বিশ্বায়নের যুগের সেনাবাহিনী
সেনাবাহিনী নিয়ে মানুষের যথেষ্ট কৌতূহল থাকে, তারা কী খায়, তারা কিভাবে ঘুমায়, তাদের বাসাগুলো কেমন, ভাষাগুলো কেমন ইত্যাদি। স্বাধীন বাংলাদেশে যদিও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষের কাতার থেকেই উঠে আসে, তথাপি যখন সৈনিক হয়ে যায় তখন সে এক ভিন্ন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পৃথিবীর অন্যান্য সেনাবাহিনীর মতোই। তবে বলাই বাহুল্য গঠনে, গড়নে, আদর্শে, প্রশিক্ষণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আংশিক উত্তরসূরি। ‘আংশিক’ বললাম এ জন্য যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন আমাদের চালচলন, আচার-আচরণ ও মতাদর্শে প্রভাব বিস্তার করেছে। এ ছাড়া গত ৪৮ বছরে পৃথিবীর অন্যান্য সেনাবাহিনীর সাথে বিভিন্ন মাত্রার ইন্টারঅ্যাকশন-এর কারণে সেসব সেনাবাহিনীর বহু রেওয়াজ বা ঐতিহ্য বা ট্রাডিশন বা সংস্কৃতি বা অভ্যাস বা আচার-আচরণ, আমাদের সেনাবাহিনীকেও কিছু না কিছু প্রভাবিত করেছে। পাঠকমাত্রই জানেন, জাতিসঙ্ঘের অধীনে, পৃথিবীর বিভিন্ন উপদ্রত অঞ্চলে শান্তিরক্ষার নিমিত্তে, যতগুলো দেশ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে অবদান রাখে, সেই তালিকায় বাংলাদেশ হয় প্রথম না হয় দ্বিতীয়। অতএব বলতেই হবে যে, আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিশ্বায়নের যুগের সেনাবাহিনী। আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সমসাময়িক বিশ্বের প্রশংসার পাত্র; বর্তমান সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদেরকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অফিসার ও সৈনিকরা সমীহের দৃষ্টিতে দেখেন। তার পরেও প্রচুর বিষয় আছে যেগুলো অনেক দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যেই কম-বেশি একইভাবে বিদ্যমান। মিলিটারি ট্রাডিশন বা সামরিক ঐতিহ্য বা সেনা ঐতিহ্য বা মিলিটারি কালচার তথা সামরিক সংস্কৃতি একটি আলোচ্য বিষয়। এ প্রসঙ্গেই আজকের কলামে একটি খণ্ডিত (ও অসম্পূর্ণ) আলোচনা করছি।
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তারিখ
আনুষ্ঠানিকভাবে এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে জাঁকজমকের সাথে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। তথাপি এটাই সত্য যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম ২৫ মার্চ ১৯৭১ দিবাগত রাত ১২টার পরপরই। অর্থাৎ ২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রহরে- যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একাধিক ব্যাটালিয়ন তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল, তখনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোড়াপত্তন হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসের মধ্যপর্যায়ে বিভিন্ন বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজগুলোর ওপর মাইন-হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বীজ বপন করা হয়েছিল এবং একদম শেষের দিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, কয়েকটি অ-যুদ্ধ (তথা বেসামরিক) বিমানকে অ্যাডহক ভিত্তিতে সাজিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে বোমানিক্ষেপ-আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বীজ উপ্ত হয়েছিল। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিবাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ফোর্সেস এবং এর কমান্ডার ইন চিফ বা প্রধান সেনাপতি ছিলেন তৎকালীন কর্নেল এম এ জি. ওসমানী। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ছিল তার মৃত্যুবার্ষিকী এবং ঢাকা মহানগরের ‘রাওয়া’তে একটি আলোচনা সভার মাধ্যমে তার প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশ ফোর্সেস নামক পরিচয় এবং সংগঠন বহাল ছিল। এই তারিখে সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য আলাদা আলাদা চিফ অব স্টাফ নিয়োগ দিয়ে বাহিনীগুলোকে আলাদা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্রমবিকাশে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রেওয়াজ দস্তুর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আংশিকভাবে হলেও প্রভাব বিস্তার করেছে।
জিয়াউর রহমান ও কিছু সংস্কার
১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ দিবাগত রাত ১২টায়, জাসদপন্থী একটি গোপন সংগঠন (নাম ছিল ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’) সেনাবাহিনীর অফিসারদের এবং সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ শুরু করেছিল। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সেনাবাহিনীর সৈনিক সম্প্রদায়ের বৃহদাংশ এই বিদ্রোহকে কাউন্টার এবং তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছিল। সেই ঘটনাকে ‘সিপাহি জনতার বিপ্লব’ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং দিবসটিকে ‘জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’ নামে পালন করা হয়। এর পরপরই দেশের শীর্ষ ক্ষমতার প্রধান স্তম্ভ হয়ে ওঠেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি সেনাবাহিনীর অফিসার-সৈনিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং সৈনিকদের ম্যানেজমেন্ট ক্ষেত্রে কিছু সুদূরপ্রসারী সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিলেন, তথা পাকিস্তান আমলের কয়েকটি প্রথাকে পরিশীলিত করেছিলেন।
দরবার ও দরবার হল
২০০৯ সালের এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ ঢাকা মহানগরীর পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর-এর সদর দফতরে, বিডিআর সদস্যদের বিদ্রোহে বহু অফিসার এবং বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন তথা শাহাদত বরণ করেন। ওই বছর থেকে শুরু করে প্রত্যেক বছর ফেব্রুয়ারি আসার আগেই আমি এবং সমমনা অনেকেই একটি দাবি বারবার উপস্থাপন করে আসছি। দাবিটি হলো, ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ সেনাদিবস’ ঘোষণা করা। আজো এই কলামের মাধ্যমে সেই দাবি আবার করছি। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখের ঘটনার স্থান ছিল পিলখানার অভ্যন্তরে অবস্থিত বিডিআর দরবার হল। ‘দরবার’ শব্দটির সাথে সারা বাংলাদেশের পত্রিকা পাঠক ও টিভি দর্শক তাৎক্ষণিকভাবে নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়ে গেলেন। তাই আজকের কলামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই ‘দরবার’ নিয়েই লিখছি। আমাদের সেনাবাহিনীর শত রেওয়াজ বা সেনা-সংস্কৃতির মধ্যে অন্যতম হলো দরবার। তবে সব জায়গায় দরবারের জন্য সুনির্দিষ্ট হল নেই। দরবার উন্মুক্ত জায়গাতেই হয়। এই প্রক্রিয়ার ঐতিহ্যগত জন্ম পাঁচ বা ছয় বা সাত শত বছর আগে দিল্লিকেন্দ্রিক শাসকদের আমল থেকে।
সুলতান বা বাদশাহ বা সম্রাটরা প্রজাদের বা তাদের প্রতিনিধিদের দর্শন দিতেন যে স্থানে এবং যে নিয়মে, সেটিকে বলা হতো ‘দরবার’। আবার দশ বা এগারো বা বারো শত বছর আগে থেকেই প্রখ্যাত সূফী সাধকগণের যে আস্তানা এবং যে প্রক্রিয়ায় সুফি সাধকগণ তথা মহান আউলিয়াগণ তাদের মুরিদ সন্তান বা তাদের দর্শনার্থী সাধারণ মানুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন ও কথাবার্তা বলতেন, সেটিকেও ‘দরবার’ বলা হতো। ইতিহাস পড়তে গেলে, এখনো ‘মুঘল দরবার’ বা ‘নবাবের দরবার’ এ ধরনের শব্দের সাথে পাঠক ঘন ঘন পরিচিত হন। অথবা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরবার, খাজা বাবা আজমিরীর দরবার, মুজাদ্দেদ আল ফেসানীর দরবার, শাহজালালের দরবার অথবা বর্তমান জমানায় মাইজভাণ্ডার দরবার, ফুরফুরা দরবার ইত্যাদি নামের সাথে পরিচিত। যা হোক, সেনাবাহিনীতেও দরবারের প্রেক্ষাপটটি সেই রাজা-বাদশাহের আমল থেকেই প্রচলিত।
দরবার নেয়ার পদ্ধতি বা সময়
সেনাবাহিনীর অধিনায়করা মাসে একবার নিজস্ব কমান্ডের ‘দরবার’ নিতেন; এখনো নেন। এটি একটি আনুষ্ঠানিক কর্ম এবং বাস্তবসম্মত। অধীনস্থ সৈনিকরা অকপটচিত্তে সরাসরি তাদের অধিনায়কের কাছে কোনো নালিশ বা মন্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ পান এবং অধিনায়কও, সরাসরি সব সৈনিকের সামনে তার মনের কথা বা কোনো পরিকল্পনা, কোনো সার্বজনীন নির্দেশ ইত্যাদি উপস্থাপনের সুযোগ পান। ব্যাটালিয়ন তথা রেজিমেন্ট পর্যায়ে দরবার প্রতি মাসে হয়। কদাচিৎ ব্রিগেড পর্যায়ে দরবার হয়ে থাকে। আরো কদাচিৎ ডিভিশন পর্যায়ে দরবার হয়। বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ সময়ে বা বিশেষ আকর্ষণে সেনাবাহিনীপ্রধানের দরবার হয় বিভিন্ন এলাকায় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর দরবার হয় বিভিন্ন এলাকায়। প্রত্যেক বছর শীতের মৌসুমে পুলিশ সপ্তাহ, বিডিআর সপ্তাহ (বর্তমানে বিজিবি) ইত্যাদি পালিত হয়।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বা তৃতীয় সপ্তাহে বিডিআর সপ্তাহ পালিত হচ্ছিল। ওই সপ্তাহের বড় বড় কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পিলখানার মাঠে বড় আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সালাম গ্রহণ, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অফিসারগণের নৈশভোজে অংশগ্রহণ, বিডিআর-এর মহাপরিচালক কর্তৃক অফিসার ও সৈনিকগণের দরবার গ্রহণ। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে বিডিআর মহাপরিচালকের দরবার হওয়ার কথা ছিল এবং বাস্তবেও অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। শুরু হওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সেখানেই বিদ্রোহ ও অফিসার হত্যা শুরু হয়ে যায়। সেই ২৫ ফেব্রুয়ারির দিন ও রাত্রিতে মেজর জেনারেল থেকে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত বিভিন্ন র্যাংক-এর ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা, প্রায় ১৪ জন বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং বিদ্রোহ দমনের নিমিত্তে ভূমিকা পালনের সময় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামসহ কয়েকজন বিভিন্ন র্যাংক-এর বিডিআর সৈনিক বিদ্রোহী আততায়ীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের কয়েকটি আঙ্গিক আছে। একটি হলো, প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আরেকটি আঙ্গিক হলো হত্যাকাণ্ড পরিচালনা। পিলখানা ঘটনার বিচার হয়েছে। বিচারের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে এবং দেড় মাস আগে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে; যেটা অতি দীর্ঘ। ‘দরবার’ শব্দের সাথে সামরিক ব্যক্তিদের অনুভূতিতে আনন্দ উৎফুল্লতা যেমন জড়িত, তেমনি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কারণে বেদনাও জড়িত। আজ বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারি এই কলামের মাধ্যমে পিলখানার শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। পিলখানা ঘটনার তদন্ত হয়েছে। কিন্তু তদন্তগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ বা অবিতর্কিতভাবে হয়েছে বলে বিশ্বাস হয় না; আশা করি কোনো-না-কোনো দিন সেগুলো জনসাধারণের দৃষ্টিতে আসবে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখের বিদ্রোহটি ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আত্মার ওপর আঘাত এবং পরোক্ষভাবে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার সক্ষমতার ওপর আঘাত। বিভিন্ন বৈরী পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে আমরা এ প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলতে চাইলেও পারছি না।
প্রীতিভোজ বা বড়খানা
সেনা-সংস্কৃতির আরেকটি বড় কর্ম হলো, প্রীতিভোজ বা ‘বড়খানা’। স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠান থেকে, অংশীদারের সংখ্যায় বড়, খাওয়ার আইটেমের সংখ্যা বেশি, উপস্থিত মেহমানদের জ্যেষ্ঠতা বেশি, সে জন্য এই খাওয়াগুলোর নাম হতো ‘বড়খানা’। এই বড়খানার রেওয়াজও ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত। কিছু দিন বা অনুষ্ঠান আছে যেগুলোতে বড়খানা বা প্রীতিভোজ সমগ্র সেনাবাহিনীতে অনুষ্ঠিত হয়; যথা দু’টি ঈদের দিন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি। কোনো কোনো সময় কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্টের বা ব্রিগেডের বা ডিভিশনের সুনির্দিষ্ট কর্ম বা উপলক্ষে বড়খানা বা প্রীতিভোজ অনুষ্ঠিত হয়। যেমন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠা দিবস (যেটাকে সেনা পরিভাষায় রেইজিং ডে বলা হয়) বা কক্সবাজার জেলার রামুতে অবস্থিত রামু সেনানিবাসের পদাতিক ডিভিশনের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিনটিতে বা সেনাবাহিনী প্রধান যদি দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ভিজিট করেন, তাহলে সেই ভিজিটের দিন, এসব জায়গায় বড়খানা বা প্রীতিভোজ অনুষ্ঠিত হয়। সেনাবাহিনীতে খেলাধুলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজয়ী দল তথা তাদের ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্ট বা ব্রিগেড, বিজয়ের আনন্দে বড়খানা বা প্রীতিভোজ খেতে পারে। বড়খানা বা প্রীতিভোজে সাধারণত উন্নত চাল যেমন পোলাও চাল দিয়ে ভাত রান্না করা হবে এবং মুরগি ও গরুর গোশতসহ একাধিক তরকারির আইটেম থাকবে। বড়খানা বা প্রীতিভোজের আনুষ্ঠানিকতায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, এতে একজন প্রধান অতিথি থাকেন। ব্যাটালিয়ন হলে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক বা কোনো একজন ব্রিগেড কমান্ডার প্রধান অতিথি হিসেবে আসেন। বা কোনো একজন জিওসি অধীনস্থ কোনো ব্যাটালিয়নে প্রধান অতিথি হতে পারেন। প্রধান অতিথি সবার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করবেন, প্রথমে নিজে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আহার মুখে তুলে নেবেন এবং অতঃপর সবাই ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আহার তুলে নেবেন। বড়খানা বা প্রীতিভোজের ঐতিহ্যের আরো একটি আঙ্গিক হলো, অংশগ্রহণকারী সবার জন্য একই মেনু হবে এবং সবাই একই সাথে খাবেন। পঞ্চাশ বছর আগে সবার টেবিলে বসে খাওয়ার জায়গা বা সুযোগ হতো না। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর বর্তমানে সবাই টেবিলে বসেই খেতে পারেন।
অফিসারদের রেজিমেন্টেশন
সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যের বা সংস্কৃতির অন্যতম আঙ্গিক হলো অফিসার ও সৈনিকের সম্পর্ক। একটি উদাহরণ দিয়ে বলি। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যে দিন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করলেন, বর্তমান গাজীপুর জেলা সদরে অবস্থিত ইতিহাসখ্যাত ভাওয়াল রাজার বাজবাড়িতে। তারিখটি ছিল ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০। সে দিন আমার বয়স ২২ বছর শেষ হতে এক সপ্তাহ বাকি। নতুন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের প্রথম এক মাস বা দুই মাস থাকা, খাওয়া, ঘুমানো সব কিছুই হয় সৈনিকদের সাথে এবং এই সময়কালটিকে বলা হয় ‘রেজিমেন্টেশন পিরিয়ড’। বিভিন্ন র্যাংকের সৈনিকদের একজন হয়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের অভ্যাস তৈরি করা হয়। সৈনিকদের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা সব কিছুর প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে ওঠেন প্রত্যেকটি নবীন অফিসার। এই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সময়ে ছোট বা বড় স্তরের অধিনায়কত্ব গড়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর তথা সৈনিকদের মনোবল উঁচু রাখায় যেসব উপাত্ত অবদান রাখে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান, মিলাদুন্নবী সা:-এর অনুষ্ঠান, তরুণ অফিসারদের বিয়েশাদির আয়োজন ইত্যাদিতে সৈনিকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকেন। এসব ফাংশনে মিলিটারি ব্যান্ড বড় একটি ভূমিকা পালন করে। মিলিটারি ব্যান্ড শুধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য নয়, হাজার বছর আগে থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিত্যসঙ্গী ছিল ব্যান্ড। ব্যান্ডের তালে তালে মার্চ করা, এর মাধ্যমে প্রেরণাদায়ক গানের সুরের মূর্ছনা তুলে সৈনিকদের যুদ্ধক্ষেত্রে আকৃষ্ট রাখা ইত্যাদি অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। জুমার নামাজে সব অফিসার অংশ নেয়াও একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। বছরে দু’টি ঈদের দিনে, সব স্তরের অধিনায়ক পরিকল্পিতভাবে, হাসপাতালে গিয়ে সব রোগীকে দেখবেন এবং তাদের হাতে মিষ্টি তুলে দেবেন, এটাও আরেকটি ঐতিহ্য।
রেজিমেন্টাল সেন্টার
সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যগুলোকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রেজিমেন্টের সেন্টার যথা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, চট্টগ্রামের হালিশহর সেনানিবাসে অবস্থিত আর্টিলারি রেজিমেন্টাল সেন্টার, খুলনা জাহানাবাদ সেনানিবাসে অবস্থিত আর্মি সার্ভিস কোর সেন্টার, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল সেনানিবাসে অবস্থিত কোর অব মিলিটারি পুলিশ সেন্টার, যশোর সেনানিবাসে অবস্থিত সিগন্যাল কোর সেন্টার ইত্যাদি ভূমিকা রাখে। ঐতিহ্যের একটি নমুনা হলো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের অধিনায়ককে বলা হয় ‘পাপা টাইগার’। অর্থাৎ বাঘের পিতা। কারণ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব অফিসার ও সৈনিক ‘টাইগার’ নামে পরিচিত (বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার কলাম দ্রষ্টব্য)। বলতেই হবে যে, সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যের মধ্যে আরো ছোট ছোট অনেক বিষয় আছে যেগুলোর সম্মিলিত প্রভাব হলো উন্নত মনোবলসম্পন্ন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
শুকরিয়া ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন
এই ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রায় টানা বারো দিন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ঢাকা সেনানিবাসে রোগী হিসেবে ভর্তি ছিলাম। বার্ধক্যজনিত বা প্রবীণ বয়সের কোনো অসুস্থতা নয়; হঠাৎ করেই গলা, কণ্ঠনালী ইত্যাদির অসুস্থতা এবং উচ্চমাত্রার দীর্ঘমেয়াদি জ্বর। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে যোগদানের নিমিত্তে ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে যখন চূড়ান্ত মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য তখনকার আমলের ঢাকা সেনানিবাসের কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল (সিএমএইচ) বা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে রিপোর্ট করেছিলাম, সেই থেকে এই হাসপাতালকে দেখছি। ১৯৭২ সালের হাসপাতাল, ১৯৮২ সালের হাসপাতাল, ১৯৯২ সালের হাসপাতাল, ২০১২ সালের হাসপাতাল- প্রত্যেকটি ছিল অতীতের তুলনায় উন্নততর। সেনাবাহিনীর উচ্চতম অধিনায়কত্বের প্রায় প্রত্যেকটি পর্যায়েই ক্রমান্বয়ে হাসপাতাল উন্নত হয়েছে। তবে উন্নয়নের বড় ধাক্কাটা পেয়েছে এখন থেকে সাত-আট বছর আগে- ভৌত কাঠামো বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসাকেন্দ্র বা বিভিন্ন সেন্টার যথা ট্রমা সেন্টার বা অনকোলোজি সেন্টার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক ধাক্কায় একশতের বেশি এফসিপিএস পাস করা ডাক্তার সরাসরি মেজর র্যাংকে নেয়া হয়েছিল; সেনাবাহিনীতে বলে ক্লাসিফাইড স্পেশালিস্ট হিসেবে। যে ক’দিন অসুস্থ ছিলাম, সে ক’দিন হাসপাতালের একটি খণ্ডিত চিত্র পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছি। প্রশাসনে নিযুক্ত বা সেবায় নিযুক্ত সর্বস্তরের চিকিৎসক মহোদয়গণকে, সংশ্লিষ্ট সৈনিকগণকে, সংশ্লিষ্ট বেসামরিক নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানাই। একটি সুপারিশ না করলেই নয়; বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জনবল এবং সাধারণ সৈনিকের জনবল বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন। মহান আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া যে, তিনি অল্পের ওপর পার করে নিয়ে এসেছেন। প্রায় চব্বিশ বছরের অবসর জীবনে এটা ছিল আমার দ্বিতীয়বার হাসপাতাল ভর্তি; ছয় বছর আগে ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে একবার ভর্তি হয়ে ৭২ ঘণ্টা ছিলাম। সব রোগীর ওপর মহান আল্লাহর অধিকতর রহমত কামনা করছি। হাসপাতালে ভর্তি থাকার পূর্ণ সময় ফেসবুক থেকে অফ ছিলাম, টেলিফোন খোলা থাকলেও ধরতে পারিনি। অতএব যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল বা সিএমএইচ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এলাকা নয় বিধায়, কিছু সীমাবদ্ধতা অপরিহার্য ছিল। বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা দোয়া করেছেন; তাদের প্রতি ধন্যবাদ। বিভিন্ন স্থানে ‘দাওয়াতে শিফা’ আয়োজন করা হয়েছিল; তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। নয়া দিগন্ত পত্রিকার পাঠকগণের একটি অংশ বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিয়েছেন; তাদেরকেও ধন্যবাদ।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন