সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে ১৩তম নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করার দুই সপ্তাহের মাথায় শরিকদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। সেই উদ্যোগ ও আলোচনায় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও প্রধানত রয়েছে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও অন্যরা। ১৩ মার্চ বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ৩০ জনকে আমন্ত্রণ জানালেও মাত্র ১৩ জন উপস্থিত হয়েছিলেন। অর্ধেকের বেশি অনুপস্থিত ছিলেন। আমি মনে করি, নির্বাচন বা নির্বাচন কমিশন নিয়ে ভিন্নমত পোষণকারীরা উপস্থিত হয়ে তাঁদের কথাগুলো বলতে পারতেন। এরপর ২২ মার্চ নির্বাচন ভবনে দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। এতে ৩৯ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও উপস্থিত ছিলেন ১৯ জন।
দুটি আলোচনাই ছিল অ্যাজেন্ডাবিহীন। কারণ, আলোচনার সারবস্তুর অভাব সেখানে দেখা গেছে। অ্যাজেন্ডার অভাবে অর্থবহ আলোচনা বা আগামী নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের অবশ্যকরণীয় কোনো সুপারিশ এসেছে বলে মনে হয়নি। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশাও জানা যায়নি। এরপরও আশা করি, নির্বাচন কমিশনের এ আমন্ত্রণে বেশির ভাগ ব্যক্তি সাড়া দেবেন এবং অ্যাজেন্ডা ছাড়া এ সংলাপে অন্তত তাঁদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরবেন। তবে তাতে নির্বাচন কমিশন কতখানি উপকৃত হবে, তা জানতে সময় লাগবে।
আধুনিক নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় শরিকদের সঙ্গে আলোচনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা এবং সম্পর্ক স্থাপনের। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একটি অত্যন্ত জরুরি ও কার্যকর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যেহেতু দলগুলোই নির্বাচনের জন্য প্রার্থী নির্ধারণ করে এবং এরই মাধ্যমে একক দল অথবা জোট করে সরকার গঠন করে; কাজেই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক হতে হয় যথেষ্ট খোলামেলা। পৃথিবীর বহু দেশে রাজনৈতিক দলের একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি থাকেন, যিনি কমিশনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এবং উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এবং রাজনীতিতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ আমরা দেখতে পাই না; শুধু যে দল বা গোষ্ঠীর ক্ষমতায় থাকার সময় কমিশন গঠিত হয়, তাদের সঙ্গেই সেটি দেখা যায়। বিশেষ করে ১১ ও ১২তম কমিশনের সঙ্গে তো রাজনৈতিক দলগুলোর একেবারেই তেমন সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। বরং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে সম্পর্কের অবনতিই দৃশ্যমান হয়েছে।
এসব কারণে আমি মনে করি, বর্তমান কমিশনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করা, বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে ফেরানোই হবে কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এসব দলকে জাতীয় সংসদসহ অন্যান্য নির্বাচনে সততা ও নির্ভরযোগ্যতার সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা করার বিষয়ে ন্যূনতম নিশ্চয়তা দিতে হবে।
যে সংলাপপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার প্রশংসা অবশ্যই করতে হয়। কারণ, এ প্রক্রিয়া আধুনিক ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য বিষয়। তবে এসব সংলাপকে অর্থবহ করতে হলে কিছু সময় নিয়ে বিভিন্ন আইন ও সংশ্লিষ্ট বিষয় ঘেঁটে বা বিশ্লেষণের পর অ্যাজেন্ডাযুক্ত আলোচনা করতে হবে, সেটিই নির্বাচন কমিশনকে সমৃদ্ধ করবে। তা না হলে গত দুই কমিশনের আলোচনার উদ্যোগের মতো মুখ থুবড়ে পড়বে। এমনটা হওয়া কাম্য নয়।
সব দল নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান যেহেতু কমিশনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তাই এ নিশ্চয়তা কীভাবে অংশীজনকে দিতে পারবে, সেটাই হওয়া উচিত সংলাপের প্রধান আলোচ্য বিষয়। আগের কয়েকটি লেখায় লিখেছিলাম, বাংলাদেশে উপর্যুপরি দুটি জাতীয় সংসদ এবং অন্যান্য নির্বাচন ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ও ‘ব্যর্থ’ হওয়ার কারণে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রবিমুখ হয়েছেন। যে যা ব্যাখ্যাই দিক না কেন, এটাই সত্য। ভোটাররা যখন ‘আমার ভোট দিয়ে কী হবে?’ অথবা ‘ভোট দিতে পারব কি না?’ এসব প্রশ্নের কোনো বাস্তবসম্মত উত্তর না পান, তাহলে তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহ ক্রমাগত হারিয়ে ফেলেন। ২০১৪, ২০১৮ এবং পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় এর প্রমাণ মিলেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনকে বাদ দিলেও ২০১৮ সালের শেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় সব দলের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পর্যবেক্ষকদের ভাষ্যে সেটি ‘ত্রুটিপূর্ণ’ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মূল কারণ ছিল বহু জায়গায় বা নির্বাচনী অঞ্চলে দিনের ভোট রাতে অনুষ্ঠিত হয় বলে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ উঠেছিল, যা তৎকালীন নির্বাচন কমিশন মানতে রাজি হয়নি। তবে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয় যে ভোট গণনা করতে গিয়ে অনেক জায়গায়, বিশেষ করে পরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় ফল পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছিল। আমি মনে করি, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের পূর্বতন চাকরিকালীন অভিজ্ঞতার কোনো অভাব নেই, ফলে ওই নির্বাচন কেন ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হলো, সেটি বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের উচিত পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা। ন্যূনতম পক্ষে পূর্ববর্তী কমিশনের কী করণীয় ছিল, তাঁরা নির্বাচনের তিন সময়ে—ভোটপূর্ব প্রচারণার সময়, ভোটের দিন এবং ভোট-উত্তর সময়ে কেন ব্যর্থ হয়েছিল; এসব বিষয় পর্যালোচনা দরকার। অর্থবহ আলোচনা করতে হলে প্রথমে এসব বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন একাধিক কারণে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। প্রথমত, পরপর দুটি ত্রুটিপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন থেকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এ কমিশনের রয়েছে। দ্বিতীয়ত, গত ১০ বছরে এসব নির্বাচনের ত্রুটিগুলো নিয়ে বহু বিশেষজ্ঞের মতামত, প্রস্তাব ও পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বা নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এসব লেখালেখি সহায়ক হতে পারে। তৃতীয়ত, তাঁদের পূর্বসূরিদের অভিজ্ঞতা। চতুর্থত, কমিশনে অত্যন্ত যোগ্য ও কর্মঠ কর্মী বাহিনী রয়েছে, যাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে নবগঠিত কমিশনকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।
যে সংলাপপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার প্রশংসা অবশ্যই করতে হয়। কারণ, এ প্রক্রিয়া আধুনিক ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য বিষয়। তবে এসব সংলাপকে অর্থবহ করতে হলে কিছু সময় নিয়ে বিভিন্ন আইন ও সংশ্লিষ্ট বিষয় ঘেঁটে বা বিশ্লেষণের পর অ্যাজেন্ডাযুক্ত আলোচনা করতে হবে, সেটিই নির্বাচন কমিশনকে সমৃদ্ধ করবে। তা না হলে গত দুই কমিশনের আলোচনার উদ্যোগের মতো মুখ থুবড়ে পড়বে। এমনটা হওয়া কাম্য নয়।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন