Image description

মাহতাব উদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশে সিইও হওয়া মানে বিয়েবাড়ির ছাগল হওয়া, ভালো খাবার, বাহবা, আদর যত্ন, তারপর রাতের মেনুতে ঠাঁই। একটুখানি ভুল প্রশ্ন বা কারো অহংবোধে আঘাত লাগলেই কর্নার অফিসটা ফাঁদ মনে হতে থাকে। যে বোর্ড একসময় আপনাকে “পরিবার” বলত, তারাই হঠাৎ করে চোখাচোখি এড়াতে শুরু করে। চাকরির নাম ঝকমকে, কিন্তু আসল খেলা হচ্ছে রাজনীতি, যেখানে টিকে থাকার মন্ত্র পারফরম্যান্স নয়, পলিটিক্যাল স্মার্টনেস।

মজার বিষয় হলো, যখনই কোথাও কোনো করপোরেট অন্যায় ঘটে, কোন এক অদৃশ্য কারণে ফোনটা আমারই বেজে ওঠে। হয়তো কপাল, নয়তো আমি দেশের অনানুষ্ঠানিক, অথচ নিঃস্বার্থ কোচ, থেরাপিস্ট আর সঙ্কটে পড়া সিইওদের হটলাইন হয়ে গেছি। গত সপ্তাহেই, দু’জন সাবেক সহকর্মী, মেধাবী, সৎ, মেরুদণ্ডবিশিষ্ট, তাদের হৃদয়বিদারক গল্প শেয়ার করলেন।

ইশাক (ছদ্মনাম), একসময় আমার সহকর্মী, পরে স্থানীয় একাধিক প্রতিষ্ঠানের সিইও। এক প্রতিষ্ঠানে, তিনি মালিক পক্ষের আত্মীয়দের আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করেন। ফলাফল? কোনো কারণ না দেখিয়ে তড়িঘড়ি পদত্যাগের নির্দেশ, আর সাথে একখানা সার্টিফিকেট—“তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই”। এরপর শুরু হয় পতন। চাকরি মেলে না, একমাত্র বাড়িটা বিক্রি করে ছেলের পড়াশোনা চালান, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, ওজন ২০ কেজি বেড়েছে, আর বছর কয়েক পর দেখা হলে, শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। আমি তাকে কেবল একটা কথাই মনে করিয়ে দেইনি - “এটাই তো বাংলাদেশ”!

দ্বিতীয় কাহিনি নাটকীয়, তবে কম বেদনাদায়ক নয়। একজন আরেকজনের সঙ্গে পেশাগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ অভিযোগ তোলে, “তিনিই কর্মীদের উপর চিৎকার করেছেন”, “স্ট্রেস তৈরি করেছেন”। সঙ্গে সঙ্গেই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি, অভিযোগকারীর ঘনিষ্ঠদের নিয়ে। কোন জালিয়াতি না, কোন দুর্নীতি না, কোন যৌন কেলেঙ্কারি না, শুধুই ক্ষমতার খেলা। পারফরম্যান্স নয়, রাজনীতিই এখানে যোগ্যতার মাপকাঠি।

বিশ্বব্যাপী সিইওদের অপসারণের কারণ সাধারণত থাকে যৌন হয়রানি, জালিয়াতি, ঘুষ, ইনসাইডার ট্রেডিং, কিংবা স্বার্থের সংঘাত। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় গল্পগুলো বেশি রহস্যময়, অহং সংঘর্ষ, দলে দলে ভাগ, কিংবা সাজানো অভিযোগে বিদায়। আজকের সিইওকে শুধু নেতৃত্ব নয়, বেঁচে থাকতেও রাজনীতিবিদ হতে হয়।

আর কিছু কোম্পানি আছে, দেশি হোক বা বিদেশি, যারা “জিরো টলারেন্স” বলে ঢাকঢোল পিটায়, আর ভিতরে ভিতরে রাজনীতিবিদকে ঘুষ দেয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঘোরায়, নিজের এইচআর নীতিমালা নিজের সুবিধায় ব্যবহার করে। এটা দ্বিচারিতা নয়, এটা করপোরেট অ্যাডভান্সড স্ট্র্যাটেজি। শুদ্ধতার বুলি কেবল তখনই চলে, যখন চেকে অতিরিক্ত শূন্য না থাকে।

ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরা ভুলে যায়, খারাপ কাজ লুকিয়ে রাখা যায় না, সময় হলে তার মূল্য চোকাতে হয়।

এমনকি ব্যাংকের সিইওরাও ছাড় পান না, কেউ চুপিসারে বিদায় নেন, কেউ মার খান, কেউ খবরের পাতায় আসেন না। সিনিয়র লিডারদের ঐক্য? এখন কেবল রূপকথা। ভয় সবাইকে চুপ করিয়ে রাখে। “ঐক্যই শক্তি” আর “সঙ্কটে বন্ধু প্রকৃত বন্ধু”, এই বাণীগুলো এখন শুধু স্কুল বিতর্কে চলে, বোর্ডরুমে নয়। আর মিডিয়া? যখন বিজ্ঞাপনের চেক সত্যের চেয়ে জোরে কথা বলে, তখন আর কী আশা করা যায়! তাই সবার নিরাপদ পথ, নীরবতা। আজকাল দাঁড়িয়ে থাকার মানে একাই দাঁড়িয়ে থাকা।

বাংলাদেশে সিইও বা সিএক্সওদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শ্রমিকদের জন্য ২০০৬ সালের শ্রম আইন আছে, কিন্তু সিইওরা তাতে কেবল তখনই পড়েন, যখন WPPF-এ টাকা নিতে হয়। অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতি, হয়রানি বা প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাঁদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই, না আইন, না ইউনিয়ন, না কোনো ফোরাম।

ভারত অন্তত কিছু শিখিয়েছে। সেবি’র LODR রুলস অনুযায়ী, সিইওদের পদত্যাগের কারণ প্রকাশ বাধ্যতামূলক। ন্যাসকম আর সিআইআই-এর মতো সংস্থাগুলো সিইওদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে কাজ করে।

ভবিষ্যতের নেতৃত্বদের জন্য বার্তা স্পষ্ট, এক্সিকিউটিভ চুক্তির আইন, স্বাধীন তদন্ত পদ্ধতি, হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা, এবং সুরক্ষিত প্ল্যাটফর্ম ছাড়া গভার্ন্যান্স থাকবে শুধু মঞ্চে, আর ন্যায়বিচার থাকবে বিজ্ঞাপনের ব্রেকের ফাঁকে।

যতদিন না সিইওদের আইনি ও নীতিগত সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে, ততদিন নেতৃত্ব থাকবে এক চকমকে নাম, যার ভিতরটা ফাঁপা আর ঝুঁকিপূর্ণ।

লেখক: সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)

রবি, বাংলাদেশ।