বর্তমান বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ বানিজ্যের নাম অস্ত্র বানিজ্য। বিশেষত পারমাণবিক অস্ত্র। মনুষ্য সমাজকে এক নিমেষে নিমূর্ল করার অন্যতম লাভজনক বানিজ্য। এটা এমন এক ‘বানিজ্য’ যা যুদ্ধ ছাড়াই চলে এর বেচা-কেনা, কেননা এখন আর শক্তিধর রাষ্ট্রের যুদ্ধের প্রয়োজন হয়না, যুদ্ধের নামে চলে আগ্রাসন। এটা এমন এক বানিজ্য যা চলে নিরবে, নিভৃতে। এমন বানিজ্য, যা নিয়ে মানুষ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করে না। জেনেও না জানার ভান করে। শুধু তা-ই না, জানা-জানি হয়ে গেলেও সেই অস্ত্রব্যবসায়ী সদর্পে বলে ওঠেন - “ফাক ইউ!” যেভাবে বলে উঠেছিলেন হলিউডের বিখ্যাত প্রযোজক, ইসরাইলি গুপ্তচর আরনন মিলকান, ইসরাইলের অনুসন্ধানী টিভি অনুষ্ঠান ‘উভদায়” ধারণকৃত এক সাক্ষাৎকারে, যা সম্প্রচারিত হয় গত ২৫ নভেম্বর, ২০১৩। যার হাত দিয়ে ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন আমেরিকা, প্রিটি ওয়োম্যান, এল.এ. কনফিডেনশিয়াল, ফাইট ক্লাব এর মতো বিখ্যাত ছবির প্রযোজনা ঘটে। বিশেষ করে এই বছরের ওস্কার অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত “টুয়েলভ ইয়ার্স এ স্লেভ” এর মতো ছবির জন্যে যিনি অর্থ লগ্নি করেন। এরকম মাপের ছবির সাথে সংশ্লিষ্ট থেকেও এমন একজন উচ্চ পর্যায়ের প্রযোজক কী করে অস্ত্র চালান এবং গুপ্তচর বৃত্তির সাথে সাথে জড়িত থাকতে পারেন, সেটাই সেদিনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
আরনন মিলকানের এই গুপ্তচর বৃত্তির খবরাখবর প্রকাশিত হতো না যদি না ২০১১ সালে মিয়ের ডরন এবং জোসেফ জেলম্যান নামে দুজন লেখক - “কনফিডেনশিয়াল : দ্য লাইফ অফ সিক্রেট এজেন্ট, তাইকুন আরনন মিলকান” নামে বইটি প্রকাশ না করতেন। যদিও প্রকাশের পর বেশকিছুদিন তা জনসম্মুখে প্রচার হতে বেশ বিলম্ব হয়, কেননা, মিলকানের কোনো সম্মতি ছিলো না বইটির প্রচারকর্মে। কিন্তু মিলকান সম্পর্কে কানাঘুষা শুরু হয়েছিলো বেশ অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে ১৯৮৫ র দিকে মিলকানের একটি কম্পানির জাহাজে অবৈধ ভাবে ইসরাইলে যখন অস্ত্রের চোরাচালান হয়, তখন তা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের গোচরিভুত হয়। কিন্তু এই চোরাচালানের পেছনের ইতিহাস শুরু হয় তারও আগে থেকে। যখন মিলকানকে ১৯৬০ সালে, লাকাম (গুপ্তচরবৃত্তির এজেন্টের পরিভাষা) হিসেবে ইসরাইলের “বুরো অফ সাইন্টিফিক রিলেশানস” এ নিয়োগ দেয়া হয়। সেই বুরো থেকেই প্রধানত অস্ত্র সংক্রান্ত ক্রয়ের বিষয়-আশয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। সেখানকার এজেন্ট হিসেবে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত ছিলেন আরনন মিলকান। এসব অস্ত্র ক্রয়ের মধ্যে দিয়েই পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৮০’ র দশক থেকে ইসরাইল পারমানবিক অস্ত্র তৈরিতে ধীরে ধীরে শুধু শক্তিশালী হয়ে ওঠে না, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের একচ্ছত্র শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশিত করে। প্রেসিডেন্ট সিমোন পেরেসের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতা তাকে একজন প্রতিক্রিয়াশীল দলীয় কর্মী হিসেবে চিনে নিতে কারো অসুবিধা হয়না। সিমোন পেরেস যাকে পারমানবিক অস্ত্রের প্রধান নির্মাতা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এবং বলাই বাহুল্য সিমোন পেরেসের হাত ধরেই মিলকান সেই বুরোতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পেরেস নিজের মুখেই বলেছেন - “আরনন একজন বিশিষ্ট লোক। আমি তাকে নিয়োগ দিয়েছি …যখন আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ছিলাম, আরনন তখন প্রচুর প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচী ও বুদ্ধিবৃত্তিজনিত কাজে নিয়োজিত থাকতো… (দ্য গার্ডিয়ান, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩)।” এমনকি আফ্রিকার মধ্যকার দ্বিধাবিভক্ত দেশগুলোর সুযোগ নিয়ে মিলকান সেখান থেকে ইউরেনিয়াম সংগ্রহের কাজ করতেন। হলিউডের সব বাঘা বাঘা চিত্রনির্মাতা, অভিনেতা, প্রযোজক যেমন - মার্টিন সোর্সি, রোমান পোলানস্কি, অলিভার স্টোন, রবার্ট ডো নিরো, রাসেল ক্রাউন, বেন এফলেকের মতো সেলিব্রিটিদের সাথে ছিলো তার অন্তরঙ্গ কর্মসংশ্লিষ্টতা ও ঘনিষ্ঠতা। এবার দেখা যাক, সেই বিখ্যাত নির্মাতারা মিলকান সম্পর্কে কি বয়ান দিয়েছিলেন ইসরাইলি টিভির সেদিনের সেই সন্ধার অনুষ্ঠানে -
ডো নিরো ( ১৯৪৩ - ) অভিনেতা, পরিচালক: “আমি তার সম্পর্কে শুনেছিলাম, কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না তার সব বিষয়-আশয় নিয়ে। একবার আরননকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেছিলেন তিনি একজন ইসরাইলি এবং এসব অস্ত্রের কারবার তিনি তার দেশের জন্যেই করছেন।”
বেন এফলেক ( ১৯৭২ - ) অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার: “হলিউডে তাকে বেশ রহস্যময় এবং বহিরাগত বলেই মনে হতো। তার সম্পর্কে সেই সময়ে যেসব গুজব শোনা যেতো এসব সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানিনা।”
একথা ঠিক, হলিউডে মিলকানের ভাষায় নিজেকে প্রযোজক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো, এই গুপ্তচরবৃত্তি এবং অস্ত্রব্যবসার কারণে। মিলকান বলছেন - “হলিউড কখনোই কোনো অস্ত্র ব্যবসায়ীর সাথে আদর্শগত কারণে কাজ করতে চাইতো না, বিশেষ করে মেশিন গানের মতো মারণাস্ত্র ব্যবসায়ীর সাথে তো নয়ই। কোনো ছবি প্রযোজনার আগে আমাকে অন্তত আধাঘন্টা সময় ব্যয় করতে হতো তাদের বোঝাতে যে আমি কোনো আর্ম ডিলার নই। কেউ যদি জানতো কতবার আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলিউডে কাজ করেছি, তা শুধু নিজের দেশের জন্যেই।” কিন্তু মিলকানের কথাটা কত বড় একটা ধাপ্পা সেটা আমরা দেখতে পাই কিছুদিন আগে আমাদের বুধবারে প্রকাশিত, বেন আরওয়ান্ডের সাক্ষাৎকার থেকে। “The Collaboration : Hollywood’s Pact with Hitler”বইটির লেখকের সাক্ষাৎকার থেকে আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, হিটলারের সময়ে কীভাবে চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করে নাৎসি বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। কীভাবে ইউনিভার্সাল, প্যারামাউন্ট, টুয়েন্টিয়েথ পিকচার্স এর মতো বিখ্যাত সব হলিউড স্টুডিওগুলো এই কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো। কাজেই মিলকানের ক্ষেত্রেও যে হলিউড তার পুরোনো অবৈধ সব কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, মিলকান যতই হলিউডের পক্ষে সাফাই গাক না কেনো।
সবশেষে আমরা দেখি, তার এসব অস্ত্রচালান এবং গুপ্তচরবৃত্তিমূলক সমালোচনা সম্পর্কে আরনন মিলকান কি বলেছেন সেদিনের সেই সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানে - “তোমরা কি জানো, আমার দেশের বিশবছর বয়সি তরুণদের কাছে আমাকে কীভাবে দেখা হয়?জেম্স বন্ড। আহ! বিষয়টা বেশ উত্তেজক লাগে আমার কাছে! —লোকে জানলে জানুক, ফাক ইউ! — হ্যা, আমি এসব গুপ্তচরবৃত্তি আর অস্ত্রচালানের কাজ করেছি আর কেনো করেছি জানো?আমার নিজের দেশের জন্যে করেছি এবং সে জন্যে আমি গর্বিত।” এই হলো ৬৮ বছর বয়সি আরনন মিলকনের ভাষ্য। যে ভাষ্য আমাদের শুধু অবাকই করেনা, করে স্তম্ভিত। শুধু মিলকানের জন্যে না, একই সাথে হলিউডের জন্যেও। যে চলচ্চিত্র মানুষের মনন, চিন্তা আর বিবেকের বিকাশ ঘটায়, প্রগতি ঘটায় সেই চলচ্চিত্রশিল্পের বৃহত্তম ভূমিতে মিলকানের মতো মানুষকে সাদরে স্থান দেয়া হয়। ১৯৭০ থেকে মিলকান প্রায় ১২০-এর ওপর ছবি প্রযোজনা করেছেন। মিলকান বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং ইসরাইলের চতুর্থ ধর্নাঢ্য ব্যক্তি। যে অস্ত্র একদিকে মানুষের প্রাণ নাশ করে এক মুহূত্তের্, সেই একই অস্ত্র মানুষকে এভাবেই ধনঢ্যে রূপান্তরিত করে। আর তাই বর্তমান বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ বানিজ্যের নাম অস্ত্র বানিজ্য।।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন