গত চার দশকে বাংলাদেশে তথাকথিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দখলদার দুর্বৃত্তদের দাপট তৈরি হয়েছে। এই বাহাদুরেরা উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির গল্পের আড়ালে নদীনালা, খালবিল, বন-জঙ্গল—সবকিছু ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করতে মরিয়া, তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশাল ভূমি ও সম্পদ তাদের আওতার বাইরে কী করে থাকে?
তাই সারা দেশ থেকে বিভিন্ন সময় আমরা যখন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন হওয়ার খবর পাই, তখন এর অনেকগুলোর সঙ্গেই পাই জমি ও সম্পদ দখলের খবর। সম্পদ ও মুনাফার লোভ অনেক ক্ষেত্রেই জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা এবং বিদ্বেষের চালিকাশক্তি। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর আক্রমণ, মধুপুরের বন কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রাম বা অন্য যেকোনো স্থান হোক না কেন, ঘটনার শিকড় খুঁজতে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই রকম ধরন পাওয়া যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে এসব বিষয় ঘনীভূত হয়েছে অনেক দিন ধরে। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, অগ্নিকাণ্ডসহ যেসব হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে দেখি, তার ক্ষেত্র বহুদিনে সৃষ্ট, এ কারণে এগুলো নতুন বা আকস্মিক নয়। এই অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে যে রক্তপাত, সহিংসতা, অস্থিরতা আর অশান্তি দেখি, তার উৎস সন্ধান করলে মোটা দাগে দুটো কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, উন্নয়ন প্রকল্প; যা মানুষ ও প্রকৃতির ওপর দীর্ঘ মেয়াদে বিষফল বিবেচনায় না এনে প্রণয়ন করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, জাতিগত অস্তিত্বের প্রতি অস্বীকৃতি; আপেক্ষিকভাবে দুর্বল সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতি উপনিবেশ ধরনের সংস্কৃতি ও রাজনীতি।
৬০ দশকে অশান্তির শুরু, যখন বিদেশি ঋণ ও উপদেষ্টাসহযোগে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লোভনীয় লক্ষ্য সামনে রেখে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়েছিল। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের কথিত উন্নয়ন দশকের এটি ছিল একটি বড় অবলম্বন। সেই প্রকল্প অনুযায়ী বঁাধ নির্মিত হলো, ভেসে গেল রাঙামাটির বৃহৎ জনবসতি, লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হলো, যারা সবাই সংখ্যালঘু জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষ। ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসন নিয়ে অনেক রঙিন গল্প ছিল, বাস্তবে তা এখনো অমীমাংসিত। অনেকে এখনো উদ্বাস্তু। যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাসিয়ে দেওয়া হলো লাখো মানুষ, সেই বিদ্যুৎ উত্পাদনও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয়নি। পরে বরং তার আরও অবনতি হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, আগের পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে আরেকটি বঁাধ দিতে হবে।
জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের ফল হিসেবেই বাংলাদেশের উদ্ভব। এই অঞ্চলে তাই জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের অবসানই প্রত্যাশিত ছিল, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জন্য বিদ্যমান সমস্যা স্বীকার করে তার সমাধানের দিকে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত ছিল এবং তা সহজে সমাধান সম্ভবও ছিল। কিন্তু তা হয়নি, সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেওয়ার পথ তৈরি হয়েছে জাতিগত অস্বীকৃতি দিয়ে। প্রথম সংবিধানই বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতির স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করল। স্বাধীন বাংলাদেশে সংঘাত, অবিশ্বাস ও নিপীড়নের নতুন পর্ব শুরু হলো। এম এন লারমা প্রতিবাদ করলেন সংসদেই। কিন্তু প্রত্যুত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের আয়োজন শুরু হলো। শুরু হলো সশস্ত্র প্রতিবাদ, প্রত্যুত্তরে নিপীড়নের আয়োজন আরও সম্প্রসারিত হলো।
এ কারণে বাংলাদেশের সব মানুষ সামরিক শাসনের অধীনে আসার আগেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে সামরিক শাসন। বাংলাদেশের সব মানুষ যখন সামরিক শাসনের অধীনে, তখন এই অঞ্চল বাড়তি সামরিক শাসনের আওতায়। আর এই শাসনকালে আড়ালে সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতাবানদের হাতে জমি গেছে, সম্পদ গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘকাল স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরা গেছে, বসত গেড়েছে। কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ৭০ দশকের শেষে জাতিগত শাসনের পদ্ধতির অংশ হিসেবে যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অর্থ, জমি ও কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গরিব বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হলো, তখনই জটিলতা শুরু হলো। গরিব বাঙালিদের ঢাল বানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হলো নিপীড়ন, সহিংসতা ও জাতিগত বিদ্বেষের আরেক পর্ব। প্রকৃতপক্ষে গরিব বাঙালিদের জীবনও নিরাপদ হয়নি।
রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এভাবে বাঙালি ‘সেটলার’দের সংখ্যা বেড়েছে, ক্রমে কোথাও কোথাও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাবলি ক্রমে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব, অবিশ্বাস, সংঘাত ও সহিংসতা বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে নিরাপত্তা রক্ষার নামে পাহাড় উজাড় হয়েছে। রেশন, উন্নয়ন বাজেট, নির্মাণ, স্থাপনা ইত্যাদি ধরে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে; উন্নয়ন ও নিরাপত্তার অজুহাতে পাহাড় লিজ হচ্ছে ব্যক্তির নামে, বন উজাড় হচ্ছে। এগুলো ঘিরে বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, এদের বিপুল অধিকাংশ বাঙালি হলেও নতুন সুবিধাভোগী কিছু পাহাড়িও আছে। এদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি, অর্থাৎ সামরিকীকরণ, অর্থাৎ অব্যাহত সহিংসতা, উত্তেজনা, অবিশ্বাস দরকার। ১৯৯৭ সালে ‘শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষর হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো অনিষ্পন্নই রাখা হয়েছে। জাতিগত স্বীকৃতি, বসতি-পুনর্বাসন ও উন্নয়ন দর্শনের সমস্যা বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তার ফলে শান্তিও আসেনি।
জাতিগত অসন্তোষ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান হয় না। এর চেষ্টা পৃথিবীর কোথাও সফল হয়নি। বাংলাদেশেও এই কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমান্বয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে মানুষের, রক্তক্ষরণ হচ্ছে সমাজ ও অর্থনীতির। আর তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে বারবার পাহাড়ি-বাঙালি, পাহাড়ি-পাহাড়ি সংঘাত, সহিংসতা, নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে শুধু এটাই স্পষ্ট হচ্ছে যে জাতিগত নিপীড়নের দায় থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো মুক্ত হতে ইচ্ছুক নয়। একটি শক্তিশালী সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেই সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। সমতলের অন্যান্য অঞ্চলেও ঘটনার ধরন একই রকম। এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ, ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়-সমতলের নানা জাতির মানুষের সঙ্গে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও।
এই অবস্থার অবসানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী আর তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। সব জাতি, ভাষা ও ধর্মের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সবার মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার, তাদের জমি ও সাংস্কৃতিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সর্বোপরি মানুষ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন দর্শন পুনর্বিন্যাস নিয়ে পাহাড়ে-সমতলে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার থাকার মধ্য দিয়েই পরিবর্তনের পথ তৈরি হবে।
এর জন্য প্রাথমিক কয়েকটি কথা আমাদের মাথায় গেঁথে নিতে হবে। এগুলো হলো, বাংলাদেশ প্রধানত বাঙালি-অধ্যুষিত দেশ হলেও কেবল বাঙালির বাসভূমি নয়; বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও কেবল মুসলমানের বাসভূমি নয়। এই বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, বহুভাষিক বৈচিত্র্য আমাদের সমস্যা নয়, সম্পদ। আমাদের ঐশ্বর্য। অথচ মুক্তিযুদ্ধের এই দেশে অন্যান্য জাতি, ধর্ম ও ভাষার অস্তিত্ব অস্বীকারের চেষ্টা নানাভাবে এখনো চলছে। সর্বশেষ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও একই কাজ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক রোমেল চাকমা হত্যা বা লংগদু হামলা তাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বলা বাহুল্য, এ রকম অস্বীকৃতি শান্তি ও গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি হতে দেয় না। অবিশ্বাস, বিদ্বেষ আর সহিংসতাই কেবল বাড়ায়। এতে দিন শেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ও ধর্মের মানুষেরও বিপন্নতা বাড়ে।
উন্নয়ন দর্শন অভিন্ন হলে বিপর্যয় বা আক্রমণ এক জায়গায় থেমে থাকে না। একই রকম উন্নয়ন-গল্প তাই সমতলেও অনেক শোনা যাচ্ছে: ফুলবাড়ী, সুন্দরবন, রূপপুর, চুনারুঘাট, গোবিন্দগঞ্জ, বঁাশখালী...।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন