Image description

বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক শ্রমবাজারের একটি সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউজ এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশী শ্রমিকদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স কিনছে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১১৯ টাকা দরে। প্রবাসীদের কাছ থেকে সংগৃহীত এ ডলারই বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর কাছে ১২১ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। আর দেশের ব্যাংক থেকে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনেছে ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে।

দেশের ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা না থাকার অজুহাতে বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো প্রবাসীদের ডলারপ্রতি কম টাকা দিচ্ছে। সেই ডলার বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বেশি দামে বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে তারা। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক এ মুহূর্তে ডলারের দরপতন ঠেকানোর নীতি নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দরপতন ঠেকানোর চেষ্টা না করলে চলতি সপ্তাহে প্রতি ডলার ১১৫ টাকায় নেমে যেত। এতে গত সাড়ে তিন বছর টাকার যে রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে, সেটি সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যেত।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেছেন, ডলারের দর যাতে অস্বাভাবিক কমে না যায়, সে জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাজারে এ মুহূর্তে চাহিদার চেয়ে ডলারের জোগান বেশি। এ কারণে আমরা বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কিনছি। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ হচ্ছে।’

বিনিময় হারকে আরেকটু সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেয়া দরকার ছিল কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ মুখপাত্র বলেন, ‘রিজার্ভ আরেকটু বেশি থাকলে হয়তো দেয়া যেত। এখনই ডলারের দর কমে গেলে রেমিট্যান্স ও রফতানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। হুন্ডি বাজারের দৌরাত্ম্য বেড়ে যেতে পারে। অর্থনীতির সামগ্রিক দিক পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে।’

দেশের বাজারে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার কথা বলে গত ১৩ জুলাই থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকালও আটটি ব্যাংক থেকে ৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার কেনা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই ৯৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার কেনা হলো। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ চুক্তির শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে চলতি বছরের ১৪ মে ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশে প্রায় চার বছর ধরে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। এর পর থেকে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চরমে ওঠে। এক বছর পর ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১০৩ টাকায় উঠে যায়। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডলারের দর বেড়ে হয় ১১০ টাকা। ওই বছরের জুনে এসে বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এক ধাক্কায় প্রতি ডলারের বিনিময় হার বেড়ে ১১৮ টাকায় গিয়ে ঠেকে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি বিনিময় হার আরো বেড়ে ১২০ টাকায় স্থির হয়। এরপর বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার দিন তথা গত ১৪ মে ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের দর ছিল ১২২ টাকা। এরপর ডলারের দর ১২৩ টাকায় উঠলেও পরবর্তী সময়ে নিম্নমুখী হতে শুরু করে। জুলাইয়ে ব্যাংক খাতে প্রতি ডলার ১২০ টাকায় নেমে যায়। এ অবস্থায় বাজার থেকে ডলার কিনে বাজার স্থিতিশীল রাখার নীতি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে দেখা গিয়েছিল উল্টো প্রবণতা। বাজার স্থিতিশীল রাখার কথা বলে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের ডলার বিক্রি শুরু করেছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত টানা তিন বছর জুড়ে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত তিন অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৪৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। এ রেকর্ড অবমূল্যায়নের প্রভাবে দেশে মূল্যস্ফীতি উসকে ওঠে। আমদানিনির্ভর প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়। এ পরিস্থিতিতে ডলারের বাজারদর সংশোধনের সুযোগ দিলে আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম কমে আসত। এতে দেশের মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হতো।

দেশে ভোগ্যপণ্য আমদানির অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মাদ মুস্তাফা হায়দার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টাকা শক্তিশালী হলে আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হবে। ভোগ্যপণ্যসহ আমদানীকৃত পণ্যের দাম কমবে। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেটিও সফল হবে। তবে দেখতে হবে ডলারের সরবরাহ যেন কমে না যায়। বাজারে ডলার প্রবাহের উৎসগুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’

২০২০ সাল-পরবর্তী সময়ে দেশ থেকে টাকা পাচার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এ কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে ডলারের সংকট শুরু হয়। টানা সাড়ে তিন বছর ধরে চলে আসা এ সংকট কমতে শুরু করে গত বছরের আগস্ট থেকে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে দেশ থেকে অর্থ পাচারের পথ সংকুচিত হয়ে আসে। বিপরীতে প্রবাসী বাংলাদেশীরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। কেবল ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার বেশি। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গত অর্থবছরে দেশের রফতানি খাত ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। গত অর্থবছরে ৪৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। বিপরীতে দেশের আমদানি ব্যয় ছিল ৬৪ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।

রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে দেশে ডলার সংকট কমে আসে। চলতি অর্থবছরে এসে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকায় দরপতনের মুখে পড়ে ডলার। দেশের অন্তত চারটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা বণিক বার্তাকে বলেছেন, দেশ টাকা পাচার কমে আসায় বিদেশে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলোর হুন্ডির বাজারে এখন আর ডলারের খুব বেশি চাহিদা নেই। এ কারণে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো এখন ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করতে বাধ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার না কিনে বাজার সংশোধনের সুযোগ দিলে এক মাসের মধ্যে প্রতি ডলার ১১০ টাকার আশপাশে নেমে আসবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির কারণে বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো কম দামে ডলার কিনে আমাদের কাছে বেশি দামে বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে। এতে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি প্রবাসীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

অবশ্য মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলছেন, ‘এখন খেলার সময় নয়, বরং বাজার স্থিতিশীল রাখা বেশি দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কেনার মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখার যে নীতি নিয়েছে সেটি আপাতত অব্যাহত রাখাই ভালো।’

বণিক বার্তাকে এমটিবির এ শীর্ষ নির্বাহী আরো বলেন, ‘হুন্ডির বাজারে ডলারের চাহিদা এখনো পুরোপুরি কমেনি। আমরা দেখছি, দেশের কার্ব মার্কেটে এখনো প্রতি ডলার ১২৪ টাকার বেশি দরে লেনদেন হচ্ছে। অর্থনীতির স্বার্থে ডলারের বাজার আরেকটু সংশোধনের সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন হলে সেটি যেন আলোচনার মাধ্যমে হয়।’