Image description

ইকতেদার আহমেদ

পাক-ভারত উপমহাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া বলা হয়। পাক-ভারত উপমহাদেশে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা এ সাতটি স্বাধীন দেশ রয়েছে। এ সাতটি দেশ সমন্বয়ে ঝঅঅজঈ গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আফগানিস্তান সার্কের অন্তর্ভুক্ত হলে এ দেশটিও দক্ষিণ এশিয়াভুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমান মিয়ানমারের ভূতপূর্ব বার্মা ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন দ্বারা বার্মাকে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে পৃথক করা হয়।

বার্মার বর্তমান রাখাইন প্রদেশের সাবেক নাম আরাকান। আরাকান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। আরাকান নাফ নদী দ্বারা বাংলাদেশ হতে এবং মূল ভূখণ্ড বার্মা হতে পাহাড় দ্বারা বিচ্ছিন্ন। অতীতে ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে আরাকান বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীতে আরাকান পার্বত্য জেলা এবং দক্ষিণের অধিকাংশ অঞ্চল আরাকান হতে পৃথক করায় বর্তমানে আরাকানের আয়তন ১৪ হাজার ২০০ বর্গমাইল। বেসরকারি হিসাব মতে, আরাকানের লোকসংখ্যা ৫০ লক্ষাধিক এবং বর্তমানে প্রদেশটিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। এ প্রদেশটিতে রাখাইন ও রোহিঙ্গা ছাড়াও প্রায় দুই লক্ষাধিক চাকমা, কামাইস ও বার্মান নাগরিক রয়েছে। বার্মার ১৪টি প্রদেশের মধ্যে একমাত্র আরাকানই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ ছিল। বার্মার ৭০ লাখ মুসলমানের অর্ধেকের বেশি আরাকানের অধিবাসী। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আরাকান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালে বিভাজনের পূর্বে ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭০ ও ২৮ শতাংশ। অবশিষ্ট ২ শতাংশ ছিল খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন প্রভৃতি। উপমহাদেশে স্পষ্টত হিন্দুরা সংখ্যাগুরু এবং মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও বিভাজন-পরবর্তী দেখা গেল হিন্দুরা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ভারতের সামগ্রিক জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মুসলমান। ১৯৪৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ ছিল হিন্দু, বর্তমানে দেশটির হিন্দু জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ। ১৯৪৭ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের হিন্দু জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ, বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে রূপান্তরিত দেশটিতে হিন্দু জনগোষ্ঠী হলো ৮ শতাংশ। উপর্যুক্ত পরিসংখ্যান হতে ধারণা পাওয়া যায় ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজনের পর থেকে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে প্রধান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হ্রাস ঘটতে থাকে এবং এ ধারাটি অব্যাহত আছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অব্যাহত দেশ ত্যাগ হতে ধারণা পাওয়া যায় তাদের একটি অংশ কখনো নিজ মাতৃভূমিতে নিজেদেরকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সাথে রাজনৈতিকভাবে সমরূপ ভাবতে সচেষ্ট ছিলেন না।

ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম ১৯৪৬ সালে যে কেবিনেট মিশন প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় তাতে বলা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের প্রদেশ সমন্বয়ে গ্রুপ (ক) পশ্চিমাংশের মুসলিম অধ্যুষিত সিন্ধু, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ও বেলুচিস্তান সমন্বয়ে গ্রুপ (খ) পূর্বাংশের মুসলিম অধ্যুষিত বাংলা ও আসাম সমন্বয়ে গ্রুপ (গ) এ তিনটি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তিতে ভারতীয় ইউনিয়ন গঠিত হবে। কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, মুদ্রা ও যোগাযোগ, প্রদেশসমূহ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। এ প্রস্তাবের প্রতি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সর্বসম্মত সমর্থন না থাকায় তা কার্যকর হতে পারেনি। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে বলা হয় হিন্দু জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত প্রদেশ সমন্বয়ে হিন্দু রাষ্ট্র এবং মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ সমন্বয়ে মুসলিম রাষ্ট্র গঠিত হবে। এর বাইরে কিছু করদমিত্র রাজ্যের শাসকদের স্বাধীন থাকা অথবা মুসলিম অথবা হিন্দু অধ্যুষিত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়। সে সময় ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি প্রদেশ সমন্বয়ে গঠিত হায়দরাবাদ হিন্দু অধ্যুষিত হলেও এ অঞ্চলটির শাসক ছিলেন মুসলিম। হায়দরাবাদের মতো মধ্যাঞ্চলের জুনাগড় হিন্দু অধ্যুষিত হলেও এর শাসক ছিল মুসলিম অপরদিকে কাশ্মির মুসলিম অধ্যুষিত হলেও এর শাসক ছিল হিন্দু। এ তিনটি অঞ্চলের মধ্যে প্রথমোক্ত দু’টির শাসকরা প্রথমত স্বাধীন থাকা বিষয়ে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। অতঃপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে পরাজয় এড়াতে পাকিস্তানের সপক্ষে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে এলাকাটির শাসক ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দিলে সেখানে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করতে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। বর্তমানে কাশ্মিরের ৪৩ শতাংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে, ৩৭ শতাংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে এবং অবশিষ্ট ২০ শতাংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে।

ব্রিটিশদের ঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিমাংশের পাঞ্জাব এবং পূর্বাংশের বাংলা মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার কারণে উভয় প্রদেশ মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাষ্ট্রে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। ভারতবর্ষ বিভাজনের অব্যবহিত পূর্বে এ দু’টি প্রদেশে ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দেখা দেয়। সে সময় হিন্দু নেতাদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজন ব্যতীত তারা ভারতবর্ষের বিভাজন মেনে নেবেন না। হিন্দু নেতাদের অনড় অবস্থানের কারণেই মুসলিম অধ্যুষিত পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজনের মুখে পড়ে।

ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদশ ব্যতীত নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মধ্যে একমাত্র নেপালই হচ্ছে ভারতের মতো হিন্দু জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাষ্ট্র। নেপালের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৮০.৬২ শতাংশ হিন্দু। আবার এদের মধ্যে ১৯.৩ শতাংশ ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশের ‘মাধেসি’ নামে অভিহিত অভিবাসী। এ দেশটিতে বৌদ্ধ ও মুসলিম জনগোষ্ঠী যথাক্রমে ১০.৭৪ শতাংশ এবং ৪.২০ শতাংশ। ভুটানের মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের ৩ ভাগ বৌদ্ধ এবং ৪ ভাগের ১ ভাগ হিন্দু। শ্রীলঙ্কার সামগ্রিক জনসংখ্যার ৭০.২ শতাংশ বৌদ্ধ, ১২.৬ শতাংশ হিন্দু এবং ৯.৭ শতাংশ মুসলমান। আফগানিস্তানের জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ মুসলমান। মালদ্বীপের জনসংখ্যার ৯৮.৪ শতাংশ মুসলমান।

আয়তন ও জনসংখ্যা উভয় দিক থেকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ ভারতে বসবাস করে। আফগানিস্তান ব্যতীত সার্কভুক্ত সব দেশের সাথে ভারতের জল অথবা স্থলসীমা রয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে ভারত চীনের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ দেশ হওয়ার কারণে ভারতের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আশ্চর্যজনকভাবে ভারতের কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত তার প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানের ওপর কিছুমাত্রায় প্রভাব ফেলে।

ভারতের বিগত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও এর জোটভুক্ত এনডিএর অপরাপর সহযোগী দল সরকার গঠনের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এ কারণে জোটভুক্ত দলগুলো থেকে কয়েকজনকে মন্ত্রী পদ দেয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু সরকারের সার্বিক কার্যক্রমে বিজেপি তার একক কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখে। এর ফলে ভারতে বর্তমানে এমন একটি সরকার ক্ষমতাসীন যেটি প্রকৃতিগত দিক থেকে রাজনৈতিকভাবে সমরূপ।

আরএসএস হিসেবে সংক্ষেপিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘটি ভারতীয় ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধা-সামরিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যা ভারতের ক্ষমতাসীন দলের মতাদর্শগত অংশীদার হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। আরএসএস একটি বড় সংগঠনের জনক ও নেতা। এটি সংঘ পরিবার বা আরএসএস পরিবার নামে পরিচিত যা ভারতীয় সমাজের সব দিককে প্রভাবিত করে। ১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত আরএসএস বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংঘ পরিবারের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি রয়েছে। প্রথম কর্মসূচিটি হলো ভারতকে হিন্দুত্ব রাষ্ট্রে পরিণত করা। এ প্রসঙ্গে আরএসএস প্রধান মোহন ভগবাত বলেন, ‘ভারতীয়দের প্রধান পরিচয় হবে হিন্দুত্ব। সব বিশ্বাসীর এখানে হিন্দুদের আদি পরিচয়ের সাথে পরিচিত হতে হবে। এটিই ভারতীয় সংস্কৃতির ঐক্যের প্রতীক। সাধারণ মানুষের নিকট এ সংস্কৃতিটি হিন্দু সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত। হিন্দুত্ব আমাদের দেশে ঐক্যের ভিত্তি। বিশ্বের কাছে ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। সুতরাং হিন্দুত্ব হলো ভারতের পরিচয়।’ দ্বিতীয় কর্মসূচিটি হলো হিন্দুত্বের ভিত্তিতে হিন্দু সমাজ সংগঠিত করা এবং যারা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছেন তাদেরকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা।

দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে সব ধর্ম ও বিশ্বাসের মধ্যে যে সহমর্মিতা ছিল হিন্দুত্ববাদের উত্থান ভারতীয় সংস্কৃতির একটি বড় ধরনের রূপান্তর। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের এ বার্তার মধ্য দিয়ে বিজেপি কখনো ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমানদের সমর্থন কামনা করে না। বর্তমানে লোকসভায় বিজেপি থেকে নির্বাচিত কোনো মুসলিম সংসদ সদস্য নেই।

ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভার যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য প্রদানকালে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের অনুপ্রবেশ-প্রবণ অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিয়ে নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন প্রক্রিয়া (এনআরসি) বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য কাজ করছে; অপরদিকে বিশ্বাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের প্রচেষ্টা করা হবে। এই সংশোধনীটি কার্যকর করা হলে ধর্মীয় কারণে হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নিতে চাইলে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।

ইতঃপূর্বে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি দলের প্রভাবশালী নেতা অমিত শাহ রাজ্যের নির্বাচনী জনসভায় বলেন, এনআরসি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পশ্চিমবঙ্গ হতে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। এ বক্তব্য প্রদানকালে মোদি কিছুটা রক্ষণশীল হলেও অমিত শাহ কোনো রাখঢাক না রেখে খোলামেলাভাবে বিষয়টি বলেন। নির্বাচনী প্রচারণাকালে মোদি-অমিত শাহের বক্তব্যের পর ভোটারদের মধ্যে ধারণা জন্মেছিল, ভোটারদের সমর্থন আদায়ের জন্য এটি এক ধরনের মেরুকরণের প্রয়াস। লোকসভার উদ্বোধনী অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণে নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিক নিবন্ধন সংশোধনের ঘোষণা হতে এটি অনেকটা স্পষ্ট যে, বিজেপি সরকার তাদের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে।

১৯৫১ সালে আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ১৯৫১ পরবর্তী ২০১৫ সালে আসামে প্রথম নাগরিক নিবন্ধন হালনাগাদের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ ২৪ মার্চ ১৯৭১ (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দু’দিন আগে) পরবর্তী জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে তাকে ভারতীয় নাগরিকত্বের দলিল প্রদানের জন্য বলা হবে। জুলাই ২০১৮ সালে ভারত সরকার এনআরসির খসড়া হালনাগাদ প্রকাশ করে যাতে ৪০ লাখ ৭০ হাজার (প্রায় ১৩ শতাংশ) নাগরিককে বাদ দেয়া হয় এ কথা বলে যে, তারা নাগরিক নিবন্ধনের দলিল প্রদানে অসমর্থ হয়। তারপর খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়া হাজার হাজার নাগরিক আপত্তি দায়ের করে। নাগরিক নিবন্ধন তালিকা চূড়ান্ত পরবর্তী তা প্রকাশের জন্য অপেক্ষমাণ। এ তালিকা থেকে বাদ পড়া নাগরিকরা রাষ্ট্রহীন অথবা বিদেশী নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হবে।

এ ধরনের নাগরিকত্ব নীতি অনুসরণ করে বিশ্বে এমন একটি মাত্র উদাহরণ রয়েছে। একমাত্র ইসরাইল ধর্মের ভিত্তিতে এই সুযোগ দেয়। ইহুদি মায়ের গর্ভজাত পৃথিবীর যেকোনো দেশের নাগরিক ইসরাইলের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারে। ভারতের বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে একদিকে সব হিন্দু জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করতে চায়, অপরদিকে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের অনাগরিক অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করার চেষ্টায় রত।

ভারতে এনআরসি বাস্তবায়নে একটি বড় প্রভাব পড়তে পারে। আরএসএসের মতে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হলো বাংলাদেশ ও পাকিস্তান হতে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং দ্বিতীয় কারণ হলো মুসলমানদের জন্মহার অন্যদের চেয়ে অধিক। যদিও ১৯৪৭ পরবর্তী আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনগোষ্ঠীর কোনো শতকরা বৃদ্ধি নেই। এখনো আসামে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে যা পশ্চিমবঙ্গেও করা হতে পারে। অমিত শাহ এ ক্ষুদ্র রাজ্য থেকে বাংলাদেশের কথিত অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠাতে বদ্ধপরিকর। অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত বহু মানুষকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আসাম রাজ্যে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত অর্ধেককেও যদি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয় তাহলে সংখ্যাটি হবে ২০ লক্ষাধিক। পশ্চিমবাংলায়ও যদি অনুরূপ প্রবণতা দেখা যায় সে ক্ষেত্রে সংখ্যাটি হবে ৫০ লক্ষাধিক। অমিত শাহের বক্তব্য অনুযায়ী ৭০ লাখ লোককে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে বাংলাদেশের জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে।

কাশ্মির বিষয়ে ভারতের সাথে পাকিস্তানের অবস্থান সবসময় আপস অযোগ্য। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির বিষয়ে বিজেপি ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর বিলুপ্তি ঘটানো পরবর্তী সুপ্রিম কোর্টে মামলা হলে তা বিলুপ্তির সপক্ষে যায়। এ কারণে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। আসাম ও পশ্চিম বাংলায়ও একই ধরনের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশে যে অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে অনুরূপ অস্থিতিশীলতা কাশ্মিরসহ দক্ষিণ এশিয়ায় দেখা দেবে।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বিতাড়িত ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। মিয়ানমারের মতো ভারতও তার দু’টি রাজ্য নাগরিকত্ব হরণ করতে চায়। ভারতের এ দু’টি রাজ্য ছাড়াও বিহার ও উত্তর প্রদেশের মুসলমানরা বিজেপি তৃতীয় দফায় সরকার গঠন পরবর্তী চরমভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে এবং কতিপয় ক্ষেত্রে হত্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মুসলমানদের জোর করে জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করা হচ্ছে, না বললে মারধর করে হত্যা করা হচ্ছে। এভাবে নির্বাচনে বিজয়-পরবর্তী এযাবৎকাল পর্যন্ত প্রায় এক শ’র কাছাকাছি মুসলমান সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়েছে। ভারত ও মিয়ানমার ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার অপর দেশগুলো যথা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে বসবাস করছে। ভারত ও মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানরা নিপীড়ন ও হত্যার সম্মুখীন হয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে সংখ্যালঘুদের এ ধরনের নিপীড়ন ও হত্যার ঘটনা বিরল। আর তাই এ কথাটি অনেকটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভারত ও মিয়ানমার ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর দেশ সংখ্যালঘুদের জন্য অনেকটা নিরাপদ।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক