিও বলেছে, পাঁচ মাসের খাদ্য কেনার টাকা তাদের কাছে আছে। কিন্তু, আমরা তো শুধু খাদ্যই কিনি না, আরো বহুবিধ জিনিস আমাদের কিনতে হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এক ইঞ্চি জায়গাও যেন খালি না থাকে, চাষ করুন। চাষ করতে সার লাগে। সারও নেই, তার দামও বেড়েছে। সারের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে কৃষকরা সড়ক অবরোধ করছেন। নিশ্চিত করে বলা মুশকিল যে, সামনের দিনগুলো আমরা কিভাবে কাটাব।
জ্বালানি তেল যে সরকার সরবরাহ করতে পারবে না সেটি মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সে জন্য বিদ্যুতের আশা ক্রমেই তিরোহিত হচ্ছে। আর তাই সরকার পরামর্শ দিয়েছে যে, আমরা যেন আলোর জন্য রেড়ি ও ভেন্নার তেলের ওপর নির্ভর করি। রেড়ি ও ভেন্না প্রায় এক ধরনের গাছ, ভেন্না গাছে কাঁটাওয়ালা ফল হয়। সে ফল পিষে তেল বের করা হয়। এসব ভেন্নাগাছ খালের দু’পাশে আপনাআপনি হয়ে থাকত। কলুরা গোছায় গোছায় কেটে নিত। এখন সে গাছও নেই, সে ভেন্নাও নেই। খাল নেই, পানি নেই। সুতরাং ভেন্নার তেল কোথায় পাবো? ৭০-৮০ বছর আগেও এই কলুরা সরিষার তেলের সাথে ভেন্নার তেলের ভেজাল দিতেন। তাদের কাছ থেকে তেল কিনতে লোকে বারবার জিজ্ঞেস করত, ভেন্নার তেল মেশাননি তো।
আলাদাভাবে ভেন্নার তেল বা রেড়ির তেল সাধারণ তেলের চেয়ে ঘন। মাটির প্রদীপে সুতোর সলতে দিয়ে তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হতো। সাধারণত, মাটি দিয়ে তৈরি হতো পিদিম। ছোট্ট ভাণ্ড, পূজা-অর্চনায় দেব-দেবীর পায়ের কাছে এই পিদিম জ্বালিয়ে রাখা হতো। আলোকিত করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল দেব-দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা। প্রধানমন্ত্রী কুপির কথাও বলেছেন। রেড়ি বা ভেন্নার তেল দিয়ে কুপি জ্বালানোর কথা শুনিনি। কুপি বা হারিকেন কেরোসিন তেলে জ্বলে। এ কেরোসিনও আমদানি করতে হয়। কুপি বা হারিকেনের আলোয় আমরা শৈশব-কৈশোরে লেখাপড়া করেছি। সুতরাং কুপি বা হারিকেনের আশাও বাদ। জ্বালানি তেলের সঙ্কট তো আর শিগগিরই শেষ হচ্ছে না। অতএব, শুধু বাকি রইল মাটির পিদিম। লেখাপড়ায় যবনিকা। আমাদের সন্তানদের বা নাতি-নাতনীদের ভবিষ্যৎ কি পিদিমের আলোর মতো টিমটিমে হয়ে যাবে? কে তার জবাব দেবে?
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন