দুধওয়ালা
11 May 2023, Thursday
কতটুকু দুধে কী পরিমাণ পানি মিশানো হয়েছে, কিংবা কতটা পানিতে কতটুকু দুধ দেয়া হয়েছে, তা পুরনো বিতর্ক। ‘স্যার নোংরা পানি মিশাই না; টিউবওয়েলের পরিষ্কার পানি দুধে মিশাই’। কথাটির সাথে অনেকেই পরিচিত।
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর একটি ছোট্ট খবর পত্রিকাটির একজন সংবাদদাতার প্রেরিত। এক কলামের এই খবরে বলা হয়েছে, জনৈক বিক্রেতা যুবকের জরিমানা হয়েছে পানিতে দুধ দেয়ার দায়ে। সে নাকি ২৬ কেজি পানির সাথে ১৪ কেজি দুধ মিশিয়েছিল। এই হিসাবে সে শতকরা ৩৫ ভাগ দুধ দিয়েছিল ৬৫ ভাগ পানিতে। আমাদের শৈশবে-‘হাজী সাহেব’ খাঁটি দুধ দিতেন আমার বাসায়। তাকে আমরা ‘হাজী সাহেব’ বলেই চিনতাম, ‘দুধওয়ালা’ বলতাম না কখনো। তিনি ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরে এবং পায়ে জুতাসহ আসতেন। মাথায় থাকত ছাতা। বাসা ছিল শহরতলীতে। তার ছেলে (আমার বড় ভাইয়ের ছাত্র) একটি মুসলিম দেশে আমাদের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন এবং এখনো কলাম লিখেন পত্রিকায়। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীর শ্বশুর এবং তার ছেলে আমাদের স্কুলের সাবেক ছাত্র। যা হোক, সততার মান এত নিচে নেমে গেছে যে, দুধের সাথে পানি মিশানো হয় না। পানির সাথে দুধ মিশানো হয়। আগে উল্লিখিত পত্রিকায় বলা হয়েছে, মুচলেকা দেয়ায় পূর্বোক্ত যুবকের বেশি জরিমানা হয়নি। অবশ্য তার জরিমানার পরিমাণও কম নয়। সে একা নয়, দেশের বেশির ভাগ দুধ বেপারি দুধে পানি মিশায়। পাবনা ও সিরাজগঞ্জে রমজান মাসে ভেজাল দুধের রমরমা কারবারের কথা নয়া দিগন্তেই ছাপা হয়েছে।
আমরা এই ভেজালের ওপরই বেঁচে আছি। কবি বলেছেন, ‘আমরা সুহেই আছি, বাতাস খাইয়া পেট ফুলাইয়া ড্যাং ড্যাঙ্গাইয়া নাচি।’
সমাজের সর্বত্র যে, দুর্নীতি পরিব্যাপ্ত তার একটি প্রমাণ দুধে পানি মিশানো, বা পানিতে দুধ মিশানো হয়েছে। পূর্বে উল্লিখিত, দুধ বিক্রির ঘটনায় ওই যুবকের দুর্নীতি ধরা পড়েছে ল্যাকটোমিটার দিয়ে দুধ পরীক্ষায়। এখন সেই ল্যাকটোমিটারকে ফাঁকি দেয়ার জারিজুরিও আবিষ্কৃত হয়েছে।
সুনীতির বিপরীত কুনীতি বা দুর্নীতি। আর চার দিকে সে দুর্নীতির প্রবল প্রতাপ। আমরা দুর্নীতির ফসল ঘরে তুলে সুনীতি শিখব কোত্থেকে? এ জন্যই আজ সমাজে মন্দ লোকই বেশি।
শুধু গরিব দুধ বেপারিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা তো সুযোগ পেলেই পেটের দায়ে দুর্নীতি করবে। ওদের না হয় ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’; কিন্তু যাদের স্বভাবই হচ্ছে দুর্নীতি করা, ওদের রুখবে কে? সবাই দুর্নীতি করে, কিন্তু দোষ হয় বেচারা দুধ বেপারির। ও গরিব বলেই কি ওকে অন্যদের চেয়ে বেশি শাস্তি ভোগ করতে হবে?
সময় এসেছে সমাজের সর্বত্র থেকে যেকোনো ধরনের দুর্নীতি উৎপাটনের। সেটা দুধে হোক কিংবা অন্য কোথাও হোক, একই কথা। দুর্নীতি ও সুনীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। এটা বিশেষ করে, সরকারকে বুঝতে হবে যে, দুর্নীতি সুনীতিকে গ্রাস করে নেয়। কিন্তু সুনীতি হারতে দেয়া যায় না।
সমাজে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত মানুষের খুব অভাব। যারা সুশাসন জণগণকে উপহার দিতে পারে, তারাই জাতিকে সৎ মানুষের উপহার দাতা। সৎ ও যোগ্য, উভয় প্রকার লোকই দরকার আমাদের। কিন্তু যে শিক্ষাব্যবস্থা কেবল যোগ্যতা সৃষ্টি করে, সততাকে উপেক্ষা করে, তা কি মূলত শিক্ষাব্যবস্থা? যত শিক্ষিত, তত অসৎ- এমন ধারণা যেন অশিক্ষিত মানুষের না হয়। আমাদের জোর দাবি-একই সাথে সৎ ও যোগ্য মানুষের শাসন চাই। অন্যথায় দুর্নীতি দূর হয়ে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে না।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন