সংবাদপত্রে দেখা গেল এক মহিলা তার প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে তার নিজের অল্পবয়স্ক ছেলেকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে। আগেকার দিনে বাস্তব জীবনে তো নয়ই, এমনকি গল্প-কাহিনীতেও এ ধরনের ঘটনা পাওয়া যেত না।
কিন্তু আগের দিনে বাস্তব জীবনে যা পাওয়াই যেত না, গল্প-কাহিনীতেও নয়, এখন তা ঘটছে। কিন্তু এর ভয়াবহ দিক হচ্ছে এই যে, এ ধরনের ঘটনা কোনো বড় রকম ব্যতিক্রম নয়।
সন্তানের প্রতি পিতামাতার এ ধরনের নিষ্ঠুরতার ঘটনার রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায়। শুধু সন্তান হত্যাই নয়, সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যা, ভাই-বোন কর্তৃক ভাই-বোন হত্যা, বন্ধু কর্তৃক বন্ধু হত্যার রিপোর্টও সংবাদপত্রে প্রায়ই পাওয়া যায়। বেশ ঘনঘনই বলতে হবে।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে এ অঞ্চলের বাঙালিরা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সমাজের এই অবস্থা দাঁড়াবে এটা তো কেউ চরম দুঃস্বপ্নেও দেখত না। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা এখন দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা পরিণত হয়েছে এক নিয়মিত ব্যাপারে।
লক্ষ করার বিষয়, সমাজের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে আজ অরাজকতা ও চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে না। আগে শিক্ষকরা ছিলেন ছাত্রদের শ্রদ্ধার পাত্র। কারণ তারা ছাত্রদেরকে প্রত্যেক পর্যায়ে শিক্ষা দান করে উন্নত জীবনের জন্য তাদেরকে তৈরি করতেন।
এখন সংবাদপত্র রিপোর্টে প্রায়ই দেখা যায় ছাত্ররা শিক্ষকদের মারধর পর্যন্ত করছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষক, হেডমাস্টার, প্রিন্সিপালরা ছাত্রদের সরাসরি শারীরিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ছাত্রদের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এর কারণও আছে।
যারা এখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন, তাদেরও বিপুল অধিকাংশ স্বাধীন বাংলাদেশেই বড় হয়েছেন, শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তাদের অনেকেরই ছাত্র হিসেবে রেকর্ড ভালো নয়। ভোগের মোহ তাদেরকে আর্থিক দিক দিয়ে অসৎ করছে, ছাত্রদেরকে প্রকৃত শিক্ষা দানের পরিবর্তে ছাত্রদের পকেট মারার দিকেই তাদের অনেকের দৃষ্টি বেশি।
এর ফলে তাদের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রী ধর্ষণ এবং ছাত্রী লাঞ্ছনার সংবাদও প্রায় নিয়মিত। এই পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এটা ভাবার উপায় নেই।
নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে কোচিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করছেন এমন শিক্ষকের সংখ্যার শেষ নেই। এ বছর দেখা গেল, পরীক্ষার প্রত্যেক স্তরে, বিশেষত প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের হিড়িক।
এর সঙ্গে প্রধানত শিক্ষক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরাই জড়িত। এদিক দিয়ে বলা চলে, শিক্ষাব্যবস্থায় এমন নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে যা যে কোনো সমাজ ও জাতির জীবনে এক আতঙ্কজনক বিপদের ব্যাপার।
সমাজের ওপরতলায় কিভাবে লুটতরাজ, ভূমি দস্যুতা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংক লুট হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের দুর্বৃত্তগিরি কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে- এটা সবারই জানা। সংবাদপত্রে এসবের রিপোর্ট নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু শুধু ওপরতলার লোকরাই যে এসব ক্রাইম করছে তাই নয়, এসব দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা চুইয়ে চুইয়ে সমাজের নিচের দিক পর্যন্ত বিপজ্জনকভাবে সংক্রমিত করেছে।
এজন্য ক্ষমতাবানদের সহায়তায় গ্রামের গরিবদের ওপর নির্যাতনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের অনেককে জমিজমা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মুসলমান, হিন্দু, নির্বিশেষে গরিবদের অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে।
সাঁওতাল থেকে নিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ি জাতিসত্তার লোকদের জমি ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় লোকজন ও সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীনরা নিজেরা লুটপাট করছে। গরিবদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করে সেগুলো দখল করছে।
দেশে দুর্ভিক্ষ নেই, কিন্তু ব্যাপকভাবে শিশু, নারী ও পুরুষরা অপুষ্টিতে ভুগে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের তিন বেলা ঠিকমতো খাওয়ার সংস্থান নেই, অপুষ্টিজনিত এবং অন্য কারণে অসুস্থ লোকদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।
সামান্য কিছু লোক চিকিৎসার জন্য তাদের শেষ সম্বল গরু-ছাগল, জমিজমা, এমনকি ভিটে পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছে। কিন্তু তাদের বিপুল অধিকাংশই থাকছে চিকিৎসার বাইরে। বিনা চিকিৎসাতেই তাদের মৃত্যু হচ্ছে। দেশে দুর্ভিক্ষ নেই, কিন্তু এসব কারণে লাখ লাখ মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে। দেশের সব গরিব শ্রমজীবী লোকদের অবস্থাই এ রকম।
শহরাঞ্চলে অসংখ্য গৃহনির্মাণ কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। তারা দেশের কিছু লোকের জন্য, হতে পারে দশ শতাংশ, বাড়িঘর নির্মাণ করে ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। এই নির্মাণ কোম্পানিগুলো মাঝে মাঝে শহরের বিভিন্ন বস্তিতে আগুন লাগিয়ে তাদেরকে উচ্ছেদ করছে অথবা উচ্ছেদের চেষ্টা করছে জায়গা দখলের জন্য। এটা হল তাদের ভূমিদস্যুতার একটা রূপ।
মাত্র কয়েক দিন আগে মিরপুরের এক অবাঙালি বস্তিতে আগুন দিয়ে সব পুড়িয়ে ফেলেছে ক্ষমতাসীনরা। এসব ঘটনার জন্য জিডি করতে গেলে থানায় তাদেরকে কোনো পাত্তা দেয়া পর্যন্ত হয় না। ঢাকা শহরে লাখ লাখ মানুষ বস্তিতে বাস করেন। এসব বস্তি মনুষ্য বাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য। ঝুপড়ির মতো ঘরগুলোতে খাওয়ার পানি নেই, টয়লেটের অবস্থা ভয়াবহভাবে অস্বাস্থ্যকর। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এককথায় সাধারণ গরিবদের এই জীবন কোনো মানুষের জীবন নয়। কোনো স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের জীবন তো নয়ই।
এই হল দেশের সাধারণ গরিব মানুষ, জনসংখ্যার আশি-নব্বই শতাংশ লোকের জীবনের চিত্র। কিন্তু বাকিদের জীবনের চিত্র অন্যরকম। ১৯৭২ সাল থেকে ব্যাপক লুটতরাজ ও দুর্নীতির মাধ্যমে যে শাসক শ্রেণী গঠিত হয়েছে তাদের মধ্যে আছে সচ্ছল মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ধনীদের দল। তারা দেশের সর্বস্তরের শ্রমজীবী জনগণের দ্বারা উৎপাদিত সম্পদের ভাগ নানাভাবে লাভ করে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে।
তারা বড় বড়, বিশাল সব ফ্ল্যাট ও বাড়িতে থাকছে। এমন বিলাসী জীবনযাপন করছে, যা তাদের আগের পুরুষরা কল্পনাও করতে পারত না। শাসক শ্রেণীর এসব অংশের লোকরা উৎসবের পর উৎসব করে দেশকে মাতিয়ে রাখছে। দেশ, জনগণ, সংস্কৃতি ইত্যাদির খেদমত করার জন্য এদের প্রতিনিধিদেরকে দিনের পর দিন নানা পুরস্কার, সম্মাননা, আজীবন সম্মাননা, সংবর্ধনা ইত্যাদি প্রদান করা হচ্ছে। এসব সম্মাননার সঙ্গে আছে অর্থ।
কেউ কেউ একের পর এক এতরকম পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়ে থাকেন যে মনে হয় এসব থেকে প্রাপ্ত অর্থে তাদের সংসার আর্থিকভাবে নির্বাহ হতে পারে! এ ধরনের লোকদের হাতে কত অর্ধাগম হচ্ছে তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকায় অগণিত, অসংখ্য ব্যয়বহুল হোটেল-রেস্তোরাঁর দিকে তাকিয়ে। এগুলোতে উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা নিয়মিত গিয়ে ফোয়ারার মতো অর্থ ব্যয় করছে।
এ সবের বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এবং মানুষ স্বচক্ষে দেখে। এর থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে দ্রুত খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু লক্ষ করার বিষয় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের সাধারণ মানুষের এমন অবস্থা কিভাবে হল, উন্নয়ন হয়ে চলা সত্ত্বেও এই উন্নয়নের ফসল কারা কিভাবে লুটপাট করে নিজেদের ভোগ-বিলাসের জীবনযাপন করছে।
হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা এরা ক’জন কিভাবে পকেটস্থ করছে, কিভাবে তারা এই সম্পদের বড় অংশ বিদেশে পাচার করছে, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন কেউ তোলে না। কেউ সে চেষ্টা করলে তাকে শাসক শ্রেণীর পক্ষ থেকে প্রতিহত করা হয়। কিন্তু এর প্রকৃত কারণ, এর জন্য দায়ী শ্রেণী ও ব্যক্তিদের যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে শনাক্ত করা না হলে এবং এদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত ও পরাজিত না করা পর্যন্ত দেশ ও সমাজের এ অবস্থার পরিবর্তন যে সম্ভব নয় এটা বলাই বাহুল্য।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন