বালির নিচে মাথা লুকালেই দুনিয়া দেখতে পায় না এমন উটপাখির ভাবনা দৃশ্যমান রাখার সুযোগ এখন আর নেই। কাগজের পত্রিকার ধার কমে গেলেও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দাপটে চোখ বন্ধ থাকলেও অনেক কিছুই দেখতে হয়। আমাদের বয়সের শেষ প্রান্তে এসে আমরা এমন কিছু দেখছি যা এর আগে দেখার কথা ভাবাও যেত না। ছোট্ট একটি গ্রামের এক বাড়ির খবর অন্য প্রান্তের বাড়িতে পৌঁছাতে লেগে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এখন দুনিয়ার খবর ঘটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানের কাছে ডঙ্কা বাজে। কোন কোন খবর জন্ম নেয়ার আগেই চলে আসে। বিষয়টি এমন যে, বাংলাদেশের ঢাকা শহরের গুলশানে জঙ্গী হামলা হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে খবর নিতে হয়। মমতা ব্যানার্জি তো বলেই দিয়েছেন, বাংলাদেশ খারাপ থাকলে তার মাটি ভাল থাকতে পারে না। সত্যিকারভাবেই দুনিয়াতে কেউই আমরা এখন আর আলাদা আলাদাভাবে বাঁচতে পারি না। ব্যক্তিগত, সামাজিক, আঞ্চলিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সবই এখন বিনে সুতায় গাঁথা। ভারত-পাকিস্তান-দক্ষিণ এশিয়া নয়, সারা দুনিয়া একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বোকো হারাম গ্রাম পুড়িয়ে দিলে আমি আতঙ্কিত হই, কারণ আমার কন্যা থাকে সেখানে। মালয়েশিয়ার নাইট ক্লাবে বোমা ফাটলে আতঙ্কিত হই, কেননা ছেলে পড়ে ওখানে। আমেরিকায় গুলি হলে আঁতকে উঠি, কোন বন্ধুটা মারা গেল নাকি। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক থেকে সিরিয়া যেখানেই শব্দ ওঠে সেখানেই কোন না কোন বাংলা ভাষাভাষীর রক্ত দেখে ভয় পাই। অবশেষে মধ্যপ্রাচ্যের আইএসের খবর পড়তে পড়তে বাড়ির কাছের গুলশান বা শোলাকিয়ায় তার ভূত দেখি। গুলশানে ভূত, ফকিরাপুলে ভূত। ভূত আমাদের পেয়েই বসেছে। নিজের ছেলের দাড়ি দেখে ভয় পাই। এই স্টাইলের দাড়িওয়ালাই তো জঙ্গী হয়েছে। ওর বন্ধুরা কারা তার খবর নিই। ওর মাকে জিজ্ঞেস করে বোকা হই। কারণ ওরা সবাই ওর কেজি ক্লাসের বন্ধু। বেইলি রোডে বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডা দেয়া তরুণকে দেখলে আঁতকে উঠি। চিনি না, জানি না ফ্ল্যাট বাড়ির কোন তরুণ ঘাতক হয়ে আছে। পুলিশকে দেখলে মায়া লাগে। কোন্ দিন কোন্ চেকপোস্ট তাদের কারও রক্তে ভেজা থাকবে সেটি জানি না। গুলশানে নিহত তিন কিশোর-কিশোরীকে ভুলতে পারি না। হাসিমুখের ইসরাত চোখের সামনে ভাসে। বিদেশীদের ছবিগুলো আতঙ্ক তৈরি করে। ইতালি আর জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্ব সঙ্কটে পড়েছে। এরপর আর কার কার সঙ্গে সঙ্কট হবে জানি না।
তবে গুলশান বা শোলাকিয়ার ঘটনা যতই দূরে যাচ্ছে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ততই রুখে দাঁড়াচ্ছে। চরম দুঃসংবাদের মাঝে আনন্দের একটি খবর হচ্ছে ১০ জুলাই বাংলাদেশ জাকির নায়েককে নিষিদ্ধ করেছে। দেশটির সাম্প্রতিক রাজনীতির ধারায় এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত এবং একাত্তরের পথে পুনযাত্রার প্রতীকী বিজয়।
একাত্তরে ২২ বছর বয়সে যখন বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধে যাই, পাকিস্তান বাহিনীর মতো একটি বিশাল বাহিনীর বিরাটত্ব আমাকে মোটেই আতঙ্কিত করেনি। ছোট্ট ডিঙি নৌকার সামনে দিয়ে গানবোট পার হয়েছে, ইচ্ছে হয়েছে একটা গুলি ছুড়ে ডাঙ্গার কাছে আনি। পাশের থানা শাল্লার হাজার হাজার বাড়িতে পাকিস্তানের দালাল বাংলা ভাষাভাষীদের বাড়িঘরে যখন আগুন দিতে দেখেছি তখন মনে হয়েছে এর বদলা আমি নেবই। বাহাত্তরে ১৬০ জন রাজাকারকে খতম করে সেই বদলা নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন আঁতকে উঠি। নন্দন পার্কে বান্ধবীর কাপড় হাতে নিয়ে বসে থাকা তরুণের দিকে তাকালে আমার ভয় লাগে। কারণ সেই ভয় এখন আমাদের ঘরে ঢুকেছে। আমাদের মেধাবী উজ্জ্বল সন্তানের হাতে চাপাতি দেয়া হচ্ছে। তার প্যান্টে নতুন পকেট হচ্ছে, যাতে চাইনিজ কুড়াল রাখা যায়। আমি যেখানে তার পকেটে স্মার্ট ফোন দেখতে চাই সেখানে চাপাতি প্রবেশ করলে কেন ভয় পাব না? সময়টা কতটা বদলে গেছে যে, আমার প্রবাসী কন্যাও স্থির থাকতে পারে না। সেই নাইজিরিয়া থেকে ফোন করে মেয়ে জানতে চাইছে, বাবা কেমন আছ। তার কাছ থেকেই শোনা, সে যখন তার পড়াশোনার শেষ প্রান্তে তখন তার এক টিচার সমগ্র শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছে তাকে তথাকথিত বেহেশতী বানাবার জন্য। তাকে যুদ্ধ করে নিজেকে সেই শিক্ষকের হাত থেকে মুক্তি পেতে হয়েছে। একই প্রতিষ্ঠানে আমার ছোট ভাইয়ের মেয়েটা পড়েছে। তাকে জঙ্গী বানানো যায়নি, হিজাবী বানানো গেছে। চোখের সামনে দেখেছি শ্যালিকার ছেলেটা বিপথে চলে গেল। কলকাতার হায়দার ভাইয়ের ছেলে বাপ্পি শুরুতে ধর্মকর্ম, পরে তবলিগ; এরপর নেশাগ্রস্ত হয়ে মানসিক রোগীতে পরিণত হলো। ব্যবসা-বাণিজ্য, স্ত্রী-পুত্র হারিয়ে বেঁচে গেল আমার বয়সী তার বাবাটার অস্বাভাবিক দরদের জন্য। নর্থ সাউথের মেধাবী সেই ছেলেগুলো কার মগজ ধোলাইতে জঙ্গী হয়েছে? বাংলাদেশ মেডিক্যাল, নর্থ সাউথসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিষয়ে কি কোন তদন্ত হয়েছে? ওরা কি এখন চিহ্নিত?
প্রশ্ন আছে অনেক। পুরনো প্রশ্ন আর নতুন প্রশ্নে মিলেমিশে এমন একটা জায়গায় আমরা পৌঁছেছি যে, সমস্যার শেকড় সন্ধান না করে পারা যায় না। আমরা যখন অতি দ্রুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা রাখার পথে ধাবিত হচ্ছি তখন ইসলামী জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস কেন জেগে উঠছে সেই প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে তো আমাদের পাকিস্তানোত্তর বাঙালীদের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের দিকে তাকাতে হবে। আমরা তো সবাই জানি বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। ’৪৭ সালে আমরা মুসলিমপ্রধান ভাবনা থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিলাম। ইসলামই যদি আমাদের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান সূত্র হতো তবে আমরা ইসলামীকরণের জন্য আরবী হরফে বাংলা লিখতাম এবং পাকিস্তানের উর্দুর কাছে আত্মসমর্পণ করতাম। আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে নিষেধ করা হয়েছিল। আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে গলা টিপে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আমরা সেই সময়ে কেবল ভাষা আন্দোলন করিনি, নিজেদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং ’৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাঙালীদের প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এটি কোন লুকানো-ছাপানো ঘটনা নয় যে, আমরা ইসলামী রিপাবলিক অব পাকিস্তানকে লাথি মেরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। ফলে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের মীমাংসাটি ’৭১ সালে হয়ে গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে ইসলামের নামে মানুষ খুন, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের কবর হয় একাত্তরে। কিন্তু ’৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে খুন করার পর জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রের চাকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়। খুব বিস্তারিতভাবে না বললেও এটি আমরা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে পারি যে, আজকের বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সঙ্কট তৈরি করেছেন জিয়া, এরশাদ ও বেগম জিয়া। জিয়া একাত্তরের পরাজিতদের রাষ্ট্রীয় আসন প্রদান করেন। এরশাদ ধর্মকে দেশের সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত করেন। জিয়ার সাম্প্রদায়িকতা তোষণের চাইতেও ভয়াবহ ছিল তার হাতে ধর্মের অপব্যবহার। এরশাদ আরও এক ধাপ ওপরে ছিলেন। আটরশির পীর বন্দনা থেকে মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার নামে ক্ষমতায় থাকতে জনপ্রিয়তা বহাল রাখার অপচেষ্টা চরমভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় সত্তাকে আঘাত করেছে। ’৯৬ সালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার আগে দেশটা পাকিস্তান হওয়ার পথেই ছিল। দেশীয় জঙ্গীবাদসহ আন্তর্জাতিক সংশ্রব তখনই জোরদার হয়। কোন প্রকারের রাখঢাক ছাড়া পাকিস্তান তার পরাজয়ের বদলা নেয়ার জন্য তাদের একাত্তরের সাথীদের সহযোগিতা করতে থাকে। শেখ হাসিনা তার দ্বিতীয় মেয়াদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রেক্ষিতে প্রকাশ্যে যেসব প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন তাতে এটি এখন আর কোন সন্দেহের বিষয় নয় যে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের প্রদেশ বানানোর অপচেষ্টা তাদের থামেনি।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি একাত্তরে কথা বললেও যে মূল ভিত্তির ওপর বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত তাকে রাজনীতির কেন্দ্রে বহাল রাখেনি। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন প্রজন্ম সত্যিকারের ইতিহাস পড়ে জানে না যে, এই রাষ্ট্রটি ইসলামী রাষ্ট্র নয়, একটি ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্র রাজনীতি, যুব রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রকে একাত্তরের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তির কথা বলা হয় না। এত বছরেও দেশের ছাত্রছাত্রীরা বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। বরং এখনও নানারকম শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না বা জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয় না। সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
তৃতীয় একটি কারণ সবাইকেই ভাবতে হবে যে, বাংলাদেশের যূথবদ্ধ পারিবারিক জীবন ক্রমেই ধ্বংসের পথে। এক সময়ে পরিবার যেখানে রাষ্ট্রের চাইতেও অনেক বেশি মনিটরিং করত, সেখানে এখন নতুন প্রজন্ম বাবা-মা বা অভিভাবকদের সঙ্গে মোটেই সম্পর্ক রাখে না। অভিভাবকদের একদল সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে বেহেশতের টিকেট কেনার মানসিকতায় আক্রান্ত। অন্য একদল অভিভাবক সন্তানদের ইংরেজী শেখায়, ইংরেজী পড়ায়, ইংরেজীতে ঘুমাতে শেখায়, বাথরুমে যেতে শেখায়। তারা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চেনে না। তারা নিজেরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বা শরতের উত্তরাধিকারী নয়। এমনকি তারা সুনীল-সমরেশ-হুমায়ূন-শামসুর রাহমানের নামও শোনেনি।
দেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য অঙ্গন এখন শূন্যতায়। স্বাধীনতাপূর্বকালে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে প্রগতিশীল ধারা ছিল সেটি নেই। তারুণ্যের সামনে কোন রাজনৈতিক আদর্শ নেই। সংস্কৃতি অঙ্গন পুরোটাই স্থবির। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তরুণরা এখন যে ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশ করে সেখানে বাংলা, বাঙালী আর বাংলা ভাষা নেই। এমনকি নেই বাংলাদেশও। ওরা সারা দুনিয়ার নোংরা ও অশ্লীল উপাত্ত গোগ্রাসে গিলে। যেহেতু ধর্মীয় জঙ্গীবাদের পক্ষে ডিজিটাল প্রচারণা প্রবল এবং তার বিপক্ষে বস্তুত কোন প্রতিরোধই নেই, সেহেতু তারুণ্য জঙ্গীবাদ দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে।
পুরো বিষয়টি মোকাবেলায় প্রথমবারের মতো একটি সাহসী পদক্ষেপ নিল বাংলাদেশ- জাকির নায়কের পিস টিভি বন্ধ করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার পিস স্কুলে যে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ে না বা জাতীয় সঙ্গীত বাজে না তার বিরুদ্ধে একটি শব্দও এখনও আমি শুনিনি। বাংলাদেশ যদি রাষ্ট্রধর্মকে সংবিধানের বাইরে রাখতে পারত এবং পরিপূর্ণভাবে ’৭২ সালের সংবিধান ও তার আদর্শকে রাষ্ট্রের ভিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত তবে আইএস-জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা অন্যরা একাত্তরের রাজাকার-আলবদরেই পরিণত হতো। সবচেয়ে সুখের বিষয় হচ্ছে এই দেশটির জনগণ বাঙালী ও অসাম্প্রদায়িক। ফলে এই দেশ কোনদিন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া বা নাইজিরিয়া হবে না।
ঢাকা, ১৫ জুলাই, ২০১৬
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক
উৎসঃ জনকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন