
মাসুম খলিলী
প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবেই নয়, সেই সাথে চীনের সাথে কয়েক দশক ধরে তার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে তার কারণে তিনি এমন এক অবস্থানে রয়েছেন যে, দুই বিশ্বশক্তির মধ্যে কোনো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে সমঝোতার প্রয়োজন হলে তিনি সে ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তিত্ব হতে পারেন। আর তিনি ড. খলিলের মতো এমন ব্যক্তিত্বদের সহযোগী বা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে কাজের যথেষ্ট দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যকরভাবে বরফ গলায় সেটি আবারো প্রমাণ হয়েছে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা প্রকাশ করা হয়েছে বে-অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) সম্মেলনে। ব্যাংককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে, মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান সুই প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানকে জানিয়েছেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরার জন্য ‘যোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর বাইরে আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গার চূড়ান্ত যাচাইকরণ, তাদের ছবি ও নাম আরো যাচাই-বাছাইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। মূল তালিকায় থাকা বাকি পাঁচ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি। যদিও মিয়ানমারের কাছ থেকে এই আশ্বাসগুলো গুরুত্বপূর্ণ, তবে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা এখনো বাকি রয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো-সেটি কিভাবে হতে পারে?
মাঠের বাস্তবতা ও রোহিঙ্গা পুনর্বাসন
এখনকার বাস্তবতা হলো, ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরে সঙ্কুচিত অবস্থায় বসবাস করছে। তাদের দুর্দশা বাড়াতে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন সহিংসতা শুরু হওয়ার সাথে সাথে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে প্রায় এক লাখ অতিরিক্ত রোহিঙ্গা তাদের সাথে যোগ দেয়। আগস্ট ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যামূলক দমন-পীড়নের পরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মূল তালিকাটি মিয়ানমার সরকারকে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ছয় ধাপে দেয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পদক্ষেপকে গণহত্যা বলে নিন্দা করেছে, তখন তাদের (মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধিদের) জাতিগত নিধনের শিকারদের যাচাই-বাছাই করার অনুমতি দেয়ার জন্য তারা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করেছিল। সে অনুরোধে তখন সাড়া দেয়া হয়। এখন যখন তারা (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী) কার্যত বিদ্রোহী আরাকান আর্মির কাছে রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, তখন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে। এটি এ কারণে হতে পারে যে, যাদের স্বার্থে বা সমঝোতায় রোহিঙ্গাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল তারা মিয়ানমার সেনা সদস্যদের বিতাড়িত ও মৃত্যুর জন্য নিশানা করছে। ‘যোগ্য’ রোহিঙ্গা সদস্যদের নিয়ে নে পাই তাও কর্তৃপক্ষের পুনর্বাসনের বিষয়ে বাস্তবে খুব বেশি কিছু করার না থাকলেও এর আইনানুগ বৈধতার মূল্য রয়েছে। এই বৈধতার বাইরে গিয়ে আরাকান আর্মির সাথে সমঝোতা করে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে একটি খটকা থেকে যেত। আর এখনকার বাস্তবতা হলো মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে আরাকান আর্মির রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনমনীয়তা বেশি।
প্রশ্ন উঠেছে, সামরিক জান্তা বর্তমানে আরাকান আর্মিকে দৃশ্যপটের বাইরে রেখে রোহিঙ্গা সদস্যদের পুনর্বাসনের বাস্তবে কোনো কিছু কি করতে পারবে? জান্তা সরকার এই মুহূর্তে রাখাইন রাজ্যের বৈধ কর্তৃত্ব হিসেবে আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দেয় না। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জান্তার বর্তমান প্রস্তাবকে আরাকান আর্মির গ্রহণ করার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাতে দাবি করা হয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের জোরপূর্বক নিয়োগের অংশ হিসেবে এক হাজার রোহিঙ্গা পুরুষ ও বালককে অপহরণ করেছে এবং শিশু সৈন্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক নিয়োগ করেছে। মিয়ানমারের সামরিক শাসক ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এই অবৈধ কাজটি চালিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে। আশ্চর্যজনক হলেও মিয়ানমার জান্তা যদি এ ক্ষেত্রে আদৌ কোনো আইন অনুসরণ করে, তবে এটি একটি নিয়োগ আইন ব্যবহার করছে, যা শুধু মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু রোহিঙ্গারা এই নিয়োগ আইনের আওতায় পড়ে না, কারণ তারা দেশটির ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত নয়। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারে অবশিষ্ট রোহিঙ্গা জনসংখ্যার সাথে এখন যা ঘটছে তা আরো জঘন্য।
মানবিক করিডোরের আহ্বান
এ দিকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে যাওয়া ও তাদের সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক অর্থায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস তাদের যথাযথভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে বিমসটেকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সদস্য দেশগুলোকে মিয়ানমারের বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সংলাপ শুরু করার এবং রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান।
দুর্ভাগ্যবশত, গত আট বছরে একাধিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে, বিমসটেক-সহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোর জন্য এই দীর্ঘায়িত সঙ্কট মোকাবেলায় সক্রিয়ভাবে জড়িত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা আরো সতর্ক করেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু অমীমাংসিত রেখে গেলে পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচিও (ইউএনডিপি) রাখাইনে আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করেছে। এই কারণে প্রধান উপদেষ্টা জনগণকে প্রয়োজনীয় সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং আরো বাস্তুচ্যুতি রোধ করতে রাখাইনে একটি মানবিক চ্যানেল প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের সুবিধার্থে রাখাইনে একটি অনুকূল ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে মিয়ানমারকে। সেখানকার কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব, চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ ও অন্যান্য মৌলিক মানবাধিকার প্রদান করতে হবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমর্থনে ইতোমধ্যে যথেষ্ট চাপের মধ্যে থাকা বাংলাদেশ, বৈদেশিক সাহায্য হ্রাসের কারণে অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। সুতরাং, যত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে, ততই বাংলাদেশ ও এতদঞ্চল উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা পুরুষ ও ছেলেদের নাগরিকত্বের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে জোরপূর্বক নিয়োগ করা হচ্ছে, অথবা গ্রেফতারের হুমকি দেয়া হচ্ছে বা রাতের বেলা অভিযানে তুলে নেয়া হচ্ছে এবং তারপর আরাকান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ফ্রন্টে পাঠানোর আগে দুই সপ্তাহের জন্য প্রশিক্ষণের নামে আরেক দফা নির্যাতনের শিকার হতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই ঘৃণ্য কৌশলে মিয়ানমারের জান্তা এক ঢিলে দুই পাখি মারছে। এক দিকে রোহিঙ্গাদের চাপের মধ্যে নিয়োগ করা হচ্ছে, যারা যুদ্ধ ফ্রন্টের সামনের দিকে নিহত হচ্ছে এবং অন্য দিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির শত্রুতা আরো তীব্র করছে।
আসলে ২০২৪ সালের মে থেকে জান্তা সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পরে রাখাইন রাজ্যের বুথিডাং এবং মংডু শহর আরাকান আর্মি দখলে নেয়ার পর থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়ার পর বিশেষভাবে এটি ঘটে। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ছুটির পর ওই টাউনশিপে আরাকান আর্মি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা ও তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া শুরু হয়। স্পষ্টতই, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রোহিঙ্গারা এখন তাতমাদও (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) এবং আরাকান আর্মি উভয়েরই সাধারণ লক্ষ্য। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে তাদের পৈতৃক মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে অনেকের আশঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে কেবল নেইপিডোর জান্তার সাথে যেকোনো চুক্তি করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ধারণা প্রশ্নসাপেক্ষ। দৃশ্যপটে আরাকান আর্মির আবির্ভাবকে একটি শক্তি হিসেবে গণ্য করার প্রয়োজন রয়েছে।
সরকারের প্রচেষ্টা, আরাকান আর্মি ও নিরাপদ জোন
রোহিঙ্গা-বিষয়ক হাই-রিপ্রেজেন্টিটিভ ড. খলিলুর রহমানের সাথে আলোচনা করে আমার মনে হয়েছে তিনি রাখাইন রাজ্যের এই বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন। তিনি জানেন যে, রাখাইনের ৯০ শতাংশ অঞ্চল আরাকান আর্মির দখলে থাকা অবস্থায় সামরিক জান্তা সরকার একমত হলেই রোহিঙ্গাদের বাস্তব প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। কিন্তু মিয়ানমারের বৈধ আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সরকার হলো ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার। এই সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয় এবং তাদের নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিলে সেটি রোহিঙ্গাদের জন্য আইনানুগ অধিকারের স্বীকৃতি।
এই স্বীকৃতির পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে দু’টি রাস্তা খোলা থাকতে পারে। প্রথমত, মাঠের দখলদার শক্তি আরাকান আর্মির সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন
প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা এবং তাদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জাতিসঙ্ঘ বা আসিয়ানের একটি শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা। আরাকান আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমির সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। ড. খলিল ও অন্য কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, আরাকান আর্মির সাথে আনুষ্ঠানিক না হলেও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থার যোগাযোগ রয়েছে।
এই চ্যানেল ব্যবহার করে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার যেসব বিষয়ে সম্মত হয়েছে সেসব বিষয়ে আরাকান আর্মিকেও সম্মত করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পুরো রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ব্যবস্থা না করা গেলেও অন্তত ঐতিহাসিককাল থেকে আরাকানের যেসব অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসতি ছিল সেসব অঞ্চলে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ২০১৭ সালের আগে মংড়ু শহরে ও এর নিকটবর্তী জনপদে রোহিঙ্গাদের যে বসবাস ও আধিপত্য দেখেছিলাম
এখন আরাকান আর্মির সাথে নতুন দ্বন্দ্বের পর তা আর নেই বলে জানতে পারছি।
দ্বিতীয়ত, আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে সম্মত না হলে বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা। এ জন্য জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সম্মত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নে বিশ্ব সংস্থা তাদের বসতি অঞ্চলকে নিরাপদ জোন ঘোষণা করবে। এই জোনে আরাকান আর্মি প্রবেশে বাধা দিলে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ শক্তি প্রয়োগ করে সেই নিরাপদ জোন বাস্তবায়ন করবে।
জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষেত্রে আগে প্রধান বাধা ছিল জান্তা সরকারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক দেশ চীন ও রাশিয়ার ভেটো প্রদানের সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা দু’টি কারণে এখন থাকবে না। প্রথমত, মিয়ানমার সরকারই যেহেতু এ বিষয়ে একমত হচ্ছে সেহেতু নিরাপত্তা পরিষদের এই সদস্য দেশগুলো ভেটো দেয়ার বিষয় বিবেচনা করবে না। দ্বিতীয়ত, প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ইউরোপ-আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাকারী হিসেবে দেখা হলেও চীন ও রাশিয়ার সাথে তিনি সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। বাংলাদেশে রাশিয়ান যেসব অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে তাতে অন্তর্বর্তী সরকার হাত দেয়নি। আর চীনের সাথে অধ্যাপক ইউনূস কতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছেন সেটি এবারের বেইজিং সফরের সময় স্পষ্ট হয়েছে। প্রফেসর ইউনূসকে যেভাবে বিশেষ বিমান প্রহরা দিয়ে দেশটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটি যেকোনো সরকারপ্রধানের জন্য নজিরবিহীন সম্মান। চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে তার শীর্ষ বৈঠকে শি জিনপিং নিজে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবেই নয়, সেই সাথে চীনের সাথে কয়েক দশক ধরে তার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে তার কারণে তিনি এমন এক অবস্থানে রয়েছেন যে, দুই বিশ্বশক্তির মধ্যে কোনো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে সমঝোতার প্রয়োজন হলে তিনি সে ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তিত্ব হতে পারেন। আর তিনি ড. খলিলের মতো এমন ব্যক্তিত্বদের সহযোগী বা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে কাজের যথেষ্ট দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যকরভাবে বরফ গলায় সেটি আবারো প্রমাণ হয়েছে।
তবে এ ক্ষেত্রে ফলাফল অর্জনে এখনো অনেক পথ বাকি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের সাথে সংযোগ যথাযথভাবে বজায় রাখা গেলে ২০২৫ সালের মধ্যে এ ক্ষেত্রে একটি ফল দেখা যেতে পারে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবকে পাশে রেখে প্রফেসর ইউনূস আগামী ঈদ রাখাইনে করার ব্যাপারে যে প্রতিশ্রুতি রোহিঙ্গাদের সামনে উচ্চারণ করেছেন, সেটি কথার কথা নয়। এটি বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে। দেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলোর উচিত তাড়াহুড়ো না করে তাকে সেটি করার সুযোগ প্রদান করা।