ভারতই তিস্তা প্রকল্প করুক
তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও সুষ্ঠু বণ্টনের লক্ষ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। এ অবস্থায় পানি যেহেতু ভারত দেবে তারাই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশ নেবে, এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, তিস্তার পানি যেহেতু ভারত দেবে, সেহেতু তারাই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দিক। গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন ইঙ্গিত দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চীনতো তিস্তায় বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু পানি যেহেতু ভারত আটকে রেখেছে, তাই তারাই তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করুক। সেটাই ভালো হবে সবার জন্য। এখানে কোনো রাখঢাকের বিষয় নেই। সবার সাথেই বন্ধুত্ব, কারো সাথেই শত্রুতা নয়।
এ সময় দূর্নীতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। কিন্তু আপেক্ষ করে তিনি আরো বলেছেন, ‘আমার বাসার কাজ করে গেছে পিয়ন ছিল। সেও এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। হ্যাঁ, বাস্তব কথা। কি করে বানালো এই টাকা? যখনই আমি জানছি তাকে বাদ দিয়ে তাঁর কার্ড-টার্ড সব ছিস করে আমার ব্যবস্থা আমি নিছি। এটা তো হয়। ধরা পরে যখন তখন চোখে আসে। তাছাড়া তো হয় না। ধরা পরে যখন তখনই আমি ব্যবস্থা নেই।’
চীন থেকে ঋণ প্রসঙ্গ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যখন প্রকল্প নেই, তখন আমরা দেখি প্রকল্প সম্পন্ন হলে আমার দেশ কি পাবে? সেটাই আমি বিবেচনায় নিই। আর যে দেশ থেকে যত লোন নিই, কেউ একটা বিশাল আকারে দিলেই যে ঝাঁপিয়ে পরবো তা না। আমাদের একটা হিসাব থাকে যে, কতটুকু লোন আমি নেব। আমার ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা আছে কী না, লোন আমার কাজে লাগবে কী না। তিনি আরো বলেন, যে জিনিসটা আমি তৈরী করবো, সেটাও আমি বিবেচনা করে দেখি। আমি কথা বলে এসেছি কোন কোন জায়গায় আমরা অর্থ নেব এবং কাজে লাগাবো, সেটা যৌথভাবে তাদের লোক আসবে এবং আমরা নিজেরাও টিম করে বসে, আমরা প্রত্যেকটা প্রজেক্ট সিলেক্ট করে এর পর আমরা টাকা নেব। তারা আমাদের বিরাট অফার দিছে, এটা ঠিক কিন্তু নেবার সময় এই হিসাবটা করে আমাকে নিতে হবে।
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্প আজকের না। এটা বহু যুগের, বহু দিন থেকে এটা চলে আসছিল। আমার যতদূর মনে পরে, যুক্তফ্রন্ট (পাকিস্তান আমলে) কিংবা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এটা ছিল। এখন তিস্তা প্রকল্প আমাদের করতে হবে। এ নিয়ে চীন আমাদের কাছে কিছু অফার দিয়েছিল, তারা ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি (সম্ভব্যতা যাচাই) করেছে। ভারতও আমাদের এ নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে, তারাও ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করবে। এটা করার পরে যেটা আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত হবে আমরা সেটা নেব। তবে এখানে বেশি প্রধান্য দেব, যে এটা ভারত করুক। কারণ তিস্তার পানি ভারতই আটকে রেখেছে, তাদের কাছ থেকে যদি আমাদের আদায় (পানি) করতে হয়, এই প্রকল্পের কাজ তাদেরই করা উচিত। তারা প্রকল্প করে এ জন্য যা প্রয়োজন তারা দেবে। এটা তো একটা ডিপ্লোমেসি। কাজেই এখানে তো আর কোন দ্বিধা থাকার তো কথা না। তিনি আরো বলেন, ‘চীন তো রেডি (প্রস্তুত) কিন্তু আমি চাচ্ছি এটা ভারত করে দিক। এই প্রকল্পটা তারা (ভারত) করলে যা যা দরকার তারা দিতে থাকবে। এখানে সাফ কথা, কোন রাখঢাক নেই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দক্ষিণাঞ্চল সব থেকে বেশি অবহেলিত। পদ্মার ওপর। আমি এই দক্ষিণাঞ্চলের জন্য আমি চীনকে বলেছি...। কারণ ওখানকার কাজগুলো করা খুব কঠিন। পিরোজপুর যাওয়ার আগে একটি সেতু, যা দীর্ঘ দিনের একটা আকাঙ্খা। ওটাও কিন্তু চীন করে দেবে।’
এ সময় কোটা ইস্যুতে আন্দোলকারীদর নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেখুন একবার (২০১৮) তারা শুধু আন্দোলন না, যে ধরনের ঘটনা তারা ঘটাচ্ছিল, যেমন- আওয়ামী লীগ অফিসে আক্রমন, সেখানে মানুষের উপর আঘাত করা, কিছু জ্ঞানীগুনি আছে, একেবারে ঘরের মধ্যে বসে মিথ্যা-অপপ্রচার রেকর্ড করে ছেড়ে দিচ্ছে, এ ধরনের সব কিছু দেখে আমি খুব বিরক্ত হয়ে যাই। তখন এক পর্যায়ে বলি ঠিক আছে কোটা বাদই দিলাম। উদ্দেশ্যটা ছিল কোটা বাদ দিলে কি অবস্থা হয়। তিনি আরো বলেন, ‘তো এখন কি অবস্থা হয়েছে? বেশি দূর যাওয়া লাগবে না এবারই দেখেন। এবার ফরেন সার্ভিসে মাত্র ২ জন মেয়ে চান্স পেয়েছে। আমরা পুলিশ সার্ভিসে মাত্র ৪ জন মেয়ে চান্স পেয়েছে।’ এ সময় দেশের সব এলাকা সমানভাবে উন্নত না এমন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সে সব এলাকার মানুষের চাকরি ক্ষেত্রে কোন অধিকার রয়েছে কীনা এমন প্রশ্নও রাখেন।
সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না হয়, ততক্ষণ সরকারের কিছু করার নেই বলে এ সময় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় কোটা ইস্যুতে আন্দোলকারীদের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছে, তারা আইন- আদালত মানবে না। সংবিধান কি তা তারা চেনে না। কিংবা একটা কাজ করতে গেলে তার যে নীতিমালা বিধিমালা কিংবা ধারা থাকে..., একটা সরকার কিভাবে চলে সম্পর্কে কোন ধারনাই এদের নাই, কোন জ্ঞানই নাই। হ্যাঁ পড়াশুনা করছে, ভাল নাম্বার পাচ্ছে, সেটা ঠিক। ভবিষ্যতে তো তারা এদেশে নেতৃত্ব দেবে, সেই ধারনাগুলো তো তাদের থাকার দরকার।’
কোটার সমাধান প্রধানমন্ত্রীর থেকে পাইছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আর আমাকে বলছে, আমি সত্যি কথা বলতে, এই মুহুর্তে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আমার কোন অধিকার নেই। এটা সংবিধানও তা বলে না, সংসদও বলে না, কার্যপ্রনালী বিধিও বলে না। কিছুই না। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে আমাদের কোন কিছু করার থাকে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারবে না। পুলিশের গায়ে হাত দেওয়া, পুলিশের গাড়ি ভাঙ্গা এগুলো যদি করতে যায় তাহলে তো আইন আপন গতিতে চলবে।
এ সময় সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে? এমন প্রশ্ন রাখেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না।’
সংবাদ সম্মেলনে দেশে দূর্ণীতিবাজদের সম্পদ নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে। বিসিএসসহ বিভিন্ন পদে প্রশ্ন ফাঁস নিয়েও প্রসঙ্গ উঠে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘২৪ বিসিএস পরীক্ষা হয়েছিল ২০০২ বা ২০০৩ এ সময়ে। বিএনপি আমলে যত চারকি হতো ওই হাওয়া ভবন থেকে তালিকা আসতো। আর সেই তালিকা হতো। সেই সময় ঢাকা কলেজে পরীক্ষা হয়, এটা বিশেষ কামরা রাখা হয়। যেখানে বসে তারা পরীক্ষা নিয়ে পাশ করে চাকরিতে ঢুকে।’
দূর্ণীতি নিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কিন্তু একটা জিনিস, অনেকে বলেন, এগুলো প্রকাশ হলে ইমেজ নষ্ট হবে। আমি তাতে বিশ্বাস করি না। অন্যায় ও অবিচার যারা করবে তাদের আমি ধরবোই।’ এ সময় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যাদের চাকরি হয়েছে তাদের খুঁজে পাওয়া পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, কিন্তু খুঁজে বের করে দেবে কে? সাংবাদিকরা যদি খুঁজে বের করে দেয় ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
এ সময় বিভিন্ন সেক্টরে দূর্ণীতির খবর নিয়ে কঠোর হবেন কীনা এমন এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কঠোর হয়েছি বলেই তো দূর্নীতিবাজরা ধরা পরছে। দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স। আর আমরা খুঁজে বের করছি বলেই তো আপনারা জানতে পারছেন। খোঁজ না করলে তো জানা যেত না।’ তিনি বলেন, আমি এটা বিশ্বাস করি না যে, এগুলো ধরলেই আমরা ইমেজ নষ্ট হবে, নো। আমরা দায়িত্বই হচ্ছে এই যে, বিষয়গুলো হচ্ছে এটাকে ধরে একটা জায়গায় নিয়ে আসা দেশটাকে।’
দূর্নীতি প্রসঙ্গে অপর এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আসলে দূর্ণীতিটা তো নিচের দিক থেকেই বেশি হচ্ছে এটা হচ্ছে বাস্তবতা। আর দূর্ণীতির উৎসমুখ কোন জায়গায় কয়টা খুঁজবেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ড্রাইভার (পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়ী চালক আবেদ আলী) কীভাবে এত কোটি কোটি টাকার মালিক হলো, সেটা কীভাবে বলবো। তাদের অপকর্ম আমরা ধরছি বলেই তো এখন জানতে পারছেন। এতদিন তো আপনারা জানতে পারেননি।’ এ সময় দূর্নীতি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আমার বাসার কাজ করে গেছে পিয়ন ছিল। সেও এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। হ্যাঁ, বাস্তব কথা। কি করে বানালো এই টাকা? যখনই আমি জানছি তাকে বাদ দিয়ে তাঁর কার্ড-টার্ড সব ছিস করে আমার ব্যবস্থা আমি নিছি। এটা তো হয়। ধরা পরে যখন তখন চোখে আসে। তাছাড়া তো হয় না। ধরা পরে যখন তখনই আমি ব্যবস্থা নেই।’ তিনি বলেন, ‘দূর্নীতি তো এমন পর্যায়ে ছিল যে সহ্য করা যেত না। সে জায়গা থেকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসছি।’
সংবাদ সম্মেলনে অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণে আকারে চীন বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক– এই চার ধরনের আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিলেছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করার কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে আশ্রিত জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক-রোহিঙ্গাদের অবস্থা এবং তাদের সমস্যার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে এর সমাধানে আমি চীনের সহযোগিতা কামনা করি। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ ও চীনের পারস্পরিক সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে উভয়পক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করি।