Image description

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা জ্যামিতিকভাবে বাড়লেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। গত ১০ বছরে বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ বিদেশে উন্নতমানের জীবনযাত্রা, আধুনিক পড়াশোনা এবং শিক্ষার পাশাপাশি চাকরির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। এ ছাড়া বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোনো দেশে চাকরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বিদেশি ডিগ্রিকে।

 
ফলে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী স্রোত বেড়েই চলছে।

 

শিক্ষাবিদরা বলছেন, মানের দিক দিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ, ভবিষ্যত্ নিয়ে অনিশ্চয়তা, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূলত আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশমুখী হচ্ছে। ইদানীং বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের স্কলারশিপ আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশিমুখী করছে।

ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য গেছে ৫৫টি দেশে।

 

 

২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ১৫১ এবং ২০২১ সালে ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮। আর ২০১৩ সালে বিদেশে গিয়েছিল ২৪ হাজার ১১২ জন শিক্ষার্থী। অর্থাত্ ১০ বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে; যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করেন এসংক্রান্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ফ্যাডক্যাব) তথ্য মতে, বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক বছর ধরে বাড়ছে।

 
২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গেছে।
 
বিদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী বাড়ছে : ২০২৪ সালের ‘ওপেন ডোর্স রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জ’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের তুলনায় ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এতে বাংলাদেশ এক বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পাঠানো দেশের তালিকায় ১৩তম থেকে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে যেখানে শিক্ষার্থী ছিল চার হাজার ৮০২ জন, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৯৯ জনে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যুরো অব এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল অ্যাফেয়ার্স এবং ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন প্রতিবছর এই ‘ওপেন ডোর্স রিপোর্ট’ প্রকাশ করে।
 

 


ইউনেসকোর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের উচ্চশিক্ষার পছন্দের দেশের তালিকায় রেখেছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোকে। যথাক্রমে এসব দেশে পাড়ি জমিয়েছে মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ছয় হাজার ৫৮৬, কানাডায় পাঁচ হাজার ৮৩৫, মালয়েশিয়ায় পাঁচ হাজার ৭১৪ এবং জার্মানিতে পাঁচ হাজার ৪৬ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছেড়েছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় চার হাজার ৯৮৭, জাপানে দুই হাজার ৮২, প্রতিবেশী দেশ ভারতে দুই হাজার ৬০৬, কোরিয়ায় এক হাজার ২০২ এবং এক হাজার ১৯০ জন শিক্ষার্থী সৌদি আরবে উচ্চশিক্ষার জন্য গেছে। এর আগে ২০২২ সালে  উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছাড়ে ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী, যা তার আগের বছর অর্থাত্ ২০২১ সালে ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮ জন। এ ছাড়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছে সুইডেন, ডেনমার্ক, ইতালি, হাঙ্গেরি, লিথুয়ানিয়া, ফিনল্যান্ড, তুরস্ক, কাতার, নরওয়ে এবং এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

বাংলাদেশ এখন ‘রাইজিং স্টার’ : প্রতিবছরই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার যাত্রীর সংখ্যা। তবে এই সংখ্যা প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের তুলনায় এখনো অনেক কম। অন্যদিকে দেশের শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, এটি আপাত অর্থে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু এদের মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর দেশে ফেরত না আসা অথবা দেশে তাদের জন্য ভালো কোনো সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারা ভবিষ্যেক হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

২০২৩ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশটিতে শিক্ষার্থী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘রাইজিং স্টার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘দি আউটলুক ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট মবিলিটি : অ্যামিড আ চেঞ্জিং ম্যাক্রোইকোনমিক ল্যান্ডস্কেপ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে ভর্তি ফি, টিউশন ফিসহ অর্থনৈতিক বিষয়গুলো জড়িত থাকায় যেসব দেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো, সেসব দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রবণতাও বেশি।

বিদেশে পড়তে যেতে হলে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন : বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এইচএসসির পর স্নাতক লেভেলে পড়ার জন্য পাড়ি জমায় তাদের স্বপ্নের দেশে। তবে শিক্ষার্থী যে লেভেলেরই হোক না কেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তার কিছু পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আপনার যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো ভাষাগত দক্ষতা যাচাই করা।

শিক্ষার্থীদের যদি টার্গেট থাকে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা যাওয়া, তাহলে অবশ্যই ইংরেজি দক্ষতা যাচাই পরীক্ষার জন্য ভালো স্কোর অর্জন করতে হবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ইংরেজি দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষার নাম হলো আইইএলটিএস, টোফেল ইত্যাদি।  আমাদের দেশে এখন ইংরেজি দক্ষতা যাচাইয়ের বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় আইইএলটিএস।

কেন বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বিদেশে যায় : গত অক্টোবরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) ২০২৫ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২৫’-এ আছে বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবার তাদের সন্তানদের বিদেশে উচ্চশিক্ষায় পাঠায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশে গবেষণামুখী শিক্ষা, পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা, চাকরির নিশ্চয়তা, রেসিডেন্সি পারমিট পাওয়ার সুযোগ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছুটে চলছে বিদেশে। একসময় শুধু উচ্চবিত্ত শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখিতা থাকলেও এখন মধ্যবিত্তরাও সমান তালে দৌড়াচ্ছে।

যা বলছেন শিক্ষাবিদরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। আমাদের দেশের দু-চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকিগুলো খুবই দুর্বল। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরিই বাণিজ্যিক। অন্যদিকে বিদেশে উন্নতমানের শিক্ষা পাওয়া যায়। অনেকেই নানা ধরনের স্কলারশিপ পায়। অনেকে পড়ালেখা শেষে সেই দেশে স্থায়ীও হয়ে যায়।’