
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশের মানুষ আজ প্রাণের উৎসবে মেতে উঠবে। কী শহর, কী নগর, গ্রামেগঞ্জে নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২কে স্বাগত জানানো হবে। ঢোলের শব্দ, বাঁশির সুর আর নৃত্যের রিনিঝিনি ঝংকারে এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি হবে সর্বত্র। কোথাও বসবে বৈশাখী মেলা, কোথাও দেখা যাবে হালখাতার অনুষ্ঠান। জারিগান, সারি গান পালা গানের আসর আর বাউল গানে মাতোয়ারা হবে প্রতিটি অঙ্গন।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন উৎসবের দিন। গ্রামাঞ্চলে এই দিনকে কেন্দ্র করে বাংলা পঞ্জিকা ধরে কৃষকরা বীজ বোনেন, চারা লাগান, ফসল কাটেন। শহর-নগরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আনন্দ শোভাযাত্রা বর্ষবরণকে আকর্ষণীয় করে তোলে। শহরে একদিনের জন্য সবাই বাঙালি হয়ে যায়। নববর্ষের প্রকৃতি সংস্কৃতিতে পান্তা-ইলিশ কোনো কালেই ছিল না। কিন্তু এই পান্তা-ইলিশ এখন পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে। নগরীর সব হোটেলেই পান্তা-ইলিশের আয়োজন থাকে। পাঁচ তারকা হোটেলগুলোও বাদ যায় না। তাদের মেন্যুতে আজ থাকবে বাঙালি খাবারের সব উপাদেয় পদ। আমাদের রিপোর্টার খবর এনেছেন পহেলা বৈশাখের আজকের দিনটিতে সোনারগাঁও হোটেলে শুঁটকির ভর্তা ও কাঁচা আমের ভর্তা থাকবে। ইলিশ-পান্তার পাশাপাশি কাঁচকি মাছের চচ্চরি আর সজনের ডালও থাকবে। তেমনি আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, শাক-সবজিও থাকবে খাবার মেন্যুতে।
নারী-পুরুষ শিশুরা বৈশাখী ফ্যাশনের জামা-কাপড় পরে নববর্ষকে রঙিন করে তুলবে। বৈশাখী ফ্যাশনও উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। তাই ফ্যাশন হাউসগুলো বাঙালি সংস্কৃতির ঢঙে জামা-কাপড় এনেছে বাজারে। দেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে পহেলা বৈশাখের মেলা বসে না। পহেলা বৈশাখের এই দিনে সারা দেশে অন্তত পাঁচশ মেলার আয়োজন হয়। সেই সঙ্গে কোথাও নৌকা বাইচ, কোথাও পুতুল নাচ, কুস্তি, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াইয়ে কত কী যে আনন্দ!
বিশাখা থেকে বৈশাখ
বাঙালির কাছে পহেলা বৈশাখ থেকে নববর্ষ। এ অঞ্চলের আদি সাহিত্য থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের দক্ষ রাজার একটি কন্যার স্বভাব ছিল উগ্র মেজাজের। সে ছিল খরতাপময়। তার নাম রাখা হয় বিশাখা। একটি নক্ষত্রের নামে নাম। আর এই নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাসের নাম হয়েছে বৈশাখ। পুঁথিতে রচিত হয়েছে-
‘বিশাখা হইতে মাস হইল বৈশাখ
আরম্ভিলা গ্রীষ্মকাল প্রখর নিদাঘ
এই মাস হতে বঙ্গে বর্ষ শুরু হয়’
এভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতেই বৈশাখকে বছর শুরুর প্রথম মাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
বাংলা নববর্ষ যেভাবে শুরু
ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা খাজনাপত্র আদান-প্রদান করার জন্য হিজরি পঞ্জিকা অনুসরণ করতেন। কৃষিজাত পণ্যের খাজনা আদায়ের জন্য এটাই ছিল রীতি। কিন্তু হিজরি সন নির্ভরশীল ছিল চাঁদের ওপর। ফলে তা এ অঞ্চলের কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। তাই সম্রাট আকবর কৃষি কাজের সঙ্গে মিল রেখে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে একটি সন প্রবর্তনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাংলা সনের জন্মের জন্য তার সভাসদের একদল সদস্য আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী মাসের নামগুলো পুরনো ভারতীয় সৌরমত রেখে সৌর-হিন্দু ও চান্দ্র-হিজরি বর্ষপঞ্জির ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা পর্ষপঞ্জি তৈরি করেন। প্রথমে এই সনকে বলা হতো ফসলি সন। এভাবেই পহেলা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ বলে সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন। হিজরি চান্দ্র বর্ষের সমস্যা ছিল প্রতি বছর ১১ দিন করে এগিয়ে যেত। আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজ এ সমস্যার সমাধান করেন চান্দ্র বছরের হিসাবকে সৌর বছরের গণনায় রূপান্তর করে। হিজরি ৯৬৩ সন থেকে উৎপত্তি বাংলা সনের। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের দিনে চালু হয় বাংলা সন তথা বাংলা নববর্ষ। বাঙালি জীবনের সঙ্গে ফসল ফলানো ও আহরণের বিষয়টা ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৃষ্টি আর বন্যার পানিতে ভেসে আসা পলি হলো কৃষকের কৃষি কাজের জন্য একমাত্র সহায়। কৃষকের সম্বল হচ্ছে একজোড়া বলদ আর একখানা লাঙল। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে চাষিরা করতেন কৃষি কাজ। প্রযুক্তি এখন সেই জায়গা দখল করেছে। কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে এসেছে কলের নাঙ্গল। সেকালে বাংলা নববর্ষের প্রথম অনুষ্ঠানকে ‘হলপ্রবাহ’ বলা হতো। সেই ছিল জমি আগাছামুক্ত করে উর্বর করার আয়োজন। বৈশাখ সংক্রান্তির দিনে গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে একজোড়া আনাড়ি ষাঁড়ের গলায় নতুন ফলাযুক্ত লাঙল জুড়ে দিয়ে ক্ষেতে ছেড়ে দেওয়া হতো। ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে তাড়া করত ষাঁড়কে। ষাঁড়গুলো লেজ তুলে ক্ষেতে দৌড়াত। ষাঁড় দৌড়ে যতগুলো ক্ষেত স্পর্শ করত, চাষিরা মনে করত সেগুলোতে ভালো ফসল হবে মৌসুমে।
আমানি উৎসব ও হালখাতা
এ দেশের প্রাচীন একটি কৃষি উৎসব হচ্ছে ‘আমানি’। পারিবারিক উৎসব হিসেবে এটি পালিত হতো। বাংলা নববর্ষের দিনে বাড়ির গিন্নি আম গাছের কচি পাতার একটি ডগা রাতের বেলা একটি মাটির ঘটিতে ভিজিয়ে রাখতেন। ভোরবেলায় কৃষক স্বামী বা ছেলে জমিতে হাল চাষে যাওয়ার সময় শরীরে ছিটিয়ে দিতেন। বিশ্বাস ছিল এতে সারা বছরের জন্য কল্যাণ আছে। অনেক গবেষকের লেখা থেকে জানা যায়, গ্রামবাংলার নববর্ষের উৎসবের সূচনা এই ‘আমানি উৎসব’ থেকে। এর সঙ্গে ছিল বৈশাখী মেলা।
এদেশে জমিদারি প্রথা শুরুর পর উদযাপিত হতে লাগল ‘পুণ্যাহ উৎসব’। ব্যবসায়ীরা এদিন হালখাতা অনুষ্ঠানের প্রচলন করেন। সম্রাট আকবরের শাসনকালে ‘শুভ হালখাতা’ নামে অনুষ্ঠাটির আয়োজন হতো। সেই অনুষ্ঠানে খাজনা পরিশোধকারী প্রজাদের দেওয়া হতো নতুন পোশাক। আপ্যায়ন হতো নানা মিষ্টান্ন দিয়ে। হালখাতার অনুষ্ঠান কমে এলেও এখনো ব্যবসায়ী মহলে এর প্রচলন দেখা যায়। হালখাতা অনুষ্ঠানে দেনা পরিশোধ করেন ব্যবসায়ীরা। রাজধানী ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজারে হালখাতার অনুষ্ঠান বেশি দেখা যায়। তেমনি জুয়েলারি বা সোনার দোকানগুলোতে রয়েছে হালখাতার প্রচলন।
নববর্ষে পাহাড়িদের অনুষ্ঠান
চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীও বাংলা নববর্ষের দিনে নানা অনুষ্ঠান করে আনন্দে মেতে থাকেন। পাহাড়িদের মধ্যে প্রধান তিনটি সম্প্রদায় চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের মধ্যে ঘটা করে নববর্ষ উৎসব উদ্যাপন করতে দেখা যায়। এই উৎসব ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত। চাকমাদের উৎসবের নাম হচ্ছে ‘বিজু’, ত্রিপুরায় ‘বৈসু’ আর মারমাদের ‘সাংগ্রাই’। বৈসাবী উৎসবের দিন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিশুরা গাছ থেকে ফুল সংগ্রহ করে ঘর সাজায়। ঝুড়িতে ধান ভরে নিয়ে গায়ে ঘুরে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। মারমারা সাংগ্রাই উৎসবে চালের গুঁড়ি দিয়ে পিঠা বানায়। ফুল ভাসিয়ে দেয় নদী বা হ্রদের পানিতে। এটি বৈসু বলে পরিচিত। চাকমারা এদিন পাজোন নামে বিশেষ খাবার তৈরি করে। তারা আকাশ প্রদীপ জ্বালায়। বাজি ফোটায়। তেমনি ম্রো জনগোষ্ঠী করে ‘চাংক্রোন পিই’ নামে অনুষ্ঠান।
নববর্ষের প্রকৃতি ও খেলাধুলা
বৈশাখে বাংলাদেশের প্রকৃতিও যেন নতুন করে সেজে ওঠে। ফোটে জারুল, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, স্বর্ণচাপা, গুলাচি। বৈশাখী ফুলগুলো বড়ই মনোহর।
পহেলা বৈশাখে কাবাডি বা হা-ডু-ডু খেলা গ্রামগঞ্জে খুব আনন্দের সৃষ্টি করে। তেমনি হয় গোল্লাছুট ও লাঠিখেলা। বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় খেলাও চমক সৃষ্টি করে। তেমন চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলা।
মেলা, বৈশাখী মেলা
তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বৈশাখী মেলাই পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের প্রধান আকর্ষণ। মেলা ছাড়া পহেলা বৈশাখ জমে না। শহরেও এখন এই বৈশাখী মেলার দারুণ কদর। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, পহেলা বৈশাখের মেলা, বারুনীর মেলা, চড়কের মেলা কত নামে যে মেলা হয় তার কোনো হিসাব নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষেরই এই মেলা নিয়ে আছে মধুর স্মৃতি। বিশেষ করে ছোটবেলায় বড়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মেলায় যাওয়া, নাগরদোলায় চড়া, চুলের ফিতা, নখপলিশ ও মুরালি কেনা, বাঁশি কেনা, আম কাটার চাকু কেনার রোমান্টিক স্মৃতি আছে বড়দের কাছে।
আগেই বলেছি পহেলা বৈশাখের উদ্যাপন বেশিরভাগ মানুষের জন্য বৈশাখী মেলার মাধ্যমে। গ্রামগঞ্জে শিশু-কিশোররা এই মেলার জন্য বিশেষ প্রতীক্ষায় থাকে। মেলার দিন ভোরের আমেজ ধরা বাতাসে এবং বেলা বেড়ে গেলে চড়া রোদ মাথায় নিয়ে মেলায় ঘোরাফেরা। মেলা বসে সাধারণত অশ্বত্থ বা বট গাছের ছায়ায়। বাঁশির সুর, ঢোলের শব্দ আর ভাজা জিলাপিসহ মিঠাই-মন্ডার মৌ মৌ গন্ধে অন্যরকম এক পরিবেশ। হাওয়া মিঠাই আর তোকমার শরবত লাল রঙে মেলার আরেক আকর্ষণ। মনোহরি জিনিসপত্রের পাশাপাশি মেলায় কৃষকরা তরমুজ, ক্ষিরা, বাঙ্গি, উচ্ছে করলা, শাক-সবজি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন। তেমনি মেলায় ওঠে ঘরোয়া জিনিসপত্র-কুলা, চালুনি, বেলুনি-পিঁড়ি কিংবা চাষাদের জিনিসপত্র।
বাঙালি সংস্কৃতি
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই যে মেলা, এই যে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন এর মধ্য দিয়ে একটি সচেতন জাতির পরিচয় ফুটে ওঠে। বাংলা নববর্ষ এভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরে।