ছাত্রছাত্রীদের শত্রু বানিয়ে দেশ চালানো যায় না। ওরা সারাদেশের দেয়ালে যা লিখে রেখেছে, তা সকলেরই পড়তে পারা দরকার। পুরাতন রাজনৈতিক বাগধারা দিয়ে এই পরিস্থিতি বোঝা কঠিন। বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক ভূমিকম্প চলমান। শিকড় আলগা হয়ে গেছে যেসব বড় গাছের, দমকা বাতাসও তাদের জন্য বিপজ্জনক।
দেশের প্রধান বিরোধী দল কি ছাত্রসমাজ? বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীকে যে কায়দায় মোকাবিলা করা গেছে, সেই কায়দায় ছাত্রসমাজকে দমানো যাবে না। এর ফল বুমেরাং হতে বাধ্য। এ সত্যটা তো শহীদদের কাফনের মতোই পরিষ্কার। তার পরও ২০১৩-১৪ ভাষা ও অস্ত্র দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে মোকাবিলা করা হচ্ছে। হুঁশ নামক বস্তুটি কি তারা হারিয়ে ফেলেছেন? ক্ষমতার সঙ্গে সরল চিন্তার একটা বিরোধ আছে। সিরাতুল মোস্তাকিম বা সরল পথ তাদের জন্য না।
বৈষম্যের বিরুদ্ধের দাবি কমজোরি করতে ‘রাজাকার’ ইস্যু তোলা চরম ব্যাকফায়ার করেছিল। এখন লাশের অঙ্কের পরীক্ষায় জামায়াত নিষিদ্ধের ফরমান দিয়ে কী লাভ? তা তিলকে করে তুলবে তালের সমান। সরকারের যা ক্ষতি তা তো হয়েই গেছে। নিষিদ্ধের ঝালরে কি এত নিরীহের মৃত্যু ঢাকা যাবে? আওয়ামী লীগের কি আর কিছুই দেবার বা বলার নাই দেশকে?
এক দর্জির কাছে লোক গেছে প্যান্ট বানাতে। সে ফিতা দিয়ে মাপছে: দৈর্ঘ্য ৬০, প্রস্থ ৬০, বহর ৬০ ইঞ্চি। লোকটা গেল খেপে, ‘ওই মিয়া, কী পাইসেন আমারে! আমি কি সিলিন্ডার নাকি যে আমার আগাপাশতলা সব এক সমান? দর্জি বেচারা তখন ফিতাটা দেখায়। বহু পুরোনা ফিতা। ব্যবহারে ব্যবহারে ওই ৬০ ইঞ্চি দাগ ছাড়া আর সব মুছে গেছে। এদেরও কি সেই অবস্থা?
অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য এমনি এমনি দাঁড়িয়ে নাই। তা বলছে, ছাত্রর আজ বা কাল জিতবেই। ছাত্রসমাজকে শত্রু বানিয়ে আইয়ুব খান পারেননি, ইয়াহিয়া পারেননি, এরশাদও পারেননি। ২০০২ সালে, বিএনপি সরকারের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের মেয়েদের ওপর মধ্যরাতে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে উপাচার্য এই অনুমতি দিয়েছিলেন, তিনি আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন।
ছাত্র-তরুণদের প্রতিরোধে দুইবার পতাকা ও মানচিত্র বদলে গেছে। এইবার আবার তারা জান কবুল করে নেমেছে। তারা দেখেছে, তাদের অভিভাবকরা আপস করে গেছেন। সাবেকি মধ্যবিত্ত নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। এরা নতুন। এরা মূলত উঠতি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। ব্রিটিশ শাসিত যুক্তবাংলায় উঠতি মধ্যবিত্তের সন্তানরা জমিদারি শোষণ এবং চাকরি-বঞ্চনার প্রতিকার চেয়েছিল। সে দাবি শোনা হয়নি। বরং বনেদিরা দেশভাগ বেছে নিয়েছিল। পঞ্চাশ-ষাট দশকে জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের ফল হলো পাকিস্তান-ভাঙা স্বাধীনতা। ইতিহাসের শিক্ষা ভুলবার পরিণাম কী, তা জানতে দয়া করে পাঠ্যপুস্তক আবার খুলুন।
আজকের বাংলাদেশে কয়েক কোটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার (উঠতি মধ্যবিত্ত) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোণঠাসা। তাদের জান-মাল এবং মর্যাদা বিপন্ন। তাদের সঙ্গে জড়িত আরও কোটি কোটি মানুষ। তাদের বুকে যে আগুন জ্বলেছে, ন্যায়বিচার ছাড়া তাকে নেভানোর আর কোনো রাস্তা নাই।
ছাত্রসমাজের বুকে যে হৃদয়, মাথায় যে বুদ্ধি আছে, তা তো মানুষের; রোবটের না। তারা কি এসবের জবাব চাইবে না? আর এই ন্যায্য প্রশ্ন তুলে শত শত শহীদ হলে দেশবাসী কি চোখে ঠুলি পরে পপকর্ন চিবাবে? সবাই দেখেছে, বন্দুকের পেছনের হাতগুলোয় অনেক অন্যায়ের দাগ। সবাই জানে, দেশে বহুদিন নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় না। সবাই জানে, দেশের সব প্রতিষ্ঠান আর ক্ষমতাকেন্দ্র জনগণকে পোকা মনে করছে। তুলকালাম করা দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমনকি দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকও শান্তিতে নাই।
বহু অনাচার, দুর্নীতি, অপশাসনে যখন দেশের দমবন্ধ, তখন ছাত্রছাত্রীরা সরকারের সঙ্গে দমের পরীক্ষায় নেমেছেন। সমকালের হিসাবে অন্তত ২১০টি লাশ পড়েছে। এসব লাশ নিষ্পাপের, মাসুমের, শিশু-কিশোর-তরুণের। তারপরও দমের পরীক্ষায় তারা জয়ী। আজ দেশের আইনজীবী, শিক্ষকসমাজ, অভিভাবক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের কাতারে শামিল। দেশের নীতি ও যুক্তির ভরকেন্দ্রটা সরে এসেছে ছাত্রছাত্রীদের কাছে। এই দেশটাকে আবার তারা আশাবাদী করে তুলেছে। আবার মানুষ ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। স্বপ্ন-দেখা মানুষ কতটা শক্তিমান হতে পারে, তা প্রিজনভ্যান রুখে দাঁড়ানো তরুণীর ছবিটাই বলে দেয়। ভয়-ভাঙা বাংলাদেশ আজ দারুণ সাহসী।
এই ছাত্র-তরুণরা দেশের বিবেকের শূন্যতাই শুধু পূরণ করছে না, নেতৃত্বের দিশাহীনতাও কাটিয়ে দিচ্ছে। দেশজুড়ে তাদের প্রতি নিরঙ্কুশ ভালোবাসা ও সমর্থনই এর প্রমাণ। সুতরাং তাদের দাবি মানতেই হবে। হত্যাকাণ্ডের বিচার হতেই হবে। পাশাপাশি সরকার যদি মনে করে, তারা ষড়যন্ত্রের শিকার, তাহলে সেই ষড়যন্ত্রের গুমর-ফাঁস তো তাদেরই করতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্র যাদের হাতে, আইন-আদালত যাদের নিকটাত্মীয়, তারা যদি নির্ভয়ে সত্যিটা না বলেন, তাহলে কে বলবে?
বিটিভি ও মেট্রোরেল স্টেশন পোড়ানোর সময় পুলিশ বাহিনী কিছু করল না কেন? সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ কোথায়? যত গুলি সব ‘নাশকতাস্থল’ থেকে দূরে থাকা ছাত্রদের বুকেই লাগল আর ‘নাশকতাকারীরা’ হেলে-দুলে চলে গেল! এমনকি ছাদের ওপর বাবার কোলের শিশু, জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া শিশু, কারখানায় কাজ করা শ্রমিক পর্যন্ত গুলি পৌঁছাতে পারল; দুর্বৃত্তদের গায়ে ফুলের টোকাটি পড়ল না! আন্দোলনকারীরাই এসব নাশকতা করেছে বললে কিন্তু পুরান ঢাকার নির্বাক ঘোড়াগুলোও হেসে ফেলবে।
রাজপথের আগুন তো নিজে থেকে জ্বলেনি। নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলে, ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকবেই। বলপ্রয়োগ ডেকে আনে পাল্টা বলপ্রয়োগ। রাষ্ট্র যতটা নির্দয় হয়েছে, ছাত্ররাও ততটা রুখে দাঁড়িয়েছে। ন্যায্য প্রতিবাদ দমাতে যখন বর্বর নির্যাতন চালানো হয়, তখন মানুষ কি আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে না? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো তাদের এটা শেখায়নি।
এখন আমাদের ফিরে যেতে হবে সমস্যার গোড়ায়। কোনো সমস্যাই কেন আমরা বলপ্রয়োগ ছাড়া মেটাতে পারি না! কেন ভিন্নমত শুনলেই লাঠি-বন্দুকের কথা মনে পড়ে; জেলখানায় ভরার শখ জাগে! যে দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সেই দেশে সহনশীলতাও থাকে না। সেই দেশ একসময় ‘স্বদেশ’ হওয়ার যোগ্যতাও হারায়। অগণতান্ত্রিক দেশ কারও ভালো প্রতিবেশীও হতে পারে না। তেমনি সেই দেশের সরকার কারও ভালো বন্ধু হওয়ারও অযোগ্য। অযোগ্যদের শাসন কত ভয়ংকর, তা বাংলাদেশ জানে। গণতন্ত্র থাকলে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে না।
দেয়ালের লিখন পড়তে না পারলে কপালের লিখন খণ্ডাবে কে? সেটা দেখার আগেও জরুরি কাজ আছে। যে ছেলেটা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হবার সময় কাকুতি করছিল, ‘আঙ্কেল, আমার ছোটো বোন আছে, আমাকে যেতে দিন’। ছেলেটার বাবা-মা বাড়ি ছিল না, কিশোরী বোনটিকে সে বাসায় তালা দিয়ে রেখে রাস্তায় নেমেছিল। ছেলেটি এখনও বাড়ি ফেরেনি, তার ছোট্ট বোনটি কি ভালো আছে?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন