একাত্তরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্র ধরেছিল বিডিআর। গঠনের সময় থেকেই বিডিআর আমাদের দেশের সীমান্ত আর মাটি সযতেœ রক্ষা করেছে। ভারতের রদ্দি মালের চোরাচালান তারা সামালে রাখতে পেরেছে। আমাদের দেশে যারা হানা দিয়েছে, তারা সদুত্তর পেয়েছে। রংপুরের পীরগঞ্জে যে হানাদার বাহিনী আমাদের দেশের অনেক দূর ভেতরে অনুপ্রবেশ করেছিল, তারা প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারেনি।
মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার সময় থেকে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানরাও বিদ্রোহ করে অস্ত্র ধরেছেন। এদের ঘিরেই আমাদের মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। এরা মাঠে-প্রান্তরে, নগরে-জনপদে বীর বিক্রমে লড়াই করেছেন। গায়ে আঁচড় লাগার ভয়ে পালিয়ে ভারতে চলে যাননি। স্বাধীনতা সে জন্যেই এসেছিল। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের জাতীয় সেনাবাহিনী গঠিত হয়। গোড়ায় এ বাহিনী ছিল আদর্শবাদী আর দেশপ্রেমিক। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ মনেপ্রাণে তাদের ভালোবেসেছে।
বর্তমান শাসকেরা সে ইতিহাসকে এখন আর ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলেন না। সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে এসে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। দুঃখের সাথে বলতে হয়, তার আমলে মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমী জাতীয় সেনাবাহিনীকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর মতো একটি রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে পাশাপাশি। জাতীয় সেনাবাহিনীকে ইউনিফর্ম দেয়া যেখানে সম্ভব হচ্ছিল না, সেখানে রক্ষীবাহিনীকে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যানবাহন ও উপকরণ দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীতে সেই যে অসন্তোষের বীজ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, তা বের করে দেয়ার কোনো চেষ্টাই হয়নি। পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশী সৈন্যরা দেশে ফিরে আসার পর রেষারেষির আরেকটি উপাদান যুক্ত হয় তার সাথে। রক্ষীবাহিনীর বেপরোয়া রাজনৈতিক হত্যা, প্রশাসনকে ঘিরে সর্বাত্মক দুর্নীতি, চুয়াত্তরের মন্বন্তর প্রভৃতি স্বাভাবিকভাবেই আদর্শবাদী সেনাবাহিনীকে পীড়িত করেছে। শিশু রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা ভেবে সব কিছু নীরবে হজম করা হয়েছিল; কিন্তু সব সহনশীলতারই একটা সীমা থাকে। সে সীমা অতিক্রম করা হয় যখন মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক লক্ষ্য ও আদর্শ, গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র চালু করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।
এটা অনস্বীকার্য, শেখ মুজিব একটা কাজ সঠিক করেছিলেন। ১৯৭১ সালে ভারতের আশ্রয়ে অসহায় অস্থায়ী ও নির্বাসিত মুজিবনগর সরকার দিল্লির সাথে যে সাত দফা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল, মুজিব সে চুক্তি মানতে রাজি হননি। মুজিবের মৃত্যুর পর খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারও সাত দফা চুক্তি মানতে প্রস্তুত ছিল না; কিন্তু ভারত বাংলাদেশের অস্থিতিশীল অবস্থার সুযোগ নিতে আগ্রহী ছিল। ভারতপন্থী হিসেবে অভিহিত খালেদ মোশাররফকে দিয়ে সম্ভবত সে জন্যই আরেকটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্যদের বিরোধিতার কারণে সে সরকার মাত্র চার দিনের বেশি টিকতে পারেনি। খুব সম্ভবত বিদেশী স্বার্থের তাগিদেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার ষড়যন্ত্র আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত জেনারেল এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল। এরপর সামরিক স্বৈরতন্ত্রের নয় বছরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রধানত বিএনপির নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনে গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি হয়।
চাপিয়ে দেয়া সাত দফা চুক্তি
দুই হাজার ছয় সালের শেষে আপাতদৃষ্টিতেই স্পষ্ট ছিল যে, পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কিছুতেই জয়ী হতে পারবে না। দু’টি প্রভাবশালী পত্রিকা, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদ্বয় এবং সেনাপ্রধান মইন উ আহমদের ষড়যন্ত্রে দু’বছরের বর্ণচোরা সামরিক শাসনের পর এক মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হয়। ভারত এবার আর সুযোগ হারাতে মোটেই রাজি ছিল না। শেখ হাসিনার সাথে গোপন চুক্তি করে তারা যে শুধু সড়ক, রেল, নদী ও বন্দরের পথে করিডোরই আদায় করে নিয়েছে, তা নয়। একাত্তরের সাত দফা চুক্তিটি আবার বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সব ব্যবস্থাই করে নিয়েছে বলে অনেকেরই আশঙ্কা।
শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারের দেড় মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহ ঘটে। উল্লেখ্য, সাত দফা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বাধীন হলে বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না, বিডিআরকে ভেঙে দিয়ে তার স্থলে ‘বিএসএফের তত্ত্বাবধানে’ একটি সীমান্ত রক্ষীবাহিনী গঠন করা হবে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও পরিচালিত হবে দিল্লি থেকে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত বিডিআর বিদ্রোহে ‘এক ঢিলে দুই পাখি’ মেরে ফেলা হলো। প্রথমত, যে বিডিআরকে নিয়ে দেশের মানুষ গৌরব করত, সে বিডিআরকে ভেঙে দেয়া হয়েছে। এরপর বিএসএফের কাছে কার্যত শক্তিহীন একটা বিজিবি বাহিনীও গঠন করা হয়েছে। একই সাথে ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারকে হত্যা করে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেয়ার সূচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও অনেকাংশে কার্যত দিল্লির হাতে চলে গিয়েছে।
বিডিআর বিদ্রোহের পর থেকে অনেক ব্যাপারে অসম্পৃক্ততা ও গোপনীয়তার কারণে জনমনে নানা প্রশ্ন। সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারকে নিয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) গঠন করা হয়েছিল দ্রুত শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপনের মহৎ উদ্দেশ্যে। দুঃখজনক হলো, আওয়ামী লীগ র্যাবকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে যে অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তাতে সেনাবাহিনীরও সুনাম নষ্ট হতে চলেছে। ‘ক্রসফায়ার’ আর ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে আইনবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা মানবাধিকার কর্মীরা ও সংস্থাগুলো করেছে। এশীয় মানবাধিকার কমিশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং নিউ ইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো বিগত সাড়ে পাঁচ বছরে বহুবার র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করেছে।
মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি
আরো দু’একজন কলাম লেখক ও ভাষ্যকারের মতো আমিও লিখেছি যে, র্যাবের নামে এসব দুষ্কর্ম বন্ধ না হলে সেনাবাহিনীর গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেবে। তৈরী পোশাক ও শ্রমিক রফতানির মতো জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশী সেনা ও পুলিশ সদস্য পাঠানো বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রা উপার্জনের একটি বড় উৎস। বিদেশে যদি এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, র্যাবের সদস্যরা সেনাবাহিনীর লোক এবং তারা আবার সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবে, তা হলে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়োগের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে উঠতে পারে। খনার বচনে পড়েছি : ‘ভাণ্ডভরা দুগ্ধ মাঝে বিন্দু পরিমিত/গোমূত্র পড়িলে তাহা হয় বিদূষিত।’ বিগত কয়েক বছরে র্যাবের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক হত্যা, গুম, খুন, ঘুষ গ্রহণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ শোনা গেছে, সেগুলো দূর করার পরিবর্তে সরকারের দিক থেকে যেন এসব ব্যাপারে উৎসাহই দেয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ট্র্যাজেডি থেকে দেখা যাচ্ছে, র্যাবের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত কিছু লোক এখন ‘হায়ার্ড কিলারের‘ স্তরে নেমে গেছে। এরা আবার বাহিনীতে ফিরে গেলে সেনাবাহিনীর ইমেজ মারাত্মকভাবে ুণœ হবে। তা ছাড়া দুর্নীতি আর দুষ্কর্ম সংক্রমিত হতে বাধ্য।
বাংলাদেশের চিন্তাশীল সজ্জনদের প্রায় সবাই র্যাব ভেঙে দেয়ার দাবি তুলেছেন। যে প্রতিষ্ঠানে এমন ব্যাপক ও মারাত্মক দুষ্কৃতি ধরা পড়ে গেছে, সে প্রতিষ্ঠানকে সংশোধন করার সুযোগ নেই বলে অনেকে মনে করেন। বর্তমান সরকারকে নিয়ে সমস্যা এই যে, স্তাবকের দল ছাড়া আর কারো পরামর্শ তারা শুনতে চান না। সুপরামর্শগুলো কার্যকর করার পরিবর্তে সরকার অনেক ক্ষেত্রে পরামর্শদাতাদের উল্টো গালিগালাজ করেছে। সর্বশেষ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র্যাব ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছে। দেখা যাচ্ছে যে, হিত কথা এ সরকারের মন্ত্রীদের কানে যেন বিষ ঢালে। ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার’ ধুয়া তুলে কোনো কোনো মন্ত্রী যেন শাসাচ্ছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে। আগেই বলেছি, এই প্রতিষ্ঠানটি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো বিশ্বব্যাপী সম্মানিত ও প্রভাবশালী একটি সংস্থা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অনেকটা উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে বলেও শুনেছি।
মণ্ডাও খাবো, হাতও কামড়াব
বিশ্বের প্রায় সব উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রও আওয়ামী লীগ সরকারের গণতন্ত্র-নির্যাতনের সমালোচনা করে সংলাপের মাধ্যমে এবং সমঝোতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়েছে। তার আগে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড: মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকারকে তাদের উন্মাদনীতি থেকে নিবৃত্ত করার আশায় সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (এবং খুব সম্ভবত পরবর্তী প্রেসিডেন্ট) হিলারি কিন্টন ঢাকা পর্যন্ত এসেছিলেন; কিন্তু অনেক ব্যাপারে এই সরকার পরামর্শ শোনার পরিবর্তে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তিকে অপমানই করেছে। ইংরেজি প্রবাদ হচ্ছে ‘যে হাত খেতে দেয়, সে হাত কামড়াতে নেই।’ বর্তমান সরকার ঠিক সে ব্যাপারটাই করে চলেছে; কিন্তু ওয়াশিংটনের কাছে ভিক্ষার জন্য হাত পাততে কোনো লজ্জা হয় না। বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ ভিক্ষা করতে বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াশিংটন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মনে হচ্ছে, এই সরকার সম্পর্কে মার্কিন সরকার এখন দৃঢ় মনোভাব নিতে যাচ্ছে। মন্ত্রীকে শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়েছে।
এ রকম অবস্থায় পড়লে এবং কারো কাছ থেকে কিছু পেতে হলে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ আচরণে সংযমী হয় এবং কথা ও কাজে সাবধান হওয়ার চেষ্টা করে; কিন্তু মন্ত্রীদের বেশির ভাগই কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কি না সন্দেহের কারণ আছে। ষাট ও সত্তরের দশকে ব্রিটিশ লেবার পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা ও অর্থমন্ত্রী ডেনিস হিলি হালকা ওজনের একজন টোরি এমপির অন্যায্য সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, ‘এ লোকটার সমালোচনা শোনা মৃত ভেড়ার আক্রমণে বিধ্বস্ত হওয়ার শামিল।’ বাংলাদেশেও সেরকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বহুবার বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য কিংবা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরামর্শ। সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী বহুবার গায়ে জ্বালা ধরানোর মতো কদর্য ভাষায় তার সমালোচনা করেছেন। নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছেন মার্সিয়া বার্নিকাট। তিনিও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন।
মৃত মেষের আক্রমণ
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সে মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়েছেন। নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তিনি হুমকির ভাষায় বলেছেন : হিসাব করে কথা বলবেন। তিনি যদি ভেবে থাকেন তার হুমকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব নীতি পরিবর্তন করবে অথবা তাদের রাষ্ট্রদূত ৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনের সমালোচনা বন্ধ করবেন, তা হলে এসব হুমকিকে মৃত মেষের আক্রমণের সাথে তুলনা না করে উপায় কী? সরকারের মন্ত্রীরা এক নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও তার রাষ্ট্রদূতদের হুমকি দিচ্ছেন, অপমান করছেন; জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তাদের, এমনকি মহাসচিবের বহু অনুরোধকে পাত্তা দেননি; এমতাবস্থায় মার্কিন সরকারের কাছ থেকে জিএসপি সুবিধা আদায়ের আশা কি করে করা যায়?
কেউ যদি র্যাবে গিয়ে দুর্নীতি করছে, কনট্রাক্ট কিলিং করছে, আর সে কারণে জাতিসঙ্ঘ যদি শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ করে দেয়, তাহলে দোষ কাকে দেবো বুঝতে অসুবিধা হবে না। এই সরকারের ইসলামবিরোধী ও ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতির দরুন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর সব দেশ থেকে রেমিট্যান্স পড়ে গেছে এবং যাচ্ছে। তৈরী পোশাক রফতানির অবস্থা আমাদের এককালের পাট শিল্পের মতো হতে চলেছে। স্বাধীনতার সময় থেকে বাংলাদেশের এমন বন্ধুবিহীন অবস্থা আগে আর কখনো হয়নি।
অথচ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, ৫ জানুয়ারির তামাশাকে এবং এই সরকারকে ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ বৈধ হিসেবে স্বীকার করছে না বলে সরকার বেসামাল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকেই এখন অন্য সব রাষ্ট্রের সাথে লেনদেন করে চলতে হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ব্যাপারেও বিদেশীরা সে মনোভাবই নিয়েছেন। তারা সে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য কিংবা এ সরকারকে বৈধ মনে করছেন না। তবু যারা গদি দখল করে আছে, তাদের সাথেই লেনদেন করতে হয়। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক শত্রুভাবাপন্ন ছিল। যেকোনো সময় দু’পক্ষের মধ্যে আরেকটি মহাযুদ্ধ বেধে যাওয়াও বিচিত্র ছিল না; কিন্তু মস্কোর সাথে পশ্চিমা পক্ষের কিছু কিছু লেনদেন অবশ্যই হয়েছে। সরকার গোড়ায় এই বাস্তবতাকেই তাদের বৈধতা বলে দেখানোর অনেক চেষ্টা করেছে, অনেক ঢাকঢোল পিটিয়েছে; কিন্তু প্রকৃত সত্যটা এখন সাধারণ মানুষও বুঝে গেছে। অথচ সরকার গদি ছাড়তে রাজি নয়। বৈধতার স্বীকৃতি সংগ্রহের জন্য সরকারের কাঙালপনা সে জন্যই বেড়ে গেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ ঘটেছে এ পটভূমিতেই।
কাঙালপনার আতিশয্য
নারীশিশুদের খৎনা আফ্রিকার বড় একটা সমস্যা। বহু আফিক্রান অভিবাসী এসেছেন ব্রিটেনে। প্রায় দেখা যাচ্ছে তারা নারীশিশুদের আফ্রিকায় নিয়ে খৎনা করিয়ে আনছেন। দু-একটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আফ্রিকা থেকে খৎনাকারী এনে লন্ডনেও খৎনা করানো হয়েছে। স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয়ায় সমস্যাটা কর্তৃপক্ষের গোচরে এসেছে। সে কারণেই এবার সম্মেলনের আয়োজন করেছে ব্রিটিশ সরকার। আর এ জাতীয় সম্মেলনের আমন্ত্রণ যায় প্রধানমন্ত্রীর নামে। লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী সশরীরে এ সম্মেলনে আসেননি। এমনকি কোনো আফ্রিকান দেশের প্রধানমন্ত্রীও নন। এখন স্পষ্ট, যেকোনো মূল্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে করমর্দনের একটি আলোকচিত্র প্রয়োজন ছিল, যাতে সে সাক্ষাৎ ও আলোকচিত্রকে নিজেদের বৈধতা বলে জাহির করা যায়।
এ-জাতীয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কতগুলো কূটনৈতিক প্রোটোকল থাকে। দুই সরকারপ্রধান গোপনে মতবিনিময় করে থাকেন। সেসব আলোচনার বিষয়বস্তু গোপন রাখতে হয়। বৈঠকের বিবরণ দিয়ে কোনো ইশতেহারও প্রচার করার নিয়ম নেই; কিন্তু বৈঠক যখন একটা হয়েছে, তখন ফায়দা উঠানোর লোভ বাংলাদেশ সরকার ছাড়তে পারেনি। কারণটাও অবশ্যই স্বীকৃতি ও বৈধতা পাওয়ার জন্য আকুলতা। শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে এক ডজন অনারারি ডক্টরেট এনেছিলেন। দ্বিতীয় দফায় নোবেল পুরস্কার আনার জন্য তাগিদ দেয়া হচ্ছিল কূটনীতিকদের। অভিজ্ঞ কূটনীতিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ক্যামেরন-হাসিনা বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্যামেরন বলেছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পেছনের ব্যাপার (অর্থাৎ সেটা এখন ভুলে যাওয়া উচিত)। আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে। যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশ সরকারের সাথে একযোগে কাজ করবে (লেনদেন বজায় রাখবে)।’
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় Ñ এই কূটনৈতিক উক্তিটির অর্থ এই নয় যে, ডেভিড ক্যামরনের সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে বৈধ মনে করছে, অথবা এ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতা রাখতে চায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অসত্য দাবিতে ব্রিটিশ সরকার বাহ্যতই বিব্রত ও বিরক্ত হয়েছে। প্রোটোকল ভঙ্গ করে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও সরকারি বাসভবন) প্রবক্তা প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেছেন আর জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে এমন একটা মুক্ত সমাজ ও রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রয়োজন, যাতে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ এবং মিডিয়ার স্বাধীনতাকে সম্মান দেখানো হয়।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক ভাষা বুঝতে পারেননি, নয়তো ভিত্তিহীন কথা বলেছেন।
মুষিকের পর্বত হওয়ার বাসনা
প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই সরকার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবেন? প্রধানমন্ত্রীর সাথে আবার সাক্ষাতের প্রশ্ন উঠলে ডেভিড ক্যামেরনের ভ্রƒ কি কুঞ্চিত হবে না? বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা খুবই বিজ্ঞ এবং অতি চালাক মনে করেন নিজেদের। এই ‘চালাকি’ যে অন্যদের প্রভাবিত করার পরিবর্তে বিব্রত, বিরক্ত এবং অসন্তুষ্টই করে, লন্ডনের এই সফর কি সেটাই প্রমাণ করে না? আমার কিন্তু প্রায়ই মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী যদি মুখ বেশি না খোলেন তাহলে তাকে বুদ্ধিমতী ও বিজ্ঞ বলে মনে হবে। তিনি যদি বিশ্বময় চষে না বেড়াতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশের বন্ধুর সংখ্যা অনেক বেশি থাকত।
এ প্রবন্ধে গোড়া থেকে একটা কথাই বলার চেষ্টা হয়েছে। সেটা হলো, যে অনুগ্রহপ্রত্যাশী তাকে বিনয়ী না হলেও ভদ্র ও সংযত ভাষায় কথা বলা শিখতে হয়। আরব বিশ্ব, বিশ্বব্যাংক, এক নম্বর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রফতানি বাজার ইওরোপীয় ইউনিয়ন এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীÑ মোট কথা কাকে না অপমান করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা?
বর্তমান গাজা যুদ্ধের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের অনুরোধেও বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু গণহত্যা বন্ধ করছেন না। ইহুদি জাতি যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপসহ বিশ্বের অর্থনীতি (অতএব রাজনীতি ও মিডিয়াকে) গ্রাস করে ফেলেছে। মার্কিন রাজনীতি পুরোপুরি ইসরাইলি লবিগুলোর নিয়ন্ত্রণে। তেল আবিবকে বেশি চটালে প্রেসিডেন্ট ওবামার বাজেট কিংবা কোনো আইন পাস হবে না। সুতরাং ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ ইসরাইলের হতেই পারে। জার্মানি কিংবা পশ্চিম ইউরোপের কোনো দেশ যদি ইসরাইলকে বেশি চটায়, তাহলে হিটলারের ইহুদি নিধনের পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে গোটা বিশ্বের ইহুদি প্রভাবিত মিডিয়া কাঁদুনি শুরু করে দেবে।
লক্ষণীয় যে, ইসরাইল প্রচারকৌশল শিখেছে হিটলার আর গোয়েবলসের কাছ থেকে। তারা জাতিসঙ্ঘের নির্দেশ এবং আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ফিলিস্তিনের আরব ভূমি দখল করে নিচ্ছে, তাদের খামার পুড়িয়ে দিয়ে সেখানে শহর গড়ছে, অবলীলায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। গত তিন সপ্তাহে তারা এক হাজার ২০০-এরও বেশি গাজাবাসীকে হত্যা করেছে। ইসরাইলি বিমান হামলায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছিল জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল ও মসজিদে। ইসরাইল বিমানবাহিনী এখন এসব আশ্রয়কেন্দ্রের ওপরেই বোমা ফেলছে, শেল বর্ষণ করছে; কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তারা প্রচার চালাচ্ছে যে, হামাসের গণহত্যা বন্ধ করতেই তারা গাজা আক্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। ইসরাইলি বোমায় নয়, হামাসের রকেট ফেটেই শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে।
গত দু-তিন বছরে বাংলাদেশেও এই প্রচারকৌশলই অবলম্বন করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগের, যুবলীগের ক্যাডাররা মানুষ খুন করছে। গডফাদাররা সারা দেশে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, এখন আবার তারা র্যাব-পুলিশ ভাড়া করেও হত্যালীলা চালাচ্ছে। তার সাথে মিলিয়ে দেখুন। মন্ত্রীরা গলাবাজি করে চলেছেন যে, বিএনপি দেশে গণহত্যা চালাচ্ছে; কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করছে সে কথা? একমাত্র ভারত ছাড়া? আর কোথাও কি এ সরকারের বন্ধু অবশিষ্ট আছে?
লন্ডন, ৩০.০৭.১৪
বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন