বিস্ময়কর যুদ্ধজয়
রীতিমত ঝড়ের বেগে এগিয়েছে দা্ওলাতে ইসলামিয়া ইরাক ও শাম (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এ্যান্ড সিরিয়া -সংক্ষেপে আইএসআইএস)এর মুজাহিদগণ। তাদের মাত্র ৮০০জন যোদ্ধা ইরাকী সেনাবাহিনীর ৩০ হাজার নিয়মিত সৈন্যকে পরাজিত করে দখল করে নিয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মোসল। মোসলে মোজাহিদের যুদ্ধটি ছিল ৩৭ জন ইরাকী সৈন্যের বিরুদ্ধে এক জন মোজাহিদের। কিন্তু সেখানে যুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধ না লড়েই সরকারি ইরাকী বাহিনী ভয়ে পালিয়েছে। তারা পলায়ন করেছে সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের জন্মস্থান তিকরিত শহর থেকে। পলায়ন করেছে কিরকুক শহর থেকেও। তবে কিরকুকে মোজাহিদগণ পৌঁছার আগেই সুযোগসন্ধানি কুর্দিরা শহরটি দখল করে নিয়েছে। তেলসমৃদ্ধ কিরকুকের উপর বিচ্ছিন্নবাদি কুর্দিদের বহুদিনের দাবী। তারা শহরটিকে কুর্দিস্থানে রাজধানি বানাতে চায়। এবার সুযোগ বুঝে দখল করে নিল। তবে এর ফলে দা্ওলাতে ইসলামিয়ার সাথে কুর্দিদের যুদ্ধটিও ভয়ানক রূপ নিবে। বর্তমানে যুদ্ধ হচ্ছে বাগদাদ শহর থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরের বাকুবা শহরের দখল নিয়ে। প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে কিরকুকের দখল নিয়ে। যুদ্ধ হচ্ছে স্ট্রাটেজীক শহর তালাওয়ারের চারপাশে। সেখানে রয়েছে বিমান বন্দর। যুদ্ধ চলছে বেয়জী শহরের চারপাশে। মুজাহিদদের দাবি তারা শহরটি দখল করে নিয়েছে। সেখানে অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ তেলশোধনাগর -ইরাকের শতকরা ৪০ ভাগ তেল আসে এই তেলশোধনাগার থেকে।
মুজাহিদগণ যেভাবে বিদ্যুৎ বেগে একের পর এক শহর দখল করে সামনে এগিয়েছে তাতে আতংক বেড়েছে সমগ্র পাশ্চাত্য মহলে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন গত ১৮ই জুন তারিখে পার্লামেন্টে বলেছেন ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এ্যান্ড সিরিয়ার এর বিজয় ব্রিটিশ নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হুমকি। একই ভয় মার্কিনীদের। তাদের ভয়, মুজাহিদদের অগ্রগতি রুখার সামর্থ ইরাকী সেনাবাহিনীর নেই। তারা যুদ্ধজয় দূরে থাক, যুদ্ধ লড়তেই রাজী নয়। অথচ মার্কিন বাহিনী যখন ইরাক ছাড়ে তখন বলেছিল, ইরাকী সেনাবাহিনী নিজেরাই দেশের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট। দখলদার মার্কিনীগণ বহু বছর ধরে বহু বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দুই লাখের বেশী সৈন্য নিয়ে সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সেটি যে আদৌ কোন সেনা বাহিনীই নয় –সেটিই রণভঙ্গ দিয়ে তারা প্রমাণ করলো। মার্কিন যুক্তরাষ্টসহ পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গ চায়, মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকবে একমাত্র ইসরাইলের, কোন মুসলিম দেশের নয়। মার্কিনী যুক্তরাষ্ট তাই চায়নি, ইরাক কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অধিকারি হোক। সেটিই এখন প্রমাণিত হলো।
যুদ্ধের অভিজ্ঞতার তো আসে যুদ্ধলড়ার মধ্য দিয়ে। ইরানের সাথে ৮ বছর যুদ্ধ লড়ে ইরাকী সেনাবাহিনী বিপুল দক্ষতা অর্জন করেছিল। কিন্তু মার্কিনীগণ ইরাক দখলে নেয়ার প্রথম সুযোগেই সে অভিজ্ঞ সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি ঘোষণা করে। ইরাকের জন্য তারা যেমন শক্তিশালী সেনাবাহিনী চায়নি, তেমনি বিমান বাহিনী বা নৌবাহিনীও চায়নি। মার্কিনীদের হাতে গড়া এ ইরাকী সেনাবাহিনীর কোন যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা নেই। অভিজ্ঞতা যা আছে তা হলো অফিস-আদালত, মন্ত্রীদের ঘরবাড়ি ও বিদেশী দূতাবাস পাহারা দেয়ার। সে সাথে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সাধারণ মানুষের দেহতল্লাশি করার। বিগত দশবছর যাবৎ ইরাকের সেনাবাহিনী সে কাজগুলিই দিবারাত্র করেছে। ফলে মোসল, তিকরিত বা কিরকুকে যখনই তারা যুদ্ধের পদধ্বনি শুনেছে তখনই গায়ের পোষাক, বুট ও অস্ত্র ফেলে রণাঙ্গণ থেকে দ্রুত পলায়ন করেছে। তাদের পলায়নের ফলে যুদ্ধ পৌঁছে গেছে বাগদাদের দোরগড়ায়। ভয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলি এখন বাগদাদ থেকে দ্রুত লোক সরাচ্ছে। সারা পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দূতাবাসটি হলো বাগদাদে। সেখানে কাজ করে সাড়ে ৫ হাজার মার্কিনী। তাদের পাহার দিতে ওবামা সরকার মার্কিন নৈ-বাহিনীর কয়েক শত সৈন্য পাঠিয়েছে। অপর দিকে ইরাকী প্রধানমন্ত্রি নূরী মালেকি নিজ সৈন্যদের উপর ভরসা না করে রণাঙ্গণে শিয়া মিলিশিয়াদের নামাচ্ছে।
কেন আতংক পাশ্চাত্য শিবিরে?
জিহাদীদের এত দ্রুত যুদ্ধজয়ের ব্যাখ্যা সামরিক বা রাজনৈতিক ভাবে দেয়া সম্ভব নয়। এমন যুদ্ধজয় চোখে আঙুল দিয়ে যা দেখিয়ে দেয় তা হলো, জনবল, অস্ত্রবল ও অর্থবলের বাইরেও মহাবিস্ময়কর বল আছে। যুদ্ধজয়ে সেটিই মূল ভূমিকা রাখে। সে মহাশক্তির বলে মানব ইতিহাসে বহু নিঃস্ব ও ক্ষুদ্র জনশক্তিও বড় বড় যুদ্ধজয় করেছে। এমনকি বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইসলামের মুলশক্তি তেলগ্যাস, সামরিক শক্তি বা জনশক্তি নয়। সেটি মহান আল্লাহতায়ালার শক্তি। এটি ঈমানের এতটাই বুনিয়াদি বিষয় যে, এরূপ বিশ্বাস না থাকাটাই শিরক। এমন শিরকের গুনাহ নিয়ে কোন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না। মুসলমানগণই যখনই আল্লাহর বাহিনীতে পরিণত হয় তখনই তারা অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে পরিণত হয়। তাদের জীবনে তখন লাগাতর বিজয়ও শুরু হয়। কারণ, সে বাহিনীর বিজয়ে মহান আল্লাহতায়ালা নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা সে সত্যটি বার বার বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহতায়ালার শক্তির বলেই বিশ্বশক্তি রূপে ইসলামের উত্থান হয়েছিল আরবের নিঃস্ব মরুপ্রান্তর থেকে। সেখানে না ছিল কোন জনশক্তি, না ছিল কোন সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তি। কিন্তু তাতে তাদের শক্তির অভাব হয়নি। তাদের সাহায্যে আল্লাহতায়ালার ফেরশতাগণ রণাঙ্গণে নেমে এসেছেন। রণাঙ্গনে যখন এমনটি ঘটে তখন ৩০ হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে ৮শত সৈন্যের বিজয়ও সম্ভব হয়। একই কারণে মাত্র ১৭ জন সৈন্যের হাতে অতীতে বিশাল বাংলা বিজয়ও সম্ভব হয়েছে। মুসলমানের জীবনে ঈমান আসলে, বার বার মোজেজাও আসে –এটিই হলো ইতিহাসের শিক্ষা। ইসলামের শত্রুশিবিরে এত ভয় ও আতংকের কারণ হলো এ মোজেজা। কারণ শয়তান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলেও তাঁর অপ্রতিরোধ্য শক্তি নিয়ে অজ্ঞ নয়। শয়তানের কাজ তাই মুসলমানদের মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিক হতে বাধা দেয়া।
মুসলিম দেশে জাতিয়তাবাদি, সমাজতন্ত্রি, রাজতন্ত্রি, স্বৈরাচারি ও সেক্যুলারদের সংখ্যা কোটি কোটি। তাদের শাসনও চলছে যুগ যুগ ধরে। নিজেরা মুসলিম রূপে দাবী করলেও তাদের হাতে মুসলিম বিশ্বের কোথাও কি কোন বিজয়, কল্যাণ বা শান্তি এসেছে? আসেনি; বরং এসেছে পরাজয়, বিভক্তি ও অপমান। তাদের আনন্দ তো ইসলামকে পরাজিত দেখার মধ্যে। তাদের নেতৃত্বে মুসলিমদেশের সেনাবাহিনী তাই নিজ জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে বর্বর গণহত্যা ও নির্যাতন। লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাধ্য করেছে দেশত্যাগে। সেটি যেমন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে হয়েছে। তেমনি হচ্ছে সিরিয়া, ইরাক, মিশরে। সিরিয়ার শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ আজ দেশত্যাগী তো তাদের কারণে। বাংলাদেশে তারা যেমন দুর্নীতি বিশ্বে প্রথম হওয়ার অপমান এনেছে, তেমনি অর্জন করেছে ভিক্ষার ঝুলির অপবাদও। বার বার প্রতিষ্ঠা করেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচার। দেশজুড়ে আজ চলছে শাপলা চত্বরের নিষ্ঠুরতা। আরব বিশ্বে এ শ্রেণীর লোকেরাই জন্ম দিয়েছে ২২টুকরায় বিভক্ত ভূগোল, এবং অস্ত্র ধরেছে সে বিভক্ত ভূগোলের প্রতিরক্ষায়। এনেছে ক্ষুদ্র ইসরাইলের হাতে বিশাল আরববাহিনীর অপমানজনক পরাজয়। এনেছে বর্বর স্বৈরাচার। এনেছে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে অসংখ্য রাজা-বাদশাহ। কিন্তু দা্ওলাতে ইসলামিয়া ইরাক ও শাম মুসলমানদের সামনে যে পথের কথা বলছে সেটি ভিন্ন পথ। এ পথে যেমন লাগাতর জিহাদ আছে, তেমনি শরিয়তের প্রতিষ্ঠা আছে এবং খেলাফতের অঙ্গিকারও আছে। ফল তাতে চমকও আছে। তাদের হাতে তাই আসছে উপর্যপরি বিজয়ও। ইসলামের সমগ্র ইতিহাসে একমাত্র এ পথেই মুসলমানগণ অতীতে বিজয়ী ও গৌরবের অধিকারি হয়েছে; এবং পরাজিত করতে পেরেছে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের ন্যায় দুই স্বৈরাচারি বর্বর বিশ্বশক্তিকে। নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের পথ তো এটিই। ইরাক ও সিরিয়ার কিছু লোক সে পথেই যাত্রা শুরু করেছে। আর তাতেই ভয় বেড়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের।
ইসলামের শত্রুপক্ষটিও জানে ইসলামের শক্তির উৎস্য কোথায়? তারা জানে, ইরাক ও সিরিয়া জুড়ে ইসলামি খেলাফত হলে ঘুমন্ত ইসলামি শক্তি আবার জেড়ে উঠবে। সেখানে মোজাহিদগণ তখন নিরাপদ আশ্রয় পাবে। এবং সংগঠিত হবে লাগাতর জিহাদ। অগণিত মানুষ তখন নিজেই অপ্রতিরোধ্য মিজাইলে পরিণত হবে। পাশ্চাত্যের ভয়, সে মিজাইল বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। তখন একের পর এক বিলুপ্ত হতে থাকবে সাম্রাজ্যবাদিদের গড়া মুসলিম বিশ্বে বিভক্তির সীমারেখা। সিরিয়া ও ইরাকের মাঝের সীমারেখাটি ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে। এরূপ চলতে থাকলে তাতে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রই নয়, পাল্টে যাবে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মানচিত্রও। ফলে পাশ্চাত্য শিবিরের অবস্থান এজন্যই খেলাফত ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। বারাক ওবামার ঘোষণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট কখনোই চাইবে না জিহাদীরা সিরিয়া বা ইরাকের কোথাও শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলুক। মেনে নিবে না শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। জিহাদীদের উপর হামলার বাহানা রূপে খাড়া করা হচ্ছে, ইরাকে জিহাদীরা গণহত্যা করছে। কিন্তু মুজাহিদের হাতে কোথায় ঘটেছে সে গণহত্যা? গণহত্যা তো চলছে সিরিয়ায়। গণহত্যা তো হয়েছে ইরাক ও আফগানিস্তানে। মার্কিনীরা শুধু ড্রোন হামলায় বহু হাজার মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইয়েমেন ও সোমালিয়াতে। মার্কিন আগ্রাসনে কারণে একমাত্র ইরাকেই ৫ লাখ ইরাকীর মৃত্যু হয়েছে এবং ৪০ লক্ষ ইরাকী ঘরছাড়া হয়েছে। বহু লক্ষ মানুষকে তারা হত্যা ও ঘরছাড়া করেছে আফগানিস্তানে। অথচ গণহত্যার এ নায়কগণ এখন গণহত্যার অভিযোগ আনছে ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকামি মোজাহিদদের বিরুদ্ধে। সিরিয়ায় স্বৈরাচারি বাশারের বাহিনী ১লাখ ৬০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ঘরছাড়া করেছে ৬৫ লাখ মানুষকে অর্থাৎ দেশের শতকরা ৪০ ভাগ জনগণকে। বাশার আল আসাদের বাহিনী যেমন রাসায়নিক বোমা ব্যবহার করেছে, তেমনি লাগাতর ব্যারেল বোমাও ব্যবহার করছে। কিন্তু পাশ্চাত্যশক্তিবর্গ তার গায়ে একটি আঁচড়ও দেয়নি। অথচ তাদের আক্রোশ ও সে সাথে সকল রণপ্রস্তুতি মোজাহিদদের বিরুদ্ধে। তাদের কাছে অতি অসহনীয় হয়ে পড়েছে মুজাহিদদের জিহাদ, শরিয়ত ও খেলাফত।
সাম্রাজ্যবাদীদের অপরাধ
মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদি শক্তির অপরাধ বহু। অপরাধ শুধু এ নয় যে, মুসলিম দেশগুলিকে তারা দখল নিয়েছে এবং ব্যাপক লুন্ঠন করেছে। বরং সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো মুসলিম ভূমিতে তারা শরিয়তের বিধানকে নির্মূল করেছে, এবং নির্মূল করেছে খেলাফতকে। বিলুপ্ত করেছে মুসলিম চেতনা থেকে শরিয়ত, খেলাফত ও জিহাদের ধারণাকেও। এভাবে অসম্ভব করেছে বিশুদ্ধ ইসলামী চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠা। মুসলিম দেশগুলি দখলে নেয়ার পর পরই জনগণকে খৃষ্টান বানাতে তারা বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রচারক নামায়। কিন্তু খৃষ্টানধর্মে ধর্মান্তরিত করার সে প্রজেক্ট কোন মুসলিম দেশেই সফলতা পায়নি। কিন্তু বিপুল সফলতা পেয়েছে মুসলমানকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজ। এটি হলো ডি-ইসলামাইজেশন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হিন্দু বা খৃষ্টান হয়ে যাওয়া অথবা অন্য ধর্মে দীক্ষা নেয়া আর ইসলামের থেকে দূরে সরার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? উভয়ই তো সিরাতুল মোস্তাকীম থেকে দূরে সরা। উভয়ই তো জাহান্নামের পথ। ঢাকার শাপলা চত্বরে মুসল্লিদের রক্তে যারা হোলি খেললো ও তাদের লাশকে ময়লার গাড়িতে তুলে যারা গায়েব করে দিল বা কায়রোর রাজপথে যারা প্রায় ২ হাজার নিরাপরাধ মুসলমানদের যারা ঠান্ডা মাথায় খুন করলো তারা কি খৃষ্টান ক্রসেডার বা বিজেপী-আরএসএস-শিবসেনার গুন্ডা? তারা তো ইসলাম থেকে দূরে সরা সামরিক ও রাজনৈতিক বাহিনীর লোক। একজন মুর্তিপুজারি হিন্দু যেমন তার মুর্তিপুজা ছাড়তে রাজি নয়, তেমনি ইসলাম থেকে দূরে সরা লোকগুলোও অনৈসলামের পথ ছাড়তে রাজী নয়। মুসলিম দেশগুলিতে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের প্রধানতম শত্রু হিন্দু, খৃষ্টান বা ইহুদীরা নয়, বরং ইসলাম থেকে দূরে সরা এ সেক্যুলার লোকগুলো। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ন্যায় প্রতিটি মুসলিম দেশে এরাই রুখছে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। মুসলমানদের নিজ ঘরে ইসলামের এমন শত্রুর উৎপাদন নিয়ে পাশ্চাত্য দেশে প্রতিদিন উৎসব হবে সেটিই কি কাম্য নয়? ইসলামের এরূপ শত্রুদের সাহায্য করতে তারা প্রস্তুতও।
কারারক্ষির দায়িত্ব হলো জেলের মাঝে গড়া দেয়ালগুলোকে বাঁচিযে রাখা। মুসলিম বিশ্বে তেমনি এক কারারক্ষির ভূমিকা নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স। তাদের কাজ, মুসলমানদের মাঝে গড়া বিভক্তির প্রাচির গুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। এজন্যই তারা বিভিন্ন মুসলিম দেশের অভ্যন্তরে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি রেখেছে। সেটি যেমন সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, কুয়েত এবং ওমানে, তেমনি আফগানিস্তানে। মুসলমানদের শক্তিহীন ও মর্যাদাহীন বিভক্ত অবস্থাকে তারা বলছে স্থিতিশীলতা। আর বিভক্তির দেয়াল ভাঙ্গার কাজকে বলছে অস্থিতশীলতা। এজন্যই ইরাক ও সিরিয়ার মোজাহিদের পক্ষ থেকে সিরিয়া ও ইরাকের সীমান্ত বিলুপ্তিকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছে। মনের সে কথাটি তারা গোপনও রাখছে না। সে অজুহাতে তারা এখন যুদ্ধে নামার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। সিরিয়াতে নিরাপরাধ মানুষের উপর ব্যারেল বোমা ও রাসায়নিক বোমা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বিগত তিন বছর যাবন। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ইতিমধ্যেই সেখানে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হত্যাকান্ড দিন দিন আরো তীব্রতর হচ্ছে। কিন্তু গণহত্যার এ বর্বর নায়ক বাশার আল আসাদ ও তার সৈন্যদের গাযে আঁচড় না দিয়ে তারা বোমা ও মিজা্ইল নিক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্রের মোজাহিদদের বিরুদ্ধে। ইরাকী সেনাবাহিনীকে সহায়তা দিতে মার্কিন সরকার ইতিমধ্যেই ৩০০ জন সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছে। এবং বিমানবাহি বিশাল নৌ-বহর পাঠিয়েছে পারস্য উপসাগরে।
শয়তানে বুজুর্গের পাশে ইরান
ইরান বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমিনী “শয়তানে বুজুর্গ” বা সবচেয়ে বড় শয়তান বলে অভিহিত করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। এখন সে মার্কিনীদে পাশে এখন ইরান। মার্কিনীগণ এখন সে অভিন্ন মার্কিনীই আছে, তাদের রাজনীতি ও দর্শন যেমন পাল্টায়নি, তেমনি পাল্টায়নি মুসলমানদের সাথে তাদের দুষমনিও। ইমাম খোমেনি যখন মার্কিনীদের “শয়তানে বুজুর্গ” বলেছেন তখনও তাদের হাতে আফগানিস্তান ও ইরাক অধিকৃত হওয়ার ন্যায় অপরাধ ঘটেনি। তাদের হাতে দেশদুটিতে যেরূপ বহু লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেটিও তখন হয়নি। আবু গারিব ও গোয়ান্তোনামার বে’ কারাগারের ন্যায় বীভৎস ইতিহাসও রচিত হয়নি। এরপরও তিনি মার্কিনীদের “শয়তানে বুজুর্গ” বলেছিলেন। এখন বেঁচে থাকলে তিনি কি বলতেনে সেটি ভাববার বিষয়। তাঁর আমলে মেহদী বাজারগান প্রধানমন্ত্রী পদ হারিয়েছেন এবং ড. ইব্রাহীম ইয়াজদী পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ থেকে উৎখাত হয়েছেন শুধু মার্কিনীদের সাথে ইরানের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়ার অপরাধে। কিন্তু ইরানের বর্তমান সরকার সে “শয়তানে বুজর্গ”এর সাথে এখন শুধু হাতই মিলাচ্ছে না, তাদের দুষ্টকাজে সহায়তাও করছে। লক্ষ্য স্রেফ ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার যে জিহাদ শুরু হয়েছে সেটি নস্যাৎ করা। ব্রিটিশ সরকার তাদের বহু বছরের তালাবন্ধ তেহরানস্থ দূতাবাসকে আবার খোলার ঘোষণা দিয়েছে। এখানেও উদ্দেশ্য অভিন্ন। ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদকে প্রতিহত করার কাজে ইরানের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। তবে ইরানের এরূপ ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী ভূমিকাটি নতুন নয়। শিয়ারা কখনই খেলাফতের পক্ষে ছিল না। ওসমানিয়া খলিফার বাহিনী যখন ইউরোপে যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত তখন তাদের পিঠে ইরান চাকু বসিয়েছে পূর্ব সীমান্তে হামলা করে। সে কাজে ইন্ধন ছিল ইউরোপীয় খৃষ্টানদের। ইরান তাদের থেকে শুধু উৎসাহ নয়, বিপুল সামরিক সহযোগিতাও পেয়েছে। অস্ত্রের পাশাপাশি তারা ইরানী সৈন্যদের প্রশিক্ষণের কাজে সামরিক এ্যাকাডেমিও খুলেছে। একারণেই ইউরোপীয় রণাঙ্গণ ছেড়ে উসমানিয়া খলিফাদের বার বার পূর্ব সীমান্তে মনযোগ দিতে হয়েছে।
সিরিয়াতেও ইরান স্বৈরাচারি বাশার আল আসাদের নৃশংস নিষ্টুরতার পক্ষ নিয়েছে। সেখানে ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য বিপুল সংখ্যক সেপাহে পাসদারানের সৈন্য পাঠিয়েছে। লেবানন থেকে হাজির করেছে শিয়া যোদ্ধাদের। সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পিতা হাফেজ আল আসাদ ১৯৮২ সালে হোমস নগরীতে হামলা চালিযে ইখওয়ানূল ইসলামের ৩০ হাজারের বেশী নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের হত্যা করেছিল। কামান ও ট্যাংকের গোলায় ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনে শহরটির উপর। লক্ষ্যণীয় হলো, ইমাম খোমিনী বেঁচে থাকা কালে ইরান সমর্থণ দিয়েছিল সিরিয়ার এ বর্বরতাকে। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আফিগানিস্তান হামলা করে তখনও ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গোপনে সাহায্য করেছে। তখন মার্কিনীদের হাতে তুলে দেয় তালেবান ঘাটিগুলোর অবস্থান। ফলে এটি সুস্পষ্ট যে, ইরান চায় না কোন দেশে সূন্নীগণ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করুক।
জিহাদ কি জঙ্গিবাদ?
ইসলামের শত্রুপক্ষ বা সেক্যুলারিস্টদের চেতনায় শরিয়ত ও খেলাফত বলে কিছু নাই। তেমনি জিহাদও নাই। জিহাদ তাদের কাছে কিছু ধর্মপাগলের পাগলামি। কারো কাছে সেটি জঙ্গিবাদ। জিহাদের ধারণা তো সে চেতনাতে স্থান পায় যেখানে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও ইবাদতের পাশাপাশি তাঁর নির্দেশিত কোরআনি বিধান প্রতিষ্ঠা নিয়ে আপোষহীন অঙ্গিকার আছে। জিহাদ তো ইসলামি সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার। তাই যেখানে জিহাদ নেই সেখানে সমাজ বিপ্লবও নাই। এ দর্শনের মূল কথা, আল্লাহর প্রতিটি হুকুমের প্রতিষ্ঠায় আজীবন লড়াই নিয়ে বাঁচা। মু’মিন ব্যক্তি সে চেতনার প্রকাশট ঘটায় জান ও মালের কোরবানি দিয়ে।
মুসলমানদের জীবনে যখন থেকে জিহাদ বিলুপ্ত হয়েছে তখন থেকে সমাজ বিপ্লবও বন্ধ হয়ে গেছে। তখন মুসলমানের বাঁচা শুরু হয়েছে উপর্যপরি পরাজয় ও অপমান নিয়ে। যে রাজনীতির মূল লক্ষ্য ক্ষমতা দখল এবং নিজ ভাষা, নিজ দল, নিজ গোত্র ও নিজ বর্ণের অহংকার নিয়ে বাঁচা -সে রাজনীতিতে কি জিহাদ স্থান পায়? সেক্যুলার রাজনীতিতে যুদ্ধ-বিগ্রহ আছে, খুনখারাবীও আছে, কিন্তু জিহাদ নেই। চুরি-ডাকাতি ও সন্ত্রাসের ন্যায় ক্ষমতালিপ্সার এ রাজনীতিতে জানমালের বিনিয়োগ আছে এবং রক্তপাতও আছে, কিন্তু ইবাদত নাই। প্রকৃত জঙ্গিবাদ তো এমন সেক্যুলার যুদ্ধবিগ্রহ ও খুনখারাবী। অথচ সত্যকে মিথ্যা বলার ন্যায় শরিয়ত ও খেলাফতের প্রতিষ্ঠা নিয়ে জিহাদ শুরূ হলে তাকে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস রূপে চিত্রিত করাই ইসলামের শত্রুদের রীতি। সেটি যেমন বিদেশীশত্রুরা বলে, তেমনি মুসলিম নামধারি স্বৈরাচারি জালেম শাসকেরাও বলে। নমরুদের কাছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং ফিরাউনের দরবারে হযরত মূসা (আঃ)ভাল কখনোই মানুষ রূপে চিহ্নিত হননি। তাদের কাছে মানব ইতিহাসের এ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা চিহ্নিত হয়েছিলেন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার শত্রু রূপে। সে মিথ্যা অভিযোগে নমরুদ ও ফিরাউন তাদের প্রাণনাশের পরিকল্পনা করেছিল। নমরুদ ও ফিরাউনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাদের বিচারবোধ ও মূল্যবোধ আজও বেঁচে আছে ইসলামের আজকের দূষমনদের মাঝে। তবে ইসলামের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে এমন গালিগালাজ এখন আর শুধু ইসলামের চিহ্নিত শত্রুদের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, তা উচ্চারিত হচ্ছে তাদের মুখেও যারা নিজেদের মুসলামন রূপে জাহির করে।
ইবাদত ও রাজনীতি
মুসলমান হওয়ার অর্থ হলো আজীবন মহান আল্লাহতায়ালার অনুগত গোলাম রূপে বাঁচা। এরূপ গোলামীই হলো ইবাদত। গোলামী এখানে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুম পালন। মুসলমানের ইবাদত তাই স্রেফ নামায-রোযা বা হজ-যাকাত পালন নয়। ইবাদত যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যে, তেমনি রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহে। রাজনীতির অঙ্গণে সে গোলামীটি হলো খেলাফত ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জিহাদ। ইসলামে এটি ফরজ। তাই যেদেশেই মুসলমান থাকে সে দেশে শুধু নামায-রোযা ও হজ-যাকাতই থাকে না, শরিয়ত ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদও থাকে। প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ জানমালের বিপুল কোরবানী দিয়েছেন এ কাজে। তাদের সে কোরবানির বদৌলতেই মুসলিমগণ বিশ্বমাঝে বিশ্বশক্তি রূপে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেড়েছিল।
মু’মিনের জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি গভীর আনুগত্যের প্রবল প্রকাশটি ঘটে তার সার্বভৌমত্ব, খেলাফত ও শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এ কাজ শুধু নামায-রোযা বা হজ-যাকাত নয়, জান ও মালের বিনিয়োগ চায়। জান ও মালের এমন বিনিয়োগের ফলেই মু’মিনের জীবনে জিহাদের জন্ম দেয়। তাই জিহাদের চেয়ে বড় ইবাদত আর কি হতে পারে? মুসলিম তো শহীদ হয় ও বিনাহিসাবে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি পায় তো সে জিহাদে আত্মদানের কারণে। একারণেই মু’মিনের রাজনীতি পবিত্র ইবাদত। মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে মু’মিনের প্রতিটি কর্মে যা সর্বপ্রথম হিসাবে আনা হয় তা হলো তার নিয়েত। মু’মিনের প্রতি কর্ম তো ইবাদতে পরিণত হয় আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাপূরণের নিয়েত থাকার কারণে। জায়নামাজে দাড়িয়ে খেলা-তামাশা, কুমন্ত্রনা বা ব্যবসাবাণিজ্যের নিয়েত করলে কি নামায হয়? একজন আলেমের রাজনীতিও স্রেফ আলেম হওয়ার জন্য ইবাদত হয় না যদি সে রাজনীতিতে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনের নিয়েত না থাকে। বরং সে রাজনীতি আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতার পথেও হতে পারে। রাজনীতিতে ইবাদতের নিয়েতটি হলো শরিয়ত ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার নিয়েত; নিয়েত এখানে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় ও মুসলমানের শক্তিবৃদ্ধি এবং আল্লাহর দ্বীনের শত্রুদের পরাজিত করার। কিন্তু রাজনীতির নিয়েত যখন জাতিয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, সৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র বা দলীয় শাসনের প্রতিষ্ঠা হয় তখন সে রাজনীতি পরিণত হয় আল্লাহর বিরুদ্ধে অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের রাজনীতিতে। এমন রাজনীতি ইসলামে হারাম। কোন মু’মিন সে রাজনীতিতে যোগ দিতে পারে? দেয় কি অর্থ, শ্রম ও জানের কোরবানি? এ রাজনীতি প্রাণ গেলে কি জান্নাত জুটে? অথচ অধিকাংশ মুসলিম দেশে সুদী ব্যাংক, মদজুয়া, অশ্লিলতা ও পতিতাবৃত্তির ব্যাভিচার যেমন বেঁচে আছে, তেমনি বেঁচে এ হারাম রাজনীতিও। মুসলমানগণ এমন রাজনীতিতে শুধু ভোটই দেয়না, জানমালের কোরবানিও দেয়।
অথচ ইসলামের শত্রুপক্ষের কাছে রাজনীতিতে জিহাদের নিয়েত রাখাটিই অপরাধ। সেটিকে তারা সন্ত্রাস বলে। ব্রিটিশগণ তাদের শাসনামলে জিহাদকে মাদ্রাসার সিলেবাস থেকেই বাদ দিয়েছিল। আর আজকের মুসলমানগণ বাদ দিয়েছে তাদের চেতনা থেকে। ফলে ইরাক ও সিরিয়ার মোজাহিদের শরিয়ত ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদকেও তারা মেনে নিতে পারছে না। সাম্রাজ্যবাদি শক্তির সাথে সুর মিলিযে তারাও তাদেরকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলছে। সিরিয়া ও ইরাকের মোজাহিদের বড় কৃতিত্ব যে, নির্ভয়ে তারা জিহাদের নিয়েতটির প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে এবং সে পথে তারা জান ও মালের বিপুল কোরবানিও দিচ্ছে। তারা নিয়েত বেঁধেছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বিভিন্ন রাষ্ট্রের নামে মুসলিম বিশ্বে বিভক্তির যে প্রাচীরগুলো গড়েছে সেগুলি সরানোর। অথচ বহু মুসলিম দেশে এমন খালেছ নিয়েত বহু ইসলামি দলের নেতাকর্মীদেরও নাই। বরং এমন বিভক্তিকে তারা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে, যেমন মেনে নিয়েছে মুসলিম পল্লিতে পতিতাদের ব্যাভিচারের বাজার। নামাযী ও রোযাদার হলেও তাদের নিয়েতের ক্ষেত্রটুকু দখল করে নিয়েছে সেক্যুলারিস্টদের সাথে একত্রে রাজনীতি করে নেতা হওয়া, সংসদ-সদস্য হওয়া বা মন্ত্রি হওয়ার লড়াই। তাদের থেকে ইরাক ও সিরিয়ার মোজাহিদগণ এজন্যই ভিন্নতর।
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তাঁর বন্ধু রূপে স্বীকৃতি পেতে হলে শয়তানি শক্তির কাছে শত্রু রূপে স্বীকৃতি পাওয়াটি জরুরী। নবী-রাসূলদের সেটিই সূন্নত। শয়তানি শক্তির বন্ধুকে আল্লাহতায়ালা কখনোই নিজের বন্ধু রূপে গ্রহণ করেন না। সেটি আল্লাহর সূন্নত। তাই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার হুশিয়ারি, “তোমরা কখনোই আমার ও তোমাদের শত্রুদের নিজেদের বন্ধু রূপে ঘোষণা করে না।” নবী-রাসূলগণ তাই কখনোই শয়তানি শক্তির বন্ধু বা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টাও করেননি। অথচ আজ বহু ইসলামি দল ইসলামের কথা বললেও তারা ভিন্ন পথ ধরেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ শয়তানি শক্তির কাছে গ্রহণ যোগ্যতা বাড়ানোর গরজে শরিয়ত ও খেলাফতের নাম মুখে আনতে রাজি নয়। রাজি নয় সাম্রাজ্যবাদি শক্তির গড়া বিভক্ত মানচিত্রের বিরুদ্ধে কথা বলতেও। এমনকি নরেন্দ্র মোদীর ন্যায় ভারতের মুসলিম-দুষমন নেতার কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তারা তার বিজয়কে অভিনন্দিত করে। এদিক দিয়ে দা্ওলাতে ইসলামিয়া ইরাক ও শাম (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এ্যান্ড সিরিয়া)এর অর্জন বা কৃতিত্বটি বিশাল। সাম্রাজ্যবাদি, জাতিয়তাবাদি, সমাজবাদি, রাজতন্ত্রি, নাস্তিক, সেক্যুলারিস্টসহ সকল জাতের ও সকল মতের ইসলামবিরোধী শয়তানি শক্তির কাছে তারা চিহ্নিত হয়েছে সবচেয়ে বড় শত্রু রূপে। ইসলামের এ শত্রুগণ বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বহু মুসলিম দেশের মাদ্রাসায় ও ইসলামি দলের অফিসগুলিতে বন্ধুর বেশে হাজির হলেও জিহাদীদের মাথার উপর নিক্ষেপ করছে ড্রোন। আল্লাহর দরবারে জিহাদীদের বিরুদ্ধে শয়তানী শক্তির এরূপ মূল্যায়ন যে অতিশয় গুরুত্ব পাবে তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে?
ভাষা, বর্ণ, ভূগোল, গোত্র ও দলভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম দেশগুলিতে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। প্রকান্ড যুদ্ধ হয়েছে মুসলিম দেশগুলি ভেঙ্গে ক্ষুদ্রতর করার কাজে। কিন্তু যুদ্ধ কি হচ্ছে খেলাফত ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলির একতা গড়ার লক্ষে? ইউরোপীয়রা আজ একতাবদ্ধ। তারা গড়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ভারতীয় হিন্দুরাও জন্ম দিয়েছে একতাবদ্ধ ভারতের। ইংরেজ, জার্মান, স্পানিশ, ফরাসী এরূপ নানা ভাষাভাষীর মানুষ উত্তর আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ফলে তারা গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। অথচ এমন একতাবদ্ধ হওয়াটি তাদের উপর ধর্মীয় ভাবে ফরজ ছিল না। কিন্তু মুসলমানদের উপর একতাবদ্ধ হওয়াটি তো ফরজ। বিভক্তি গড়া তো কবিরা গুনাহ। অথচ মুসলমানেরা বেছে নিয়েছে গুনাহর পথ। আজকের মুসলমানদের পরাজয়ের বড় কারণ তো এ বিভক্তি। ফলে খেলাফত, শরিয়ত ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলির একতা গড়ার লক্ষ্যে যে যুদ্ধ তার চেয়ে পবিত্র যুদ্ধ আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের কোথায়ও কি ভাষা, বর্ণ বা ভূগোলের জন্য যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন? বরং নির্দেশ এসেছে আল্লাহতায়ালার শরিয়তি আইন প্রতিষ্ঠার ও ইসলামের শত্রুদের প্রতিরোধের। নির্দেশ এসেছ একতাবদ্ধ হওয়ার। এটিই তো নবীজীর সূন্নত।
মহান আল্লাহতায়ালা মুসলমানকে সংজ্ঞায়ীত করতে গিয়ে বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মু’মিনে জান ও মাল ক্রয় করেছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে, তারা ইসলামের শত্রুদের হত্যা করে এবং নিজেরাও নিহত হয়।” –(সুরা তাওবা, আয়াত ১১১)। তাই মুসলান হ্ওয়া ও জান্নাত লাভের শর্ত হলো আল্লাহর কাছে নিজের জান ও মাল বিক্রয়ের প্রস্তুতি। সে প্রস্তুতি আল্লাহর পথে জিহাদের। আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আসে তো এমন জিহাদের বরকতে। তাই নামায-রোযা-হজ-যাকাত পালনে লোকসংখ্যা যতই বৃদ্ধি হোক তাতে ইসলামের বিজয় আসে না। হজে প্রতিবছর ৩০ বা ৩৫ লাখ লোক যোগ দেয়। বিশ লাখের বেশী জমায়েত হয় তাবলিগের ইজতেমাতে। কিন্তু সে সংখ্যা যদি ৩০ বা ৪০ কোটিও হয় তাতে কি ইসলামের বিজয় আসবে? ইসলামের বিজয় কি কোন কালেও হজের ও ওয়াজের জমায়েতে এসেছে? সে জন্য তো মুসলমানদের জিহাদের ময়দানে ছুটতে হয়েছে। শত্রুদের পরাজিত করতে হয়েছে তো রণাঙ্গণে। ইসলামের শত্রুগণ কি কখনো হজের বা তাবলিগের এজতেমায় এসে শক্তি পরিক্ষায় নামে?
নতুন সম্ভাবনার পথে
দুনিয়ার বুকে প্রায় ১৫০ কোটি মুসলমান। কিন্তু ইসলামের শত্রুগণ কি তাদের কাউকে শক্তি রূপে গণ্য করে? তাদের মতামতের কি গুরুত্ব আছে? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কত বিষয় নিয়ে কত বৈঠক বসে। কোন সময় কি ১৫০ কোটি মুসলমানের কাউকে ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়? অথচ সোয়া ৬ কোটি ব্রিটিশ বা সাড়ে ৬ কোটি ফরাসীদের মতামত না নিয়ে জাতিসংঘে কোন সিদ্ধান্তই হয় না। এমন এক প্রেক্ষাপটে ইরাক ও সিরিয়ার প্রায় ১০ হাজার মোজাহিদ রাতারাতি বিশাল শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইরাকের সরকার তাদের মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে ডাকছে শুধু মার্কিনীদের নয়, সকল প্রাশ্চাত্য শক্তিবর্গকে|। জিহাদীরা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে খেলাফত, শরিয়ত ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে একতাবদ্ধ করার লক্ষ্যে জিহাদ ঘোষণা করে। আজকের মধ্যপ্রাচ্যের বিভক্ত মানচিত্রটি গড়া হয়েছিল পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদি স্বার্থকে পাহারা দেয়ার জন্য। লক্ষ্য তেল-গ্যাস লুন্ঠন ও ইসরাইলের নিরাপত্তা-বিধান। পাহারা দেয়ার সে কাজে তারা নিয়োজিত করেছে নিজেদের বিশ্বস্থ গোলামদের। মুসলমানদের বিরুদ্ধে শয়তানের কৌশল বহু। তবে মূল কৌশলটি হলো, নানা বর্ণ, নানা ভাষা ও নানা ভৌগলিকতার নামে বিভক্ত করে তাদেরকে শক্তিহীন রাখা। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, জর্দান ও সৌদিআরবের মাঝে কোন কালেই বিভক্তির সীমারেখা ছিল না। জনগণের চলাচলে কোন কালেই কোন বাধা ছিল না। উমাইয়া খলিফাদের আমলে যেমন ছিল না, আব্বাসীয় খলিফাদের আমলেও ছিল না। ছিল না উসমানিয়া খলিফাদের আমলেও। সে সময় খেলাফত ছিল, শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছিল, এবং মুসলিম উম্মাহর একতাও ছিল। মাঝে মাঝে সরকারি উদ্যোগে তখন জিহাদের বিশাল বিশাল আয়োজনও হতো। একারণেই মুসলমানেরা তখন বিশ্বশক্তি ছিল। বিশ্বজুড়া ইজ্জতও ছিল। অথচ এখন কোনটাই নাই।
পকেট থেকে দশটি টাকা চুরি হলেও আফসোস হয়। অথচ মুসলমানদের যে এত কিছু ডাকাতি হয়ে গেল তা নিযে মাতম কই? কোন ঈমানদার ব্যক্তি কি এত কিছু হারানো বেদনা নিয়ে স্থির থাকতে পারে? আনন্দচিত্তে কি ঘুমোতে পারে? মৃতব্যক্তির হাতপা কেটে নিলেও তা নিয়ে ব্যাথা-বেদনা থাকে না। তেমনি ঈমানের মৃত্যু হলে খেলাফত বা শরিয়ত বিলুপ্ত হলেও তা নিয়ে দুঃথ হয় না। ঈমান যে বেঁচে আছে তার আলামত স্রেফ নামায-রোযা নয়। নামায-রোযা তো মুনাফিকের জীবনেও থাকে। বরং ঈমানের পরিচয় হলো, হারানোর মর্মবেদনা নিয়ে মাতম। ইসলামের পরাজয় নিয়ে প্রচন্ড দুঃখবোধ। তবে মু’মিন শুধু মাতম ও দুঃখবোধ নিয়ে বাঁচে না। বাঁচে হারানো গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জিহাদ নিয়ে। মাতম ও দুঃখবোধ তখন প্রচন্ড শক্তিতে পরিণত হয়। সিরিয়া ও ইরাকের বহু হাজার মুসলমানদের মাঝে ঈমান যে এখনো প্রচন্ড ভাবে বেঁচে আছে তার আলামত হলো খেলাফত ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার এ জিহাদ। ঈমানের এ জাগরনের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসলামের শত্রুশিবিরে এত ভয়। অপর দিকে মুসলিম বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে এক বিপুল সম্ভাবনা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন