Image description
সেলফি, জি-২০ এবং ম্যাখোঁ নিয়ে মাখামাখি
মিনার রশিদ সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে উদ্ভট এক জন্তুর পিঠে পুরো দেশটি চড়ে বসেছে। উদ্ভট এই জন্তুটি কুমির নয়, উটও নয়, মনে হয় অনেকগুলো জন্তুর মিশেল! জি-২০ সম্মেলনে এমন একটা কিম্ভূতকিমাকার জন্তু বিশ্ববাসীর গোচরে এসেছে! শত শত ক্যামেরার সম্মুখে ঘাসের উপর দিয়ে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে (সামনের সারিতে জায়গা নেয়ার জন্যে) সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে! আর এই জন্তুটির কারণেই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গার নিয়ন্ত্রণ ভয়ানক সাইকোপ্যাথদের হাতে চলে গেছে! রাজনীতি আজ মমতাজ আর শামীম ওসমানদের হাতে, বিচারালয় শামসুদ্দিন মানিকদের হাতে, শিক্ষালয় চা-সামোসা বিছিদের হাতে, সেনাবাহিনী আজিজদের হাতে, পুলিশ গোপালীদের হাতে! এই সাইকোরা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে প্যাথলজিক্যাল লায়ার। দুদিন পর নিজের বলা মিথ্যা কথাটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করা শুরু করে! অপরাপর মিথ্যাবাদীদের সঙ্গে এই সাইকোদের পার্থক্যটি এখানেই। এদের পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় - উভয় জীবনেই অস্বাভাবিকতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অতীব পাওয়ারফুল স্ত্রী হওয়ায় 'স্বামী' নামক শব্দটি এদের ডিকশনারিতে অপাংক্তেয়, একটি চরমতম নিষিদ্ধ শব্দ! যাদের দাম্পত্য জীবন তছনছ বা হচপচ অবস্থায় থাকে তারা জাতির জীবনকেও তছনছ করে ফেলে। এরকম একটা নতুন উদাহরণ আবার স্থাপিত হল। জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো জাতি নিজেদের শাসক ফ্যামিলির এই বিষয়গুলোকে সঙ্গতকারণেই ইগনোর করে না! স্বামীদের নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেললেও এদের দেবররা অতি ভাগ্যবান বনে গেছেন! মেয়ের জামাই চুরিতে ধরা খেয়েছেন, ডিভোর্স দিয়ে ইজ্জত বাঁচিয়েছেন। এখন নিজের ছেলের পালা শুরু হয়ে গেছে! এবার কোন তারিকায় ইজ্জত বাঁচাবেন, তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে! এদের চাকর বাকরদের পরিস্থিতি আরও সরেস। স্ত্রী যখন হালাল থাকে তখন এদের ভালোবাসা ঘনীভূত হয় না, ডিভোর্সের পর যখন হারাম হয় তখন এদের ভালোবাসা গজানো শুরু করে। জনগণের টাকা মেরে যারা বেগম পাড়ায় বাড়ি বানিয়েছেন - তাদের কারও বাড়ি, কারও বেগম আর কারও আম-ছালা দুটোই নাকি শেষ। এখন আবার সামনে ভাসছে স্যাংশনের খড়গ। মানুষ যখন ডুবতে বসে তখন নাকি খড়কুটো ধরে ভেসে থাকতে চায়। বাইডেনের সাথে চকিতে সেলফি, ম্যাখোঁর সাথে মাখামাখি সবই নাকি সেই খড়কুটো! পশ্চিমা শক্তির সাথে “আলগা পীরিতি” বা দহরম-মহরম দেখাতে গিয়ে সবকিছুর তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন! কখনও খুকির মত উচ্ছ্বাস দেখিয়ে বাইডেনের সাথে সেলফি তুলছেন। সেলফি তুলে তিনি নিজে না যতটুকু খুশি চ্যালা-চামুণ্ডারা আরও বেশি উচ্ছ্বসিত! ঘাসের উপর দিয়ে ফাঁড়ি মেরে বাইডেন-মোদির সাথে একই লাইনে ছবি তোলার মহা-সুযোগটি একটুর জন্যে মিস করলেও ঘাসের উপর দিয়ে তাঁর এই ভূতুরে কদমগুলি বিশ্ব পরিসরে পুলক ও বিস্ময় জাগিয়েছে। সরকার প্রধান পর্যায়ের একজন মানুষ কতটুকু রং-হেডেড হলে এত শত ক্যামেরার সামনে এই কাজটি করার সাহস করতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এই সেলফি নিয়ে ব্যারিস্টার তাপসের ব্যাখ্যা সকলের মাথা গুলিয়ে দিয়েছে। মানলাম বিনা ভোটে মেয়র হয়ে গেছেন তবে এই আই-কিউ নিয়ে ব্রিটেন থেকে ব্যারিস্টার কেমন করে হলেন, সেটাই বড় প্রশ্ন! নিজের জেন্ডার ডিফারেন্স ও বিশ্ব সভার প্রটোকল ও গাম্ভীর্য ভুলে নিজেকে অত্যন্ত খেলো বানিয়ে ফেলেছেন! সদ্য বিবাহিতা স্বামী সোহাগী কিশোরী মেয়েটি যেমন তার বাবা-মা আত্মীয় স্বজনকে তার স্বামী সোহাগ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ম্যাখোঁকে নিয়ে আমাদের ৭৬ বছর বয়স্কা প্রধানমন্ত্রীর উচ্ছ্বাস গুলো ছিল সেই কিসিমের। ম্যাখোঁর সঙ্গে উচ্ছ্বাস বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজগুলি ছিল দেখার মত! এই কাজগুলো শেখ হাসিনা না করে যদি বেগম খালেদা জিয়া করলে শ্যামল দত্ত সম্পাদিত ভোরের কাগজও প্রথম পাতায় শুধু নাউজুবিল্লাহ লিখেই শিরোনাম করতেন! তখন শামসুদ্দিন মানিককে দিয়েই শরিয়া কোর্ট বানিয়ে পাথর মারার ব্যবস্থা করতেন। প্রসিকিউশন টিমের প্রধান হতেন শাহবাগী মাওলানা হিসাবে খ্যাত ফরীদ উদ্দীন, তার সদস্য থাকতেন শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন! এমনকি রাজনীতি না বোঝা জাফর ইকবালও এই টিমে সংযুক্ত হতেন। সুপ্রিয় পাঠক, আমার এই কথাগুলো আপনাদের কাছে মশকরার মত মনে হতে পারে। বিশ্বাস করুন,আপনাদের সংগে একটিও মশকরা করছি না। শেখ হাসিনা যখন ড.ইউনুসকে সুদখোর বলে গালি দেন তখন নিজেকে ভাবেন (মদিনার সনদ অনুযায়ী পরিচালিত) এই দেশটির আমিরুল মুমেনিন। অথচ দেশের পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে আছে সুদের উপর যার প্রধান নির্বাহী স্বয়ং তিনি। অর্থাৎ ড.ইউনূস কিংবা বেগম খালেদা জিয়া না করলে সেগুলো অপরাধ বা দৃষ্টিকটু কাজ বলে বিবেচিত হবে না! কাজেই ম্যাখোঁর সাথে খালেদা জিয়ার মাখামাখি (যদি তা করতেন) নিয়ে বিশেষ শরিয়া কোর্ট বানালে আমাদের মিডিয়া সুন্দরীরাও একটুও উচ্চবাচ্য করতেন না, এব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন! একজন সরকার প্রধানের প্রটোকল ও গাম্ভীর্য ভুলে অন্য সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানের হাত ধরে চাপ মারা (ট্রান্সলেটর দেওয়ার পর পরই), একজন অন্যজনকে বাহুডোরে বেঁধে ফেলা বা পাঞ্জা মারা- এগুলোও মনে হয় বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত! ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব ভুট্টোকে তেমনিভাবে পাঞ্জা মেরে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এরকম ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু হয়তো দুটি দেশের রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধান অনেক হয়েছেন কিন্তু জনসম্মুখে এই কিসিমে একজন অপরজনকে পাঞ্জা মেরে জড়িয়ে ধরেছেন, এরকম দৃশ্য বোধহয় বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে দ্বিতীয়টি আর নেই। আওয়ামীলীগের দাবিমত যে যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল এবং দুই লাখ মা বোনের ইজ্জত হরণ করা হয়েছিল সেই যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি এমন জাগরিত থাকাবস্থায় তিনি কেমন করে এক নম্বর যুদ্ধাপরাধীকে এমন ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরতে পারলেন? সেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে যদি প্রায় অর্ধশত বছর পর সেই সময়কার কৈশোর উত্তীর্ণ কাউকে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তবে এই পাঞ্জা মেরে ধরার জন্যে কি কোনোই বিচার হবে না? যাই হোক, যাই হোক, উনার এই সব হ্যাংলামোর বিপরীতে বেগম জিয়ার কিছু চমৎকার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। দুজনের মধ্যে পার্থক্যটিও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তারপরেও শুধু মহিলা হওয়ার কারণেই তিনি এই রং-হেডেডের সাথে একই ব্রাকেটবন্দী হন। এখানে উল্লেখ্য তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পুরো দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ ব্যাপারে বেগম জিয়া অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সেজন্যে অনেক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের বাড়িয়ে দেওয়া হাতকে তিনি সালাম দিয়ে বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন। যদিও পরবর্তীতে দুয়েকজনের সাথে ঘরোয়া সাক্ষাতে বেগম জিয়াকেও হ্যান্ডশেইক করতে দেখা গেছে, তবে সেটাও কোনো সীমা ছাড়ায় নাই! এটাও বোধহয় করেছেন যখন প্রতিপক্ষ তাকে জামাতের মহিলা আমির ডাকা শুরু করেছে! কেউ কেউ আবার বিশ্বনেতাদের সাথে এসব মাখামাখিকে হাল্কা করে দেখার পরামর্শ দিচ্ছেন। একজন বয়স্ক মহিলার জন্যে জেন্ডার সেনসিটিভিটি শিথিলতার জন্যে ওকালতি করেছেন। যদিও এই ভদ্রলোক নিজের শিক্ষিকা এবং বন্ধুর (সমবয়সী) মাকে বিয়ে করেছেন এবং সেই স্ত্রীর সঙ্গেই ঘর সংসার করছেন! পর পুরুষের সাথে মাখামাখির এই কাজটিকে তখনই সহজভাবে নেয়া সম্ভব হতো যদি এসব কাজের উদ্দেশ্যটি নেহায়েত নিষ্পাপ হত। এসব ঢলাঢলি/ মাখামাখির মূল উদ্দেশ্য দেশের ভেতরে গুম-খুনের মাধ্যমে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন, দেশের সম্পদ যে ভাবে লুণ্ঠন করছেন সেগুলো নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়া। সেজন্যে বেছে নিয়েছে ইউরোপ আমেরিকার ইসলামোফোবিক অংশকে। (ইসলামফোবিয়ায়) মুসলিম বিশ্বের যখন পুড়ছিল ঘর, এই শেখ হাসিনা তখন শুকিয়ে নিচ্ছিল তার ভেজা কাপড়। এই কাজটিই তিনি অব্যাহত রাখতে চান! দরকার পড়লে নারী কার্ড ব্যবহার করতেও তিনি পিছুপা হবেন না। এই ম্যাসেজটিই তার কয়েকদিনের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট হয়েছে। উপরোক্ত দুজনের থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি শোনাক একটু ভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টার ঋষি শোনাক নিজেকে একজন বিশুদ্ধ হিন্দু বলে গর্ব অনুভব করেন। মাঝে মাঝে তাকে বিজেপির লন্ডন শাখার সভাপতি বলে ভ্রম হয়! ফ্যাসিবাদী হাসিনা সম্পর্কে সে দেশের সরকারের অবস্থান এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে তার শারীরিক রসায়ন এক সাথে যায় না। গতবার শেখ হাসিনার সাথে তাঁর পথে চলতে ছবিটি নিয়ে ঢাকার ফ্যাসিবাদী সরকার কেমন প্রচারণা চালিয়েছিল, সে সম্পর্কে তাঁর জানা থাকার কথা। তাঁর মেয়েরা নিজেদের বাবাকে নয়, শেখ হাসিনাকে আদর্শ মনে করে- সাইড লাইনের এই প্রচারণাগুলোর জবাবও ঋষি শোনাকের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় নাই। ফলে সকল বেনেফিট অব ডাউট হাসিনার পক্ষে গিয়েছে। এই সব কাহিনী জানার পরেও তিনি যে ভঙ্গিতে এবারও পোঁজ দিয়েছেন তা সন্দেহের জন্ম দিয়েছে! তিনি কি ইচ্ছে করেই মানে Carefully carelessness এর মাধ্যমেই এই সুযোগটি আবারও সৃষ্টি করে দিলেন? ইসলামোফোবিয়ার বিপদ সম্পর্কে পশ্চিমা জগত অবগত থাকলেও সেই সমাজের অনেক জায়গায় এটা এখনও একটু গাঢ় হয়ে লেগে আছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে আমাদের যে ভাইয়েরা আছেন তারা একটু সজাগ হলেই এই প্রচারণাকে উল্টোদিকে প্রবাহিত করা যায়! বিশেষ করে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকগণ কিংবা এমপি গণ এব্যাপারে প্রাইম মিনিস্টারের একটা ব্যাখ্যা দাবি করতে পারেন। লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক