আদিকাল থেকেই মানুষ কোন না কোন বস্ত্র পরিধান করে আসছে । বর্বরতার যুগে মানুষ গাছের ছাল-বাকল দ্বারা নিজেদের লজ্জাস্থান আবৃত করত । সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ হাতে বোনা কাপড় পরিধান করতে শুরু করে । তবে সর্বপ্রথম মানুষ মেশিনে সেলাইযুক্ত কাপড় ব্যবহার করতে শুরু করে ১৭৫৫ সালে । এর ২০৫ বছর পর বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে গার্মেন্টেস শিল্পের যাত্রা শুরু হয় । ১৯৬০ সালে ঢাকার উর্দুরোডে রিয়াজ গার্মেন্টস নামে একটি গার্মেন্টস স্থাপিত হয় । এ গার্মেন্টেসে উৎপাদিত পোশাক ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করা হয় । তবে ১৯৬৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস থেকে উৎপাদিত ১০,০০০ পিস শার্ট সর্বপ্রথম বিদেশে (ইংল্যান্ডে) রপ্তানি করা হয় । তবে আনুষ্ঠানিকভাবে মুলত ১৯৮১-১৯৮২ সালে গার্মেন্টস প্রস্তুত কারক ও গার্মেন্টস রপ্তানিকারক হিসেবে ০.১ বিলিয়ন টাকার রেডিমেট গার্মেন্টস রপ্তানি করে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পদচারণা আরম্ভ হয় । তবে উক্ত সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্টস শিল্পের উল্লেখযোগ্য কোন অবদান ছিল না । অথচ মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে ১৯৯২-১৯৯৩ সালে পোশাক রপ্তানির পরিমান ১৪৪৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারে উন্নীত হয় । এরপর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি । প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে । ২০১১-১২ অর্থবছরে যেখানে সর্বমোট পোশাক রপ্তানির পরিমান ছিল ১৯,০৮৯.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার । সেখান থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১,৫১৫.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমান ছিল ৯৬৫৩.২৫ মার্কিন ডলার । রপ্তানি আয় বাড়ার সাথে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সংখ্যাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে । বর্তমানে ব্যবসায়িক সংগঠন বিজিএমই সদস্যভূক্ত ৪ হাজার ৩শ’ গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে । এছাড়াও এর বাইরে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্যভূক্ত কারখান প্রায় ১ হাজার ।
গত ৩০ বছরে তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ ব্লাডে পরিনত হয়েছে । বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানিতে বর্তমানে চীন এবং ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান । বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের সর্বমোট ২৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে এককভাবে শতকরা ৮০ভাগ অর্জনের পাশাপাশি গার্মেন্টস খাত প্রত্যক্ষভাবে ৪০ লাখ দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে । আশার কথা হল, এ ৪০ লাখ দরিদ্র মানুষের মধ্যে ৮০% নারী শ্রমিক। নারীর ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গার্মেন্টস খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য । এছাড়াও গার্মেন্টস শিল্পে পরোক্ষভাবে আরও প্রায় ২ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে । উল্লেখ্য যে, মোট দেশজ আয়ের ১৬.৫% আসে এই গার্মেন্টস শিল্প থেকে । বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার পর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বেড়েছে তখন পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের পোশাক খাতকে অস্থির করে তোলার পায়তাঁরা করছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে ।
সম্প্রতি একটি প্রতিবেশী দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীতার নেপথ্য কারসাজিতে গার্মেন্টস শিল্পে ফের অস্থির ও অশান্ত হয়ে উঠেছে । সে দেশটি তাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়ে বাংলাদেশকে হটিয়ে বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে দুই নম্বরে উঠে এসেছে । অথচ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চিনের পরেই বাংলাদেশের স্থান ছিল । তাদের সে ষড়যন্ত্রের কারনে শুধু ঢাকার পার্শ্ববর্তী আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের সাড়ে ৩শ’ গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল । বন্ধ করে দেওয়া এ সকল কারখানায় কর্মরত প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক বস্তুত বেকার হয়ে পড়েছে এবং তাদের আয়ের উপর নির্ভরকৃত পরিবার গুলোতে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা ও অনিশ্চয়তা ।
পোশাক কারখানায় অগ্নিকান্ড, ধ্বসে পড়া, মালিক পক্ষের স্বেচ্ছাচার এবং শ্রমিক বিক্ষোভ বাংলাদেশের জন্য নতুন কোন ঘটনা নয় । ২০১৩ সালে গার্মেন্টেসে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রায় দুই সহস্রাধিক শ্রমিক মারা গেছে । শুধু সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে মারা গেছে ১১৭৬ জন । পুলিশের সাথে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সংঘর্ষেও বিভিন্ন সময় শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে । ২০০৯ সালের ৩১শে অক্টোবর গাজীপুরের টঙ্গিতে নিপ্পন গার্মেন্টেসে সহিংস ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ৩ জন শ্রমিক মারা যায় । নব্বই দশকের পর থেকে পশ্চিমা ক্রেতার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য শ্রমঘন্টা নির্ধারন, কাজের পরিবেশ তৈরি, কারখানার পরিবেশে উন্নীতকরণ, শিশুশ্রম বন্ধসহ বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিতে শুরু করে । ২০০০ সালের পরে এসে তাদের এ দাবী আরও শক্তিশালী হয়েছে । তবে ২০১৩সালের জরিপে দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের ত্রুটি থাকার কারনেই গার্মেন্টস শিল্পে বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনা ঘটছে । দুর্ঘটনাজনিত এ ভয়াবহতার মাত্রা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে । গার্মেন্টেস খাতে এ দূর্ঘটনার কারন হিসেবে দূর্বল শাসন ব্যবস্থা, আইনের শাসন বাস্তবায়িত না হওয়াই বহুলাংশে দায়ী । উপরন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক স্বার্থ মিলেমিশে গার্মেন্টস খাতকে দিনকে দিন কলুষিত করে ফেলছে । ফলে, সমাজের দুর্বল অংশের উপর শোষণ, অত্যাচার হওয়ার পরেও তার কোন বিচার হয়না । গার্মেন্টস খাতে বেতন বৃদ্ধির জন্য আপাতত কেন দাবী শ্রমিকদের নেই । কেননা ২০০৬ সালে যেখানে সর্বনিম্ন বেতন ১ হাজার ৬৬২টাকা ছিল সেখান থেকে ২০১৩ সালের পহেলা ডিসেম্বর থেকে ন্যূণতম ৫৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে । কাজেই শ্রমিকরা এখন বেতনবৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন করছে না বরং তারা যেন সঠিক সময় বেতন এবং ঈদ বোনাস পায় সেজন্য আবারও আন্দোলন শুরু হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে ।
আসন্ন রমযানের ঈদকে সামনে রেখে আবারও শ্রমিকরা রাস্তায় নামতে শুরু করেছে । ২০ রমযানের মধ্যে বেতন এবং বোনাস পরিশোধের জন্য তারা মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে । ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে তাদের আন্দোলনের মাত্রাও তত তীব্র হবে এতে কোন সন্দেহ নাই । কেননা গার্মেন্টেস কর্মরত শ্রমিকরা বছরের যে কোন সময় ইচ্ছা করলেই ছুটি পায় না । তাই তারা ঈদুল ফিতরে পরিবারের সাথে একত্রিত হওয়ার বাসনা বছরব্যাপীই পোষণ করে । এই সময় মালিকপক্ষ যদি তাদের বেতন এবং বোনাস পরিশোধ না করে তবে দেশের গার্মেন্টস খাত আবারও হুমকির মূখে পড়বে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা আবারও স্থিমিত হয়ে যাবে । কতিপয় গার্মেন্টস মালিকপক্ষ ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কাজ শুরু করেছে । অথচ ছাঁটাই করার পূর্বে শ্রমিকদের বকেয়া বিল পরিশোধ করছে না । গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তও গার্মেন্টস শিল্পকে অস্থির করে তুলবে । বিজিএমই এর তথ্য মতে, প্রায় ১০০০ হাজার গার্মেন্টস তাদের শ্রমিকদের বেতন এবং বোনাস ঈদের পূর্বে পরিশোধ করতে পারবে কিনা সন্দেহ । তাছাড়া বর্তমানে ১৭৬টি গার্মেন্টস কারখানা বিভিন্ন জটিলতায় বন্ধ আছে । সে সকল গার্মেন্টস কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরাও তাদের বেতন ভাতার দাবীতে রাস্তায় নামবে । কাজেই দেশের প্রধান আয়ের উৎস গার্মেন্টস খাত আবারও হুমকির মূখে পতিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে । এমনিতেই সাভারের রানাপ্লাজা দূর্ঘটনার পর থেকে গার্মেন্টস শিল্পের উপর বিভিন্ন খড়গ যাচ্ছে । যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত জিএসপি সুবিধা স্থগিত রেখেছে । ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের শ্রমিকদের রক্ত দিয়ে তৈরি পোশাক কিনবে না বলে বারবার হুমকি দিচ্ছে । এ সকল প্রতিকূল অবস্থার সাথে যদি শ্রমিক মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধে আবারও তৈরি পোশাক খাত অশান্ত হয়ে যায় তবে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের ৩ নম্বর স্থানটি মায়ানমার কিংবা অন্যকোন দেশ দখল করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই । শ্রমিকদের দাবী যৌক্তিক কিন্তু মালিকরাও খুব একটা সুবিধার অবস্থানে নাই । গত ডিসেম্বর মাসে থেকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত নতুন বেতন কাঠামোয় বোনাস এবং বেতন পরিশোধ করা অনেক গার্মেন্টস কারখানা কর্তৃপক্ষের জন্য প্রায় অসম্ভব । যাদের পক্ষে সম্ভব তারাও পিছুটান দেয়ার মানসিকতায় আছে ।
শ্রমিক-মালিকদের মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্ব নিরসন করতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে । দু’পক্ষের দাবী দাওয়া শুনে সরকার যদি কোন যৌক্তিক ফয়সালা দেয় তবে সেটা উভয়পক্ষ মানতে বাধ্য । শ্রমিক-মালিকদের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব যদি মেটানো না যায় তবে দেশের অপার সম্ভাবনার তৈরি পোশাক শিল্পে ধ্বংসের সাইরেন বাজবে । দেশের পোশাক শিল্প যদি পঙ্গু হয়ে যায় তবে দেশের অর্থনীতি টিকবে না । দেশকে এগিয়ে নিতে সরকার যতই পদক্ষেপ গ্রহন করুক তার সবগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য মূখ্য চালিকা শক্তি হিসেবে অর্থ কাজ করে । রাষ্ট্রের অর্থের যোগান যদি বাধা গ্রস্থ হয় তবে সকল উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে । দেশের ভাবমূর্তি বর্হিবিশ্বের কাছে উজ্জ্বল রাখতে এবং শ্রমিকদের সংঘাত এড়াতে সরকারকে দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে । শ্রমিকরা নিরলস শ্রম দেয় একটু সুখ পাবার আসায় । সেই সুখ যদি তাদের কপালে না জোটে তবে তাদের ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করতে দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না ।
লেখক : কলাম লেখক
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন