আমাদের অবস্থা সর্বদাই স্বতন্ত্র
12 November 2020, Thursday
উন্নতির অবিরাম চেষ্টা চলছে। কিন্তু উন্নতি কতটা ঘটছে? সে উন্নতির চরিত্রটাই বা কী?
উচ্চশিক্ষার উন্নতির জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এক হাজার ৭০০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। টাকাটা বসে থাকেনি, খরচ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, সরকার ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সম্মিলিত তত্ত্বাবধানে সাফল্যের সঙ্গেই টাকা খরচ হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত উন্নয়নের কাজ সমানে চলেছে। উন্নয়ন নিশ্চয়ই ঘটেছে; সব খবর আমরা রাখি না। এর ফলে ধরা যাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংক কতটা উঠল? ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংক ছিল ৬০১; উন্নয়ন তৎপরতার পরিসমাপ্তিতে ২০২০ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ৮০১। অর্থাৎ ২০০ ধাপ নেমে গেছে।
উন্নতির জোয়ার কোন গতিতে ছোটাছুটি করছে তার আভাস বহুভাবেই ধরা দিচ্ছে। বিদ্যুৎ ও পানির দামে উন্নতি তো অপ্রতিরোধ্য। বিপর্যয় আমাদের সহ্য হয়ে যাবে। মানুষের সহ্যক্ষমতা তো অপরিসীম।
ধরা যাক, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ। সচিবরা এখন থেকে বিনা মূল্যে মাসে ২৫০ লিটার অকটেন পাবেন। আগে পেতেন ১৮০ লিটার। গত বছর উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের অকটেন বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৫০ লিটার করা হয়েছে। তা মফস্বলে থেকে প্রশাসনের কর্তারা ২৫০ করে পাবেন, আর খোদ রাজধানী প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে আসীন হয়ে সচিবরা পাবেন তাঁদের চেয়ে কম? এ কেমন ন্যায়বিচার? এই অন্যায় বিধি বদলানো হয়েছে। এখন থেকে সচিবরা বেশি না হলেও অন্তত সমান সমান পাবেন। উপজেলার অফিসারদের যুক্তি ছিল, গাড়ি নিয়ে তাঁদের সর্বদাই এখানে-সেখানে ছোটাছুটি করতে হয়, বরাদ্দ তেলে কুলায় না, বৃদ্ধি প্রয়োজন। সচিবদের যুক্তিও কম জোরালো নয়। তাঁদের তেল তো বিশেষভাবেই খরচ হয়ে যায় ছোটাছুটি না করতে পারায়। ট্রাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে থাকেন; তেল পোড়ে। খবরে প্রকাশ, ৫০ হাজার গাড়িবঞ্চিত অন্য কর্মকর্তারাও ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেছেন এবং তার জন্য রাজকোষের ব্যয় হবে মাত্র ১৬ হাজার কোটি টাকা। তাহলে? হ্যাঁ, উন্নতি ঘটানো হয়েছে। খেলাপি ঋণের বেলায়ও উন্নতি অব্যাহত রয়েছে।
আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাটায় সরকারি কর্মচারীদের ক্ষমতার ক্ষেত্রেও উন্নতি দেখা যাচ্ছে। যেমন ডিসিরা জেলা প্রশাসক হয়ে গেছেন। জেলার প্রশাসক তো হওয়ার কথা নির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। সেটা এখন সম্ভব নয়, সে রকমের অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন বাংলাদেশে কায়েম হয়নি। শাসন কর্তৃত্ব যে আমলাদের হাতে চলে গেছে, ডিসির ওই জেলা প্রশাসক হওয়ার ভেতরই তার কিছুটা খবর পাওয়া যাচ্ছে। ডিসির অর্থ তো হওয়ার কথা ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার অথবা ডেপুটি কমিশনার, জেলা প্রশাসক কেন? সে যাই হোক, শুধু নামে নয়, ক্ষমতায়ও তাঁরা যে অনেক উন্নত, সেটা টের পাওয়া যায় তাঁদের কেউ কেউ যখন স্বীয় ক্ষমতা প্রদর্শন করেন।
উন্নতির সব চাপ সরাসরি গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। যেমন মশার ক্ষেত্রে উন্নতি। মশার উন্নত উৎপাত গত বছর ছিল ভয়াবহ। শোনা যাচ্ছে, এ বছর তারা আরো উন্নত হয়ে উন্নততর রণকৌশলে আমাদের আক্রমণ করবে। ঢাকার দুই মেয়রের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মশার বিষয়ে তাঁদের বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, পৌরপিতারা যেন দেখেন মশা যাতে আবার ভোট না খেয়ে ফেলে। তবে এ বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে মশার সাধ্য নেই ভোটের গায়ে কামড় বসায়। ভোট এখন এমন সুরক্ষিত ব্যবস্থায় রয়েছে যে মশার ক্ষমতা নেই সেখানে প্রবেশ করে, যতই তারা উন্নত হোক, চৌদ্দপুরুষেও পারবে না ভোটের গায়ে হুল ফুটাতে। মশা বড়জোর পারবে মানুষের রক্ত শুষে নিতে, চিকুনগুনিয়ায় হোক কী ডেঙ্গুতেই হোক—নিজস্ব কায়দায় মানুষকে কাবু করতে এবং পারলে মেরে ফেলতে।
তা মানুষ যে নিরাপদে নেই সে তো পুরনো কাসুন্দি। বিশেষ বিপদ শিশু ও নারীদের। শিশু যদি পুত্র না হয়ে কন্যা হয়, তবে মা-বাবার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়। একটি দৈনিকে খবর, দিনাজপুরে এক মাতার দ্বিতীয় কন্যাশিশুটি কোনোমতে বেঁচে ছিল ১৫ দিন, তার পরে আর পারেনি, তার বাবাই তাকে শেষ করে দিয়েছে। একই দিনে ওই পত্রিকায়ই বরগুনা থেকে খবর, তৃতীয় কন্যাশিশুটিকে তার মা দিন-রাত পাহারা দিচ্ছিল, ৪০ দিনের দিন ফাঁক পেয়ে বাবা এসে কন্যাটিকে তুলে নিয়ে ডোবায় নিক্ষেপ করেছে। পরের দিন একই দৈনিকের খবর চট্টগ্রামের। সেখানে ডাস্টবিনে কান্নার আওয়াজ শুনে কাছে গিয়ে দেখা গেছে একটি কন্যাসন্তান পড়ে আছে। বাবা ফেলে দিয়ে গেছে। এগুলো নমুনা মাত্র। ভেতরের বহু ঘটনা এ রকমই। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় এক মা তার দুই শিশুকন্যাকে নিজ হাতে বঁটি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করেছে, তারপরে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, মরার জন্য। জানা গেছে তার স্বামী থাকে অন্যত্র, খরচ দেয় না। মাসে দুই-তিন হাজার দেয়। তাতে সংসার চলে কী করে? অসহায় মা তার বাবার কাছ থেকে টাকা নেয়, প্রতি মাসে। যতবার হাত পাতে ততবারই লজ্জা ও গ্লানিতে মরে। ওদিকে টাকা চাইলে স্বামী তাকে হুমকি দেয় আরেকটি বিয়ে করার। কোথাও কোনো আশা দেখেনি; শেষে পথ বেছে নিয়েছে সন্তান হত্যার এবং আত্মহত্যার।
তা আমাদের এই সোনার বাংলায় মেয়েদের অবস্থা কবেই বা ভালো ছিল? আমাদের জাতীয় সংগীতে যে বলা আছে, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, ওমা আমি নয়ন জলে ভাসি’—সে উক্তি মিথ্যা নয়। আমরা সবাই যে নয়ন জলে ভাসি এটা ঠিক না হলেও মায়ের বদন যে সর্বদাই মলিন রয়ে গেছে এ সত্য অমলিন। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন যে চর্যাপদ তাতে উল্লেখ আছে, ‘আপনা মাসে হরিণা বৈরী’। অর্থাৎ হরিণের নিজের গায়ের মাংসই হরিণের শত্রু। মাংসের ওই গন্ধে অস্থির হয়ে মাংসলোলুপ বাঘ এসেছে, মানুষও বসে থাকেনি। চর্যাপদের ওই কবির কাব্যচর্চার পর শত শত বছর কেটে গেছে, তার পরও হরিণ তার নিজের মাংস নিয়ে বিপদের মধ্যেই রয়েছে। নারীও তেমনি সর্বদাই শঙ্কায় থাকে নিজের নারীত্ব নিয়ে। চতুর্দিকে তার অহর্নিশ লোলুপতা। ইউনিসেফ অবশ্য জানাচ্ছে, বিশ্ব এখনো নারীর জন্য সহিংস। চর্যাপদের অতিদরিদ্র জগতে যা ছিল সত্য তা অতিসভ্য ও প্রাচুর্যে ভরপুর বিশ্বেও মিথ্যা হয়ে যায়নি। তবে বাংলাদেশের অবস্থা সর্বদাই স্বতন্ত্র।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ কালেরকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন