বাংলাদেশে এবং বাংলা ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জগৎ খুবই সংকীর্ণ। এ মন্তব্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ইতিহাসে যারা যথাসাধ্য অবদান রেখেছেন তাদের হেয় করার জন্য নয়। বাংলা ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা ভাবুকতার বিকাশ মানে সবার আগে ভাষার বিকাশ। স্বল্প জীবদ্দশায় বাংলা ভাষায় যারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভেবেছেন ও লিখেছেন আমরা তাদেরই উত্তরসূরি। বাংলা ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিকাশ যদি আমরা ঘটাতে চাই তাহলে সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে ভাষার বিকাশ ঘটাতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসের রেশ কাটার আগে কথাটা জোর দিয়ে বলার জন্য আজকের লেখা।
সংকীর্ণতার জন্য আক্ষেপ করছি। চিন্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান জগতে নিজ ভাষায় আমাদের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। তাতেও আক্ষেপ করব না। বাংলা ভাষার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলা গদ্যের জন্ম ইংরেজ ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের দ্বারা। ‘মাতৃভাষা’ হিসেবে যে ভাষায় সাধারণ মানুষ নিত্যদিন কথা বলে ও ভাবে সেই ভাষার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের ওপর বাংলাসাহিত্যের ভাষা দাঁড়ায়নি। সংস্কৃত ও তৎসম শব্দের মেদ যেমন তাকে বইতে হচ্ছে, তেমনি ইংরেজের চিন্তাচেতনার রক্তও বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এটা ঐতিহাসিক কারণে ঘটেছে, একে সার্জারি করে বদলানোর সুবিধা নাই। এ পরিস্থিতি ঐতিহাসিকভাবেই অতিক্রম করে যেতে হবে।
আক্ষেপ করছি এখন এবং ভবিষ্যতে নিজেদের কর্তব্য বুঝে নেয়ার দরকারে। তো সংকীর্ণতা প্রথমত এ অর্থে যে, আমরা নিজেদের নিত্যদিনের চিন্তাভাবনার সঙ্গে সাহিত্যের ভাষার দূরত্ব আজও ঘোচাতে পারিনি। ফলে বাংলা ভাষায় চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ রুদ্ধ থাকার শর্ত জারি রয়েছে। আজকাল অনেক তরুণকেই বলতে ও লিখতে দেখছি যে, আধুনিক সাহিত্যের ভাষা বা ‘প্রমিত ভাষা’ নামক সরকারি ভাষা আমার ‘মাতৃভাষা’ নয়। অভিযোগ গুরুতর। নোয়াখালী, চিটাগাং, সিলেট, ঢাকাইয়া ভাষা ইত্যাদি কি মাতৃভাষা নয়? অর্থাৎ ঘরে ও সমাজে এ ভাষায় কি আমরা কথা বলি না? সরকারি ভাষার প্রয়োজন আছে, মানলাম; কিন্তু মাতৃভাষাকে ‘লোকাল ডায়ালেক্ট’ গণ্য করে সাহিত্যের ভাষায় তার অধিকার অস্বীকার সে ফ জবরদস্তি। এটা মানা যেমন কঠিন, বলবৎ করাও কঠিন।
‘রাষ্ট্রভাষা’ বা সরকারি ভাষা তো আর মাতৃভাষা নয়। সরকারি ভাষার দরকার আছে; কিন্তু দরকারের অজুহাতে ভাষার স্বতঃস্ফূর্ত কায়কারবার অস্বীকার করা ভয়ানক বিপদের। ‘প্রমিত ভাষা’ আর ‘মাতৃভাষা’র মধ্যে আমরা গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছি। সেই জট হয়তো আপনাআপনি খুলত; কিন্তু এখন দুই পক্ষে ভাগ হয়ে আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। মাতৃভাষার বিকাশ যেমন সরকারি ভাষার বিকাশ না, তেমনি সরকারি ভাষার বিকাশ মানে মাতৃভাষায় চিন্তা করার শক্তি অর্জন নয়। অন্যদিকে আইন করে ভাষার ‘বিকৃতি’ ঠেকানো, অর্থাৎ সরকারি বা প্রমিত ভাষায় সবাইকে লেখালেখি করতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে আদালত আর পুলিশগিরির তর্কটা আর সামাজিক তর্ক থাকেনি। প্রমিত ভাষাওয়ালাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য উৎসাহী লোকের অভাব নাই।
এ তো গেল ভাষা নিয়ে গোলমাল। বাংলা ভাষায় বিদ্যাচর্চা কিংবা আদালতের ভাষা হিসেবে ব্যবহার তো অনেক দূরের ব্যাপার। সাংবিধানিকভাবে অসিদ্ধ জেনেও উচ্চ আদালত বাংলা প্রচলন করতে পারেননি। বিচারকরা কি সংবিধানবিরোধী কাজ করতে পারেন? জ্বি পারেন। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রে দেখি যে তারা খুবই পারেন এবং করছেনও বটে।
এগুলো খুবই প্রাথমিক দিক। এরপর আসে বাংলা ভাষায় বিদ্যাচর্চা; হোক তা ভাব বা দর্শন, কিংবা বিজ্ঞান। বাংলা ভাষায় বিদ্যাচর্চার কোনো শৃংখলাই আমরা আনতে পারিনি। বৈজ্ঞানিক বলি কিংবা নীতিবিদ্যা ও দর্শন বলি- বিদ্যাজগতের কোনো ভূগোলেই বাংলা ভাষা বিদ্যাচর্চার কোনো শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারেনি। এটা অবশ্য আমার আক্ষেপের কারণ নয়, বাংলা ভাষা বিদ্যার সব ভূগোলে পদচারণার শক্তি অর্জন করুক সেটা আমি আশা করি বটে; কিন্তু কাজটা কঠিন সে বিষয়ে আমার সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু আক্ষেপ হচ্ছে এ কাজটির গুরুত্ব আমরা উপেক্ষা করছি। এটা বাংলাভাষী- বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলাসহ বাংলা ভাষায় কথা বলে লেখালেখি করে এমন যে যেখানে আছে- সবার জন্যই আত্মঘাতী হতে পারে।
বাংলা ভাষায় বিপ্লব ঘটেছে, আমরা আত্মস্থ করিনি
প্রত্যক্ষ জগতকে জানা এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনাকে সুবিন্যস্ত করা, যা জেনেছি তার শ্রেণীকরণ ও তাদের অন্তর্নিহিত শৃংখলা আবিষ্কার কঠিন কিছু নয়। নিজ ভাষাতেই সেটা করা যায়। বিজ্ঞান তো এভাবেই গড়ে উঠেছে। তাহলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অসুবিধা কী? কোনোই অসুবিধা নাই। ইচ্ছা ও সংকল্পের অভাব আছে বৈকি। চিন্তার বিকাশের দিক থেকে বিচার করা যাক। বিভিন্ন বিদ্যাকলা বাংলা ভাষায় চর্চা করার আগে ভাষার বিকাশ ও ধারণ ক্ষমতার কথা ওঠে। সেটা শুধু প্রত্যক্ষকে বর্ণনার মধ্য দিয়ে ঘটে না। বুদ্ধিকে তার নিজের অনুমান, বর্গ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাকরণ পর্যালোচনার প্রশ্ন আসে। সেদিক থেকে দেখলে ভাষার বিকাশের জন্য বাংলা ভাষায় ভাব বা দর্শন চর্চার কথা আসে।
সামগ্রিকভাবে বিদ্যাচর্চার দিক থেকে বিচার করলে ভাষার বিকাশের প্রথম লক্ষণ ভাব বা দর্শন চর্চার মধ্যেই পরিস্ফূট হয়। এর কারণ হচ্ছে ধর্ম যেসব পরমার্থিক বিষয় নিয়ে কারবার করে, দর্শনের বিষয়ও তাই। সহজে বোঝার জন্য যাকে অনেক সময় পরাবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স বলে থাকি। সেটা কিন্তু বাংলা ভাষায় হয়েছে। তবে সেটা আধুনিকদের ভাষায় না, ঘটেছে বাংলার ভক্তি ও ভাবের নানান বাঁকের ও মোড়ের বিভিন্ন আন্দোলনে। এই ফাল্গ–নে সামনে আসছে ছেঁউড়িয়ায় গৌর পূর্ণিমা; আসছে নদিয়ার ফকিরদের সাধুসঙ্গ। ফকির লালন শাহ তা প্রবর্তন করে গিয়েছিলেন। সেখানে ভাষার, ভাবের ও দর্শনের একটা দুর্দান্ত বিপ্লব ঘটে গিয়েছে, যার প্রায় সবটাই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাইরে। মধ্যবিত্তের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের ওপর দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং তাদের নজরের বাইরে থেকে গিয়েছে।
মধ্যবিত্ত লালনের গান শোনে, কিন্তু তার ভাষা বোঝে না। জ্ঞানচর্চার এই জগতের সঙ্গে তাদের কোনো ধারণা নাই বললেই চলে। তারা ফকির-ফ্যাকড়াদের সাদা বা আউলা ঝাউলা পোশাক পরা গাঁজা খেয়ে ঘুরে বেড়ানো ভিক্ষুক ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। এরা পল্লীগীতি গায়, তাই তারা গীতিকার। বুঝতে পারে তারা কিছু একটা সাধনাও করে বটে। তবে সেটা কীসের সাধনা? ওয়েল, ‘গুহ্য’ সাধন। সার কথা, মেয়ে মানুষ নিয়ে গুপ্ত কারবার। তারা এদের নাম দিয়েছে ‘বাউল’। মধ্যবিত্তদের লেখা পড়লে আপনি এসবই পাবেন। পশ্চিম বাংলা অবশ্য আরও কয়েক কাঠি সরেস। ওদের বুঝতে হলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনের মানুষ কিংবা একই নামে গৌতম ঘোষের বানানো সিনেমাটি দেখুন।
অবশ্য পশ্চিম বাংলাকে হিসাবে না রাখলেও চলে। কারণ সেখানকার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর ধারণা, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদির বাইরে বাংলা ভাষায় অবিস্মরণীয় কিছু নাই, ঘটেনি কিংবা ভবিষ্যতেও ঘটবে না। বাংলা ভাষা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের লড়াই এবং বিশ্বসভায় নিজের ভাষা নিয়ে সদর্পে দাঁড়ানোর মতো জিহাদ তাদের নাই বললেই চলে। সেই সংকল্প তারা বহু আগেই ত্যাগ করেছে। এতে বাংলা ভাষার ক্ষতি হবে, কিন্তু সেটা সাময়িক। ঢাকা তার তেজ অক্ষুন্ন রাখলে বাংলা ভাষা বিশ্বভাষা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।
তাহলে ভাবচর্চা বা দর্শনের দিক থেকে বাংলা ভাষার যে বিকাশ ঘটেছে, তাকে আমরা দৃশ্যমান দেখি না কেন? এর কারণ শ্রেণী। কলোনিয়াল শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণী সাদা সাহেবদের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির পরাধীনতা বিনাবিচারে মেনে নেয়ার কারণে নিন্মবর্গের মানুষের অর্জনগুলোকে আমরা চিহ্নিত ও সার্বজনীন করে তুলতে পারছি না। এর জন্য শিক্ষাব্যবস্থা সরাসরি দায়ী। আমার অনুমান, এই বাধাগুলোও কেটে যাবে। এর মধ্য দিয়েই আধুনিক বিজ্ঞানের পর্যালোচনা করতে হবে।
কবিতা ও নাটকের ভাষা
জীবিত ভাষার মধ্যে সবসময়ই নানান ভাঙাগড়া চলে। কাব্য বা কবিতা প্রথাগত লেখালেখি বা তথাকথিত ‘প্রমিত’ ভাষার খুঁটিবর্গাকে নড়বড় করে দিয়ে সমাজে নতুনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ায়। ষাট দশকে আমার কবি বন্ধুদের মধ্যে প্রধান শ্লোগান ছিল, ‘প্রথম বিপ্লবের খুন বেরুবে ভাষা থেকে’। কীভাবে সেই খুনোখুনি করতে হবে সে বিষয়ে আমাদের কোনো ম্যানুয়েল ছিল না। আমরা যে যার মতো করে সেটা করেছি। আমাদের কবিতার মধ্যে তার চিহ্ন আছে। আমাদের অনুজদের অনেকে যখন তাদের মুখের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা বলে সাহিত্যচর্চায় টেনে আনল, তখন এ ঘটনার বৈপ্লবিক সম্ভাবনা সম্পর্কে উৎসাহ ছিল আমার। এটা তাদের অনেকে আশা করি স্বীকার করবেন। তবে তারা তাদের নিজেদের কাজের দার্শনিক বা রাজনৈতিক মর্ম ধরতে পারেননি। এখন মনে হয় একটা সম্ভাবনা মাঠে মারা গেল। এদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই আমরা পাইনি। এটা নিছকই ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়। তাদের লেখালেখি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপ-আলোচনায় মনে হয়েছে, তরুণ কবিদের একটা জেনারেশন ‘দর্শন’ বলতে বুঝেছে কোনো কবিতা বা সাহিত্যকে কোনো একটি মতাদর্শ প্রচারের কাজে ব্যবহার করা। কবিতায় সেটা পরিহার করতে হবে। এগুলো অবশ্য পুরনো ও প্রাচীন কথা, জীবনানন্দ বলে গিয়েছিলেন অনেক আগে। সেটা ঠিক আছে। দর্শন বা মতাদর্শ প্রচার কবিতার কাজ নয়। কবিতার নতুন চিন্তা বা ভাবের আবির্ভাব ঘটার শর্তগুলো সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে উৎপাদিত হয়। সেটা কবিতা লিখেই হয়। দর্শনের বই লিখে বা দর্শনে চৌতিসা লিখে করে না। তদুপরি তারা হয়তো বুঝতে সক্ষম নন যে ‘জ্ঞানচৌতিসা’ (সৈয়দ সুলতান) কবিতার বই, তারপর একইভাবে দর্শন।
‘খণ্ডিলে খণ্ডন নাহি সেই অখণ্ডন
খণ্ড খণ্ড হয়ে আছে তেঁই সে কারণ’
শব্দের মূর্ছনা ও অনুপ্রাসের মধ্য দিয়ে যে অখণ্ড বা ‘এক’ নিয়ে এই কাব্য, তা বুঝতে হলে সৈয়দ সুলতানের সময়কালে বাংলা ভাষায় ভাবচর্চার ইতিহাসটুকু জানা দরকার। সেই ইতিহাস আমরা লিখিনি। এ বিষয়ে এখানে লেখার অবসর হবে না। তবে কবিরা ইতিহাসের মুখাপেক্ষী নয়, ইতিহাস জানে না বলে তাদের দোষ দেব না। কিন্তু সৈয়দ সুলতান কাব্য নিয়ে কী কারবার করেছেন সেটা বোঝা জরুরি। বাংলাদেশের তরুণরা সৈয়দ সুলতানের নাম শুনেছে বটে, কিন্তু তিনি তো সে ফ ‘পুঁথিকার’, আধুনিক কেউ নন। ফলে তারা সেই ডিমেই খামাখা তা দিয়ে চলেছে যেখান থেকে বাচ্চা বেরুবে না : কবিতায় কোনো দর্শন বা চিন্তা থাকবে না। তাদের অনেককে এই দাবি করতে শুনেছি।
হতে পারে ইসলামী পুঁথি বলে তারা মুসলমান ভাবুক/কবিদের লেখা পড়েন না। কিন্তু কৃষ্ণদাস কবিরাজও তরুণদের আকৃষ্ট করে না। কাব্যিক নিরীক্ষা হিসেবে এই চৈতন্যচরিতামৃতের তাৎপর্য হচ্ছে, এটি একই সঙ্গে জীবনী ও দর্শন। শ্রীচৈতন্যের জীবনদর্শন হিসেবে বোঝা এবং তাকে কাব্যের বিষয়ে পরিণত করার সাহস ছিল কৃষ্ণদাস কবিরাজের। দুর্দান্ত সাহস ও যুগপৎ কাব্য ও দর্শনের ওপর দখল না থাকলে এ ধরনের কবিতা লেখা অসম্ভব। ফলে তরুণরা ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে বটে; তবে তারা আটকে আছে এমন কিছু ধারণার মধ্যে যা নতুন কিছু নয়। একে চালাতে হলে তার গায়ে ‘আধুনিক’ ট্যাগ মারতে হয়। ভাষা নিয়ে কবিতার নামে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তখন ইয়ার্কি-ফাজলামিতে পর্যবসিত হয়। একেই তারা কবিতা বলে চালাতে চায়। এতে পিঠ চাপড়াচাপড়ি চলে; কিন্তু কোনো অর্জন হয় না।
সমাজে নতুন বৈপ্লবিক চিন্তার আবির্ভাব শুরুতে ভাষার ভাঙনের মধ্য দিয়েই ঘটে, এবং ধীরে ধীরে তা সমাজের মানুষের ভাষায় ও ভাবনায় কখনও সজ্ঞানে কখনও অজ্ঞানে সঞ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু সেটা যদি সে ফ ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী ভাঙ্গাভাঙ্গি হয়, তখন সেটা সমাজে প্রমিত বনাম মুখের ভাষার তর্ক অবধি পৌঁছায়। এর বাইরে কিছু নয়। প্রমিত ভাষা ভেঙ্গে মুখের ভাষায় বড় কোনো সাহিত্যকর্ম ঘটে যেত, আমাদের খামাখা তর্ক করতে হতো না। ব্রাত্য রাইসু এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে, যার প্রতিভাকে আমি সবসময়ই স্বীকার করে এসেছি। তবে ভাষা নিয়ে তার কাজের গুরুত্বকে সে নিজেই মর্যাদা দেয়নি। কাজটির গুরুত্ব যদি সে কিংবা তার অনুসারীরা বুঝত তাহলে তাকে কুতর্কের দোকান খুলে ক্ষমতার অপচয় করতে হতো না। নিজের প্রতিভাকে নিছকই ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারের অধিকার ছাড়া অধিক কিছু ভাবতে না পারা চিন্তার ভয়ানক সীমাবদ্ধতা।
প্রথম বিপ্লবের খুন বেরুবে ভাষা থেকে- এই শ্লোগানের পেছনে সেলিম আল দীনের যথেষ্ট প্রণোদনা ছিল। সেলিম মনে করত সে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ব্যর্থ। হতাশায় সে আত্মহত্যা করারও পরিকল্পনা করেছিল। শুনে আমি ঢাকা থেকে করটিয়া কলেজে ছুটে গিয়েছিলাম। তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম, কবিতাই সাহিত্যের একমাত্র ক্ষেত্র নয়। ভাষা নিয়ে কাজ করার আরও বিস্তর ক্ষেত্র আছে। তার মধ্যে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে নাটক। যদিও সেখানে ভাষা গৌণ; কিন্তু ভাষাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি আনার ও ব্যবহারের সুবিধা যেমন রয়েছে তেমনি প্রমিত ভাষাওয়ালাদের খামাখা চেঁচামেচি থেকে দূরে থাকারও আরাম আছে। নাটকে প্রমিত ভাষার বাইরে সচল ও জীবন্ত মুখের ভাষা ব্যবহার সহজ। প্রমিত ভাষাওয়ালারা মনে করেন, এটা তো নাটক, তাই অসুবিধা নাই।
আমার ধারণা, আমি সেলিমকে তার নিজের প্রতিভা সম্পর্কে বোঝাতে পেরেছিলাম। সেলিম নাট্যকার হিসেবে কেমন সেটা সমালোচকরা বলবেন। তবে ভাষা থেকে খুন বের করার সাধনায় সেলিম নাটকে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, সন্দেহ নাই। তার সবচেয়ে মজার কাজ হচ্ছে ‘চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি’। সেটা ছিল রাস্তায় পারফরমেন্সের জন্য লেখা, মহিলা সমিতি মঞ্চের জন্য নয়। কিন্তু সেলিম রাস্তা ছেড়ে মঞ্চে যাওয়ার পর তার নাটক মূলত হয়ে উঠেছিল নাসিরুদ্দিন ইউসুফের মঞ্চ পরিবেশনা। সে এক আলাদা ইতিহাস। ওর প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন