সাপ্তাহিকী
|
গ্রন্থ সমালোচক
|
|
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসুন ওই সর্বনাশা ভয়ঙ্কর পথ থেকে
10 Aug, 2014
আইন যেখানে শাসন করে না সেখানে কোন শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না - এ্যারিস্টটল- পলিটিকস (৪:৪)
সেন্সরশীপ সমাজের মধ্যেকার বিদ্যমান বিশ্বাসহীনতারই প্রতিফলন। আর এটা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার জ্বলজ্যান্ত এক উদাহরণ - পটার স্টিওয়ার্ট- মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি
এই সরকারের আগের দফা থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিভিশন টকশোতে যারা অংশ নেন তাদের বিস্তর সমালোচনা করেছেন। তিনি তাদের নিশিকুটুম্ব বলেও ভৎর্সনা করেছেন। সমাজের বিশিষ্টজনদেরও সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। তার পক্ষ থেকে বরাবরই একটি যুক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এই সব টকশোতে অসত্য, বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা দেদারসে বলা হচ্ছে। এসব কারণে বিভিন্ন সময়ে টকশোতে অংশগ্রহণকারী কোনো কোনো ব্যক্তিকে ‘বাদ’ দেয়ার অলিখিত আদেশ জারির খবরও শোনা গেছে। এই টকশো নিয়ে নানা মন্তব্য, কথাবার্তা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে - যা সবাই জানেন বলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। তবে প্রশ্ন থাকে যে, অসত্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য যদি কেউ দিয়েই থাকেন তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল। এমন কি যে টিভি চ্যানেলে ওটা প্রচার হয়েছে তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া যেতো।
এছাড়া প্রযুক্তি ও যন্ত্র কৌশলের আধুনিক এই জমানায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরাসরি বা ধারণকৃত ঘটনাবলী প্রচার করে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই নিয়ে প্রতিযোগিতাও আছে। যদি এই রকম খবরাখবর শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি মারাত্মক হুমকি বা বিঘ্নসৃষ্টি করে তাহলেই শুধুৃ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে থাকে বলে দুনিয়া জুড়ে নিয়ম-রীতি চালু আছে। অবশ্য পশ্চিমী দুনিয়ায় যুদ্ধকালীন অবস্থায় ‘এমবেডেড জার্নালিজম’ বলে সাংবাদিকতার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি ব্যবস্থা কিছুকাল আগে চালু হয়েছে। সবাই এমনটা মানছেন তা নয়, এর বিরুদ্ধে ওই সব দেশে প্রবল প্রতিবাদ-প্রতিরোধও আছে।
কিন্তু আগে থেকে বিধিনিষেধ আরোপ করার ঘটনা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় তো নেই-ই, কোনো অনুদার বা ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক সমাজেও রয়েছে বলে কারো জানা নেই। তবে নানা কিছু বিজয়ের এবং উদাহরণ সৃষ্টির ‘মহান অর্জন’ এই সরকারের রয়েছে। আর এমনই এক উদাহরণ সৃষ্টির যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।
মন্ত্রীসভা ৪ আগস্ট জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার নামে টেলিভিশন ও বেতার মাধ্যমের উপরে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এসব বিধি নিষেধ এতোদিন ছিল না। মন্ত্রীসভা যে খসড়া অনুমোদন করেছে তা নিয়ম রক্ষার্থে জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার অপেক্ষা মাত্র। আর সংসদ যখন একদলীয় তাই এটি আটকে যাবে এমনটি স্বপ্নেও ভাবা উচিত হবে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও বাক-স্বাধীনতার নামে যে নীতিমালা করা হয়েছে তা শুধুমাত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণই বাড়াবে না, পুরো সম্প্রচার মাধ্যম এখন চলবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ও কর্তৃত্বে। ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, টকশোতে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করা যাবে না। এছাড়া ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না এবং অপরাধীদের দন্ড দিতে পারেন এমন সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার মতো কোনো দৃশ্য বা বক্তব্যও প্রচার ও প্রকাশ করা যাবে না। জনস্বার্থ বিঘিœত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না। নীতিমালায় আরও বলা হয়, কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠী, দেশের মর্যাদা বা ইতিহাসের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কিছু প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি ব্যক্তিগত বিষয়ে ক্ষতিকর কোনো কিছুও প্রচার ও প্রকাশ করা যাবে না।
এই নীতিমালার আলোকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্যের অবাধ প্রবাহসহ যা যা বলা হয়েছে তা বৃদ্ধির বদলে, তা যে পুরোপুরি সরকারের কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর পাশাপাশি অপব্যবহারের সদর দরজাও খুলে দিয়েছে সরকার।
এই নীতিমালা বাস্তবায়নের ফল হিসেবে সব টেলিভিশন চ্যানেল হয়ে যাবে বিটিভি আর বেসরকারি রেডিও হয়ে যাবে বাংলাদেশ বেতার।
এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি। এক. একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে বলে বলা আছে। কিন্তু মন্ত্রীসভা যে খসড়া অনুমোদন করেছে তাতে তো নির্দেশনা বা গাইড লাইন দিয়েই দেয়া হয়েছে। তাহলে নতুন কমিশন এসে নতুন কি ধারা যুক্ত করবে এবং কতোটুকুই বা বাদ দেবে। দুই. কবে এই কমিশন হবে তার কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ এতে নেই। তিন. কমিশন গঠন না হওয়া পর্যন্ত এর পুরো দায়িত্ব থাকবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে। তথ্য মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সরকারের হাতেই যদি সব কিছু থেকে যায়, তাহলে সরকার যা চাইবে তাই হবে। এতো গেল একটি দিক।
অন্যদিকের প্রশ্নগুলো হচ্ছে - এক. অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিমাপের মানদন্ড কি হবে, কোন ভিত্তিতে তা নির্ধারিত হবে? দুই. সেনাবাহিনী বা পুলিশ, র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর কোনো কিছু প্রচার বা প্রকাশের মাপকাঠি কে নির্ধারণ করবে এবং কতোটুকু বা কি করা হলে তা কটাক্ষ বা অবমাননাকর বলে বিবেচিত হবে? তিন. কতোটুকু হলে সরকারি কর্মকর্তা বা ওই সব বাহিনীর সদস্যদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে? চার. জনস্বার্থ বিঘিœত হওয়ার প্রকৃত অর্থ কি এবং হিংসাত্মক, নৈরাজ্য বা বিদ্রোহের সংজ্ঞা কি? দেশের মর্যাদা বা ইতিহাসের জন্য ক্ষতির মানদন্ড কি? এসব কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। আর স্পষ্ট নয় বলেই সরকার বিরোধী কোনো কিছু হলেই তা নির্ঘাত এই আইনের আওতায় পড়বে।
আরও একটি দিক রয়েছে, যা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি। যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেআইনি কার্যক্রম বা কর্মকান্ড তুলে ধরাই সংবাদ মাধ্যমের অন্যতম একটি দায়িত্ব। এই নীতিমালা কার্যকর হলে এই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কি কোনো কথা বলা যাবে না? তারা যদি কোনো ইচ্ছাকৃত অন্যায় বা ভুল, অন্যায্য এবং বেআইনি কোন কর্মকান্ড করেন বা জড়িত থাকেন তা বলাও কি অন্যায় হবে? এটা সবারই জানা, এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি-অনাচার ছড়িয়ে আছে। তাহলে কি সংবাদ মাধ্যম সব সুবোধ বালকের মতো বসে থাকবে? সংবাদ মাধ্যমকে যারা ফোর্থ এস্টেট বলেছিলেন তারা চেয়েছিলেন যাতে সমাজের একটা ভারসাম্য রক্ষা হয়। তাহলে কি এই নীতিমালার মাধ্যমে সে ভারসাম্য বিনষ্ট হবে? আরেকটি প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ - শুধুমাত্র সরকারি কিছু কর্মকর্তা কেন দায়মুক্তি পাবেন, অন্যরা কেন এর বাইরে থাকবেন? আর ব্যক্তির কোনো দোষত্রুটি তুলে ধরা যাবে না - এটাই বা কেমন কথা? তাহলে ন্যায়-অন্যায়, ন্যায্য-অন্যায্য এর কোনো ভেদ-বিচার থাকবে না? যে সমাজে ন্যায়-অন্যয়ের পার্থক্য থাকে না, সে সমাজটি যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় - তা নিশ্চয়ই সরকারের জানা। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন - সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকেই সরকার সমাজের নানা অনিয়ম - অন্যায় সম্পর্কে জানতে পারে। তাহলে কি সরকারের কোনো কিছুরই জানার প্রয়োজন নেই?
সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ৩৯ অনুচ্ছেদ যাতে - চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের অধিকার এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। যে নীতিমালা হয়েছে তাতে অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই ধারাটি বাধাগ্রস্ত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। এর জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না।
এই নীতিমালার ভিত্তি-ভূমিটি যে একদিনে রচিত হয়নি তা সবারই জানা। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ও এরই ফলশ্রুতিতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, এরপরে তথ্য প্রযুক্তি আইনসহ একের পর এক নানা কালা-কানুন প্রণয়ন বা এর উদ্যোগ অর্থাৎ সব কিছুই করা হচ্ছে পুরো ব্যবস্থাটিকেই নিয়ন্ত্রণের জন্য। পাশাপাশি বিরোধী দল, মত-পক্ষ ও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে দমন-পীড়ন, অত্যাচার, নির্যাতন, অপহরণ-গুম, হত্যা সবই একই সূত্রে গাথা।
তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন, অবাধ তথ্য প্রবাহের বিশ্বব্যাপী উত্তাল জোয়ারের কারণে বাংলাদেশে এখন আর সংবাদ পত্রই একমাত্র মাধ্যম নয়। এখন বেসরকারি খাতে টেলিভিশন চ্যানেল এবং রেডিও এসেছে। যুক্ত হয়েছে অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কিছু। এ কারণে এখন সংবাদ মাধ্যমটির জগত বিশাল এবং অসীম। যা ১৯৭৫ সালে ছিল না।
সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা যে এই নতুন হচ্ছে এদেশে তা নয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল কায়েমের প্রায় সাথে সাথে ৪টি সংবাদপত্র বাদে (বাংলাদেশ টাইমস, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা) সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। আগেই বলা হয়েছে ১৯৭৫ আর বর্তমান সময় এক নয়। ১৯৭৫-এর জুনেই সরকার সংবাদপত্র ডিক্লারেশন নিষিদ্ধকরণ আদেশ জারি করে।
বর্তমানে সংবাদপত্র প্রকাশনা বাতিলের ক্ষমতা সন্নিবেশিত করে একটি এ্যাক্ট তথ্য মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এতে জেলা প্রশাসককে প্রকাশনা বাতিলের ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিকভাবে সংবাদ মাধ্যমের উপরে নিয়ন্ত্রণ আর কর্তৃত্বপরায়ণতার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হচ্ছে - যার একটি উদাহরণ জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা। আর এর মাধ্যমে শুধুমাত্র যে সম্প্রচার মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে তা ভাবা ঠিক হবে না। এটি সার্বিক নিয়ন্ত্রণ চেষ্টারই অংশ মাত্র।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ওই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরে তা আরও বেগবান হয়েছে এবং স্থায়ী রূপ পেয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের ব্যাপারেও বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল যার একটি অন্যতম পর্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন অপেক্ষা বাকি পর্বগুলো সম্পাদনের।
একটি কথা বলা প্রয়োজন, জনসমর্থনে বলীয়ান এবং এতে বিশ্বাস থাকলে কোনো সরকারের পক্ষে এসব ব্যবস্থাবলী গ্রহণের প্রয়োজন পরে না। এটা শুধুমাত্র প্রয়োজন পরে তাদেরই যারা জনসমর্থনহীন, কর্তৃত্ববাদী ও একনায়কতান্ত্রিক। তবে অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, এটা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ীকরণের কোনো পথ নয়, বরং এর বিপরীত। কাজেই এই ভয়ংকর পথে আখেরে কোনো সুফল আসবে না এ কথা হলফ করে বলা যায়। ইতিহাস এর স্বাক্ষী, অতীত এর প্রমাণ। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসুন ওই সর্বনাশা ভয়ংকর পথ থেকে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হচ্ছে এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ কোনোদিন শেখে না।।
(আমাদের বুধবার )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন