কাজাখস্তান বিশ্বের একটি বৃহৎ দেশ, যেখানে বর্তমান সমস্যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ। তা হলো, স্বৈরশাসনের অবসান ও প্রকৃত গণতন্ত্র বা জনশাসন কায়েম। রাশিয়ার হস্তক্ষেপ কিংবা মার্কিন হুঁশিয়ারিতে উত্তেজনাময় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি; বরং গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা কাজাখ রাষ্ট্রে।
কাজাখ সরকার জরুরি অবস্থা জারি, বিক্ষোভরত মুক্তিকামী জনতাকে ‘উগ্রবাদী, ‘জঙ্গি, ‘চরমপন্থী, ‘সশস্ত্র দুর্বৃত্ত’ বা ‘বিদেশের দালাল’ বলা, রুশ জোটের সেনাবাহিনী আনয়ন, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রয়োগ, এমনকি প্রধানমন্ত্রীসমেত পুরো মন্ত্রিসভা বাদ দিয়ে নতুন সরকার গঠন প্রভৃতি সবকিছু করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। এর মধ্যেই শত শত কাজাখ হতাহত এবং কয়েক হাজার গ্রেফতার। পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, বলা যায় না। পরাশক্তি বা বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া নিরপেক্ষ বা সুষ্ঠু নির্বাচনে জনকল্যাণকামী সরকার ও গণমুখী প্রশাসন গঠিত হলেই অবস্থার উন্নতির আশা করা যেতে পারে। সরকারপদ্ধতি বা দেশ চালানোর পন্থা-পদ্ধতি সে দেশেরই জনসাধারণ উদ্ভাবন করুক। বাইরের কেউ নয়।
ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, এখন কাজাখস্তান কমিউনিস্ট যুগের কোনো সোভিয়েত ‘প্রজাতন্ত্র’ বা আসলে প্রদেশ নয়; এটা বর্তমানে সার্বভৌম ও স্বাধীন দেশ। তাই তাদের নিজেদের বিষয়ে তারাই সব সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাওয়া খুব দরকার। জোর করে কোনো ব্যক্তি, দল, দেশ, জোট বা কোনো মহল সে দেশে কিছু চাপিয়ে দেয়া অনুচিত।
উল্লেখ্য, কেবল কাজাখদের দেশে নয়, মধ্য এশিয়ার সব রাষ্ট্রেই এখন স্বৈরশাসন; বর্তমানে সেখানে ‘ইসলামপন্থী’রাই নাকি সবচেয়ে ‘বড় শত্রু’। গণতন্ত্রের নামে সেখানে দেশে দেশে মূলত কর্তৃত্ববাদের প্রতিষ্ঠা চলছে। বড়জোর জনতুষ্টিবাদ প্রশ্রয় পায় যা গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট ছাড়া ‘ব্রুট মেজরিটি’ বা গরিষ্ঠতাবাদ কায়েম হতে পারে যা আসলে গণতন্ত্র নয়।
কাজাখস্তানের জনসংখ্যা এক কোটি ৯০ লাখের মতো। তবে দেশটি দুনিয়ার নবম বৃহত্তম রাষ্ট্র। ফলে বিশ্বে যে ক’টি দেশে সবচেয়ে কম গড় জনসংখ্যা, তার একটি এই কাজাখ রাষ্ট্র। অথচ এটা হলো বিশ্বে বৃহত্তম স্থলবন্দী দেশ এবং পৃথিবীতে এত বড় ও এত উত্তরে আর কোনো মুসলিম অধ্যুষিত দেশ নেই। এর পরিসর ২৭,২৪,৯০০ বর্গকিলোমিটার। আর গড় লোকসংখ্যা এত কম যে, প্রত্যেক বর্গকিলোমিটারে মাত্র সাতজনের বাস। জিডিপি (২০২০) এক হিসাবে মাথাপিছু ৩০,১৭৮ ডলার এবং সর্বমোট ৫৬৯ দশমিক ৮১৩ বিলিয়ন ডলার।
কাজাখস্তানের বিপুল গরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম। তবে ইসলাম ‘সেকুলার’ সে দেশে প্রাধান্য পায় না। দীর্ঘ দিনের ব্যক্তিপূজা, দমননীতি, স্বৈরশাসন, বৈষম্য ও শোষণ, গণবিরোধী কুশাসন, প্রভৃতির পরিণতি বর্তমান কাজাখ সঙ্কট। এসব কারণ দূর না করে কেবল বাহ্যিক লক্ষণ বা উপসর্গ নির্মূল করা সমাধান নয়। কারণ তাহলে এমন সমস্যা বারবার সৃষ্টি হবে এবং দমন-পীড়ন ও জনদুর্ভোগ বাড়াবে।
কাজাখস্তানে ব্যক্তিপূজা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, সে দেশের দীর্ঘকালীন বিগত স্বৈরশাসক নুর সুলতান নজরবায়েভ নিজ নামে শহর গড়ে (নিশ্চয়ই সরকারি বা জনগণের অর্থে) সে নুর সুলতানে কাজাখ রাজধানী স্থানান্তর করলেন দেশের বৃহত্তম শহর আলমাতি থেকে। তবে ‘শেষ হয়েও হইল না কো শেষ।’ সর্বশেষ, তিনি হয়েছিলেন প্রভাবশালী জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্তৃত্ববাদী কর্মকর্তা। এবারে গণবিক্ষোভের একটা বড় কারণ, এই একনায়কের ওপর বিশেষত তরুণরাসহ মানুষের তীব্র ক্ষোভ। তাই জনরোষ কমাতে কর্তৃত্ববাদী আরেক প্রেসিডেন্ট তোকায়েভকে পদক্ষেপ নিতে হয়েছে নজরবায়েভকে সরানোর জন্য। তবুও জনতা আস্থা রাখতে পারেনি নজরবায়েভেরই নৎধরহ পযরষফ তুল্য বর্তমান কাজাখ সরকারের ওপর। ফলে এর পরও জনগণের আন্দোলন থাকে অব্যাহত। এর আগে নজরবায়েভের কুনজরদারি ছিল সরকারি পদক্ষেপের প্রতি। সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রে বা বর্তমান রাশিয়াতে বিখ্যাত ভলগা নদীর নামে রাখা ‘ভলগোগ্রাদ’ শহর। গত বিশ্বযুদ্ধের পর এটা পরিচিত হয়েছিল ‘স্তালিনগ্রাদ’ নামে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের সাথে এ নামও বিদায় নিয়েছে সে দেশ থেকে চিরতরে। আমার এক ভাগনে সে শহরে ভূতত্ত্ব বিষয়ে পড়ত অতীতে। এখন প্রতাপশালী স্তালিনও নেই; সেই স্তালিনগ্রাদও নেই।
আজ যে রাশিয়াকে সৈন্য পাঠাতে কাজাখ সরকার অন্যায় অনুরোধ জানায়, সে দেশের বিরুদ্ধে কাজাখদের মনোভাব অতীত থেকে বরাবরই খারাপ। কাজাখ রাষ্ট্র ঊনবিংশ শতকে বারবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। তারা স্বেচ্ছায় বা উৎসাহের সাথে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের জোয়াল কাঁধে নেয়নি। লেনিন সর্বহারার কথিত স্বর্গ কায়েমের দীর্ঘ ১৭ বছর পরে কাজাখস্তানে কমিউনিজম কায়েম হলো সে মহারাষ্ট্রে এর অন্তর্ভুক্তি দ্বারা। সোভিয়েত আমলের দাবি ছিল, তারা কাজাখস্তানে অন্তত ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা। বাস্তবে এর অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে রুশরা। একসময়ে কিন্তু তারা কাজাখদের সংখ্যালঘু (৩০%) বানিয়েছিল স্বভূমিতেই।
রুশীকরণ প্রক্রিয়া আর রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন জাতীয়তাবাদ ছিল সমাজতান্ত্রিক আমলেও। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিকালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তদানীন্তন প্রধান, পরলোকগত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক আমাকে তাদের পার্টি অফিসে দুঃখ করে বলেছিলেন বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলোতে সোভিয়েত আমলের রুশীকরণের বিষয়ে। তিনি নিজে এসব দেশ সফর করে এসব অবাঞ্ছিত ব্যাপার দেখেছেন। একই মন্দ অভিজ্ঞতা কাজাখস্তানের ভ‚মিপুত্র-কন্যাদের। তাই তারা এককালীন সোভিয়েত গোয়েন্দা, সাবেক সমাজবাদী, রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বিশ্বাসভাজন মনে করে না। এর জন্য প্রধানত দায়ী তার বিকৃত গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদী মনোবৃত্তি আর উগ্র জাতীয়তাবাদ। তাকে ‘প্রচ্ছন্ন সাম্রাজ্যবাদী’ মনে করা হচ্ছে।
অপর দিকে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো কাজাখ সরকারকে বরাবরই মনে করে, এ অধিকারের শত্রু এবং কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার। রাশিয়া সম্পর্কেও একই কথা। কাজাখস্তানের ৭২ শতাংশ মানুষ নিজেদের মুসলমান দাবি করলেও সে দেশে ইসলামের অনুসরণ কার্যত বেশি নয়। যারা ‘ইসলামী আন্দোলন’ করছেন, তাদের চড়ষরঃরপধষ ওংষধসরংঃ, এমনকি জঙ্গি বা মৌলবাদী বলে নিন্দা করা হয়। কিছুলোক ইসলামের কঠোর অনুসারী হলেও অনেকেই ধর্মকর্মে উদাসীন। গত বছর মৃত্যুবরণকারী সাবেক সচিব, লেখক এবং ইসলামী ব্যক্তিত্ব শাহ আব্দুল হান্নান কাজাখস্তান সফরের স্মৃতিচারণ করে এক লেখায় এ ব্যাপারে বলেছেন।
কাজাখস্তান-রাশিয়া সম্পর্ক অনেক পুরনো ও গভীর। এ দেশ সোভিয়েত আমলের মতো রুশ পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার আজো। রাশিয়ার পরমাণু পরীক্ষা হয়ে থাকে এ দেশেরই মরুভ‚মিতে। কাজাখ দেশের দু’টি সরকারি ভাষার একটি হলো রুশ। মৌখিক ভাষারূপেও রাশিয়ানের স্থান কাজাখের পরই।
কাজাখস্তান-রাশিয়া সম্পর্কের পুরানত্ব ও গভীরত্বের দরুন মুক্তিকামীরা এবার কাজাখ দেশের সর্বত্র অভাবনীয় গণআন্দোলন আরম্ভ করে দিলে ক্ষমতাসীন জোমার্ত সরকার প্রথমেই মস্কোকে যে জোটের নামে রুশ সেনা পাঠাতে বলে, তার সদস্য এই কাজাখস্তানও। তবে ১৫টি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মাত্র ছয়টি এই সিএসটিও জোটের অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে আছে গোঁড়া গির্জার অনুসারী আর্মেনিয়া, কর্তৃত্ববাদী উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং পশ্চিমের ইউক্রেন ও বেলারুশ যে দু’টি দেশ যথাক্রমে আমেরিকার ও রাশিয়ার বশংবদ।
কাজাখস্তান ঐতিহাসিক রেশমপথের পূর্বসূরি এবং এর একাংশ ইউরোপে পড়েছে। বিখ্যাত বলখাস হ্রদ, সাবেক আরল সাগর, উরাল পর্বত, সির দরিয়া নদী প্রভৃতি কাজাখস্তানে। এই দেশের স্তেপ মালভ‚মির পরিসর তিন লাখ ১০ হাজার ৬০০ বর্গমাইল। দুনিয়ার আর কোথাও এতবড় শুকনা স্তেপ নেই। কাস্পিয়ান সাগর থেকে আলতাই পর্বতমালা এবং পশ্চিম সাইবেরিয়া থেকে মধ্য এশিয়া অবধি এ বিশাল দেশের বিস্তার। এর দীর্ঘতম সীমানা (৬৮৪৬ কিমি) রাশিয়ার সাথে। এরপর যথাক্রমে উজবেকিস্তান (২২০৩ কিমি), চীন (১৫৩৩ কিমি), কিরগিস্তান (১০৫১ কিমি) এবং তুর্কমেনিস্তান (৩৭৯ কিমি)। আজারবাইজান পৃথিবীর অন্য একমাত্র স্থলবন্দী দেশ কাজাখস্তানের মতো যার ভ‚ভাগ দুই মহাদেশে অবস্থিত। কাজাখ রাষ্ট্র একাই পশ্চিম ইউরোপের সমান। অতীতে কাজাখস্তান তার ভূমি হারায় সোভিয়েত সময়ে চীন ও উজবেকিস্তানের কাছে। কাজাখদের বর্তমান ভাষা ষোড়শ শতক থেকে প্রচলিত। তবে রাজনৈতিক অনৈক্য, গোত্রীয় সঙ্ঘাত এবং স্থলপথে বাণিজ্যের ক্রমহ্রাসমান গুরুত্ব কাজাখ দেশের উন্নতির প্রতিবন্ধক ছিল অতীতে। রুশদের আগমনের আগে ২০০ বছর ধরে কাজাখরা ছিল উজবেকিস্তানের অধীনে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু ছিল কাজাখদের জন্য ‘সুবর্ণকাল’।
আজকের রাশিয়ার সাম্রাজ্য অতীতে কাজাখদের ভয় পেত। এ জন্য তারা আত্মরক্ষার জন্য বহু দুর্গ নির্মাণ করেছিল। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে রুশরা মধ্য এশিয়াতে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটায়। ফলে সে দেশের জাররা বর্তমান স্বাধীন কাজাখ প্রজাতন্ত্রের অধিকাংশ এলাকাই করতলগত করেছিলেন। তারা কর্তৃত্ব স্থায়ী করতে কাজাখ এলাকায় সব বিদ্যালয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে রুশভাষা চালু করেন। কিন্তু কাজাখরা তা মানেনি। ১৮৬০ সালের মধ্যে কয়েকবার তারা রুশ শাসন প্রতিরোধ করেছে। এ সঙ্ঘাতে কাজাখদের পরিব্রাজক ঐতিহ্য বিপন্ন হয়, গবাদিপশুর অর্থনীতি হয় হুমকির সম্মুখীন ও জনগণের খাদ্যাভাব দেখা দেয়। রুশরা নৃশংসতা প্রদর্শন করেছে। অন্য দিকে কাজাখদের জাতীয় আন্দোলন ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে রুশ সাম্রাজ্যের দ্বারা তাদের কণ্ঠরোধের প্রয়াসরোধ করে নিজস্ব ভাষা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায়। এর বিপরীতে, রাশিয়া চেষ্টা করে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য। এ জন্যই ওরেনবার্গ-তাসখন্দ রেলপথ নির্মিত হয়েছে। রুশ রাজধানী সুদূর সেন্ট পিটার্সবাগ থেকে সরকারের বিশেষ বিভাগ খুলে উৎসাহ দেয়া হতো কাজাখস্তানে অভিবাসনের জন্য। ফলে চার লাখ রুশের সাথে ১০ লাখ ¯ভ্লাভ, জার্মান, ইহুদি প্রভৃতি সে দেশে এসে বসত গড়ে। তবে কাজাখরা তাদের উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়ে যায়। তারা বিপ্লবের আগের বছর, ১৯১৬ সালে রুশ সেটলার ও গ্যারিসনে হামলা চালায়, যার পরিণাম গণহত্যা। অবশ্য উভয়পক্ষই ছিল কমিউনিস্ট-বিরোধী।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন