সেই স্বপ্নের তপোবন নেই। সেই সুরঞ্জনা, সেই ফলবতী কামরাঙ্গা গাছ, সেই সবুজ লন, সেই আমগাছ, এক চিলতে বারান্দা, সিঁড়ি বেয়ে খোলা ছাদ... সেই মনমাতানো, নিজের মতো করে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া সুপরিসর খোলা লাল ইটের বেদনারাঙা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আঙ্গিনা নেই। বরং তার জায়গা নিয়েছে এক সুপরিসর বহুতল ভবন। সেই ভবনের পাশে আবার জেগে উঠেছে অশোক গাছটি। আবার সবুজ পাতা মেলতে শুরু করেছে। নানা রঙের ফুল ফুটতে শুরু করেছে। প্রতিদিন প্রায় প্রতিক্ষণে এই সুপরিসর সুউচ্চ স্থাপত্য নকশাময় ভবনটির প্রতিটি ইঞ্চিকে আবার নতুন করে সাজাচ্ছেন একজন মানুষ। তার সঙ্গীরা বিরক্ত। কিন্তু তিনি ক্লান্তিহীন। এখানকার কাচ সরাচ্ছেন, ওখানে ছাদ ভাঙছেন, সেখানকার টেবিলটার রঙ বদলাচ্ছেন, যেন নিত্যদিন নতুন সৃষ্টির খেলায় মেতে আছেন। বেদনার আর্তি একদিন তাকে যে পথে ঠেলেছিল, আজ প্রতিষ্ঠার আনন্দ তাকে ঠিক সেরকম মগ্নই রেখেছে। মানুষের চিত্তের আলোকায়ন ঘটানোর চেষ্টাই তার নিত্যভাবনা। তাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নতুন ভবনের প্রতিটি কোণায় পড়ছে তার ছায়া। একজন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আর একটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠছে। একের ছায়া অপরকে ঘিরে রাখছে। এই আলো-ছায়ার খেলাতেই কেটে গেল ৩৫ বছর। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাড়ে তিন দশকি যাত্রা পেরিয়েছে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। তার আনুষ্ঠানিক উৎসব আয়োজন হচ্ছে ১৪ মার্চ ২০১৪। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৩৫ বছর পূর্তি উৎসবকে উপলক্ষ ধরে লিখেছেন শুভ কিবরিয়া
১.
আশির দশকের শেষপ্রান্তে এসে বাংলাদেশের রাজনীতি আর অর্থনীতিতে যে নতুন পরিবর্তন আসে তার বড় ধাক্কা পড়ে সমাজে। বাজার অর্থনীতির নতুন হাওয়া পুঁজির চরিত্রের যে বদল আনে তাতে তৈরি হতে থাকে একটা নতুন বুর্জোয়া ক্ষমতাবান শ্রেণী। অনিয়ম, লুণ্ঠন, দখলদারিত্বের প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার এবং সুবিধার বিনিময়ে অর্জিত সেই প্রাথমিক অনৈতিক পুঁজি একদিকে যেমন আমাদের বৈষয়িক সমৃদ্ধি বাড়াতে থাকে, ঠিক তেমনই করে কমাতে থাকে সামাজিক মূল্যবোধকে। এক শ্রীহীন, হিংস্র, বৈষয়িক উন্নতি-অন্ধ চরিত্রহীন বোধ গ্রাস করতে থাকে আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সৎ, বিনয়ী, আদর্শবান, মননশীল মানুষদের হটিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ অসংস্কৃত, দানবীয় মানুষ দখল নিতে থাকে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে। এই নুইয়ে পড়া মূল্যবোধের সবচেয়ে বড় আক্রমণটা আসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বছরের পর বছর ধরে আদর্শ, মূল্যবোধ সুউন্নত জীবনবোধের কথা বলা শিক্ষকদের সামনে হঠাৎ করে শ্রীহীন, কদাকার ছাত্ররাজনীতি আর নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ভয়াল চেহারার এক কালোঝড় আনে। আমাদের ছাত্রসমাজের বড় অংশ বৈষয়িক প্রতিষ্ঠার চোরাবালিতে হাবুডুবু খেতে থাকে। ক্লাস, বই, উচ্চায়ত চিন্তার চাইতে রাজনৈতিক সংঘবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বৈষয়িক অনৈতিক উন্নতিভাবনা তাদের মোহগ্রস্ত করে ফেলে।
মূল রাজনীতি, মূল অর্থনীতি যখন বাজার আর মুনাফার নয়াটানে বেঘোর, তার সরাসরি প্রভাব পড়তে থাকে দেশের উচ্চ শিক্ষায়তনগুলোয়। ক্লাস ছেড়ে মিছিলের হৈ হট্টগোল, দলবাজি, রাজনৈতিক পেশিশক্তির এই প্রিয়তা শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশকে টানে। শিক্ষার্থীদের আরেকটি ক্ষীণ অংশ নিজেদের ক্রমশ সংকুচিত করে উচ্চ নাম্বারের সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য আত্মকেন্দ্রিক মগ্নতায় সমাজভাবনা থেকে দূরে সরে নিজেদের বৈষয়িক উন্নতির ভাবনাকেই শ্রেয়তর বলে ভাবতে থাকে। এই ভয়ানক দুঃখদিন দেশ ভাবনাকাতর একজন বেদনাবান শিক্ষককে আহত করে। রক্তাক্ত হতে থাকেন তিনি। সেই দুঃখদিনে নিজের মনের ভাবনা প্রকাশ করে লেখেন, ‘ভেতরটা কষ্টে হু হু করে উঠল। তাহলে কাদের জন্য আমার এতদিনের উৎকণ্ঠা, চেষ্টা, শ্রম? কাদেরকে বড় স্বপ্ন, বড় আনন্দের শক্তিমন্ত মানুষ করে তোলার জন্য এতদিন এই জীবনকে তিল তিল করে ক্ষয় করে এসেছি। যাদের জন্য এত জীবনপাত আর কষ্ট, তারাই যখন এর বিরুদ্ধে তখন শেষ হোক এই পর্ব।’
২.
এই বিপন্নতার কালে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি ঢাকা কলেজের জনপ্রিয়তম শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বুঝে নেন, এই প্রচলিত শিক্ষায়তন, রাষ্ট্রচালিত বিদ্যায়তনে আর নয়। ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনের অবসান ঘটাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন তিনি। দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে সুহৃদ, ছাত্র, সহকর্মী, পরিবারের সদস্য কারও অনুরোধ তাকে থামাতে পারেনি। অনিবার্য অনিশ্চয়তায় ভরা এক বৈষয়িক জীবনকে মেনে নিয়েই বেদনাজাগ্রত হৃদয়ে তিনি বেরিয়ে আসেন নয়াযুদ্ধে। সুনিশ্চিত মননে ভাবেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।’ মানুষের স্বপ্নই তার গন্তব্য।
জনপ্রিয়তম শিক্ষক, টেলিভিশনের উজ্জ্বলতম তারকা, সেরা অনুষ্ঠান উপস্থাপকদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার স্বপ্ন গন্তব্যে এভাবেই হেঁটেছেন। নিত্য তিনি সীমানা লঙ্ঘন করেছেন। তার নিজের সীমানা, পরিপার্শ্বের সীমানা। প্রতিষ্ঠানের সীমানা। ভাবনার সীমানা। তাই আজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে নিয়ে তিনি সগর্বে লিখতে পারেন-
‘টাকা দিয়ে কী করা যায়, এদেশে তা দেখিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান
টাকা ছাড়া কী করা যায়, তা দেখিয়েছি আমরা।’
৩.
‘যত ছোট আকারেই হোক, বাংলাদেশে যে বুর্জোয়া বিকাশ একদিন শুরু হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার অন্যতম প্রথম দলিল’-সামাজিক স্তর বিন্যাসের এই ব্যাখ্যা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিজস্ব। কিন্তু পরিপার্শ্বের দিকে তাকালে, ‘আলোকিত মানুষ চাই’-সেøাগানমুখর কর্মকাণ্ডের গভীরে চোখ রাখলে আজ মনে হয় বুর্জোয়া বিকাশের সকল ক্লেদের বিরুদ্ধে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এক নতুন সৌরভ হয়ে গন্ধ ছড়াচ্ছে প্রতিক্ষণ। মানুষের মননশীল বিকাশ ত্বরান্বিত করার নিত্য হাওয়ারত এক দীপান্বিত উচ্ছল স্বপ্ন ফেরি করা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের রূপরেখায় তার নিজের পরিচয় বর্ণনা করা আছে এভাবেÑ
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
আজ আর শুধুমাত্র
একটি ‘প্রতিষ্ঠান’ নয়।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ একটি
দেশব্যাপী আন্দোলন। আলোকিত
জাতীয় চিত্তের
একটি বিনীত নিশ্চয়তা।
মানবজ্ঞানের সামগ্রিক চর্চা
এবং অনুশীলনের পাশাপাশি
হৃদয়ের উৎকর্ষ ও জীবনের
বহুচিত্র কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে
পরিপূর্ণ শক্তি ও মনুষ্যত্বে
বিকশিত হবার একটি সপ্রাণ পৃথিবী।
৪.
সায়ীদ স্যার তার বেদনাজাগ্রত হৃদয় নিয়ে বৈভবময়, বৈচিত্র্যপূর্ণ মূল্যবোধসম্পন্ন এক বাংলাদেশের আশায় নিত্য কর্মযজ্ঞে মেতে আছেন। তিনি ভাবেন ছোট মানুষ দিয়ে বড় দেশ তৈরি করা সম্ভব নয়। বড় বাংলাদেশ চাইলে, চিত্তবৈভবময় বড় মানুষ লাগবেই। প্রচলিত বিদ্যায়তন সেই মননশীল, উৎকর্ষমণ্ডিত মানুষ তৈরিতে যেখানে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানেই কাজ করতে হবে নতুন উদ্যমে। তাই তার ব্যক্তিগত আকুতি, ‘আমি একটা নতুন জাতির নির্মাণ পর্বের মানুষ ছিলাম। আমার কালের সবার মতো আমিও ছিলাম এই জাতির অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা এবং জনক।
এই জাতির জন্মমুহূর্তের আনন্দাশ্রুতে আমার দুই কপোল সিক্ত! আমার প্রিয় মানুষদের ভাঙা করোটির ভেতর থেকে অনেক দীর্ঘ চিকন ঘাস বহুবার গজিয়ে উঠে আবার মাটির সাথে মিশে গেছে।
এই জাতির নিশ্চিত স্থায়িত্বের সামনেই এখন আমি আপাদমস্তক নতজানু।
আমার প্রতিটি প্রাণকোষ এখন নির্মাণের বলীয়ান সক্রিয়তায় উদগ্রীব।
আমার সামনে এখন কাজ আর সংগঠনের বলিষ্ঠ পৃথিবী।
অস্তিত্বের সূক্ষ্ম জটিল বিশ্লেষণ, আত্মবাদী দর্শনের সুউচ্চ শিখর আমার জন্যে এখন অবক্ষয়ী বিলাসিতা।
আমার উদ্ধার এখন সম্মিলিত যুথবদ্ধতায়, ব্যক্তিসত্তার সাধ্যমত বিনাশে।’
৫.
ব্যক্তির সাধ্যমতো চেষ্টায়, অযুত মানুষের ভালোবাসায়, সম্পন্ন মানুষের স্বপ্নে গত ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশের আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু হলেও গত সাড়ে তিন দশকে সারাদেশে, এমনকি দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে এর কর্মকাণ্ড। বহুধা বিস্তৃত এই কর্মকাণ্ডের নানা আঙ্গিক সময়ে সময়ে বদলেছে। এখানকার অর্থযোগের চেহারা পাল্টেছে। ব্যবস্থাপনার মান পরিবর্তিত হয়েছে। প্রযুক্তি আর পেশাদারিত্বে পরিবর্তন এসেছে।
বহু পুরনো মানুষকে কেন্দ্র ছেড়েছে, অনেক নতুন মানুষ এখানে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বপ্ন আরও বড় হয়েছে। জনভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বই পাঠের মধ্য দিয়ে হৃদয়ের আলোকায়ন ঘটিয়ে উন্নততর জীবনসন্ধানী একদল মানুষ তৈরি হবে, তারাই বদলে দেবে বাংলাদেশ, এই লক্ষ্যে ৩৫ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন, নিদ্রাহীন কর্মে জাগ্রত আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার মতো করে। দুরূহ যন্ত্রণাজাত একটি অলীক ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে যে শ্রম, নিষ্ঠা অধ্যবসায়, কষ্টস্বীকার করা লাগে, তা অব্যাহত রেখেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অগণন কর্মী, সুহৃদ, শুভানুধ্যায়ী, স্বেচ্ছাসেবী, আত্ম্যোৎসর্গিত প্রাণ। আর এই জাগ্রত-উৎসাহী-প্রাণবান-স্বপ্নস্পর্ধিত দলের নেতা হিসেবে এখনও সমানতালে এগিয়ে চলেছেন সায়ীদ স্যার।
৬.
সমাজের মধ্যে সবসময় অগ্রগামী চিন্তার একদল বেদনাবান মানুষ আছেন, যারা সময়কে স্পর্শ করে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। কখনো এদের একক চিন্তা, কখনো সমবেত চিন্তা, কখনো তাদের হাতে নির্মিত প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে, ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনে নিয়ামক হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য তো বটেই প্রাচ্যের ইতিহাসে এরকম চিন্তাজাগানিয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আলোকদ্যুতির মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে। এ উপমহাদেশে বঙ্গভঙ্গের পর তৎকালীন পূর্ববাংলায় শিখা গোষ্ঠীর চিন্তার আলো ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে। ষাটের দশকের সামাজিক-রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরবর্তীতে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের চিন্তার জায়গাকে প্রভাবিত করেছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রুচি ও উন্নত মূল্যবোধের যে নিম্নগামিতা অবশ্যম্ভাবী হয়েছে, তার প্রভাব আমাদের রাজনীতিতে খুবই প্রকট হয়ে দেখা যাচ্ছে। এই নিম্নমানের অপরিশীলিত, ব্যক্তিপূজাকেন্দ্রিক রুচিহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের চেতনাজগতে বিপরীত ধারার সৃষ্টির চেষ্টার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার অন্যতম।
খালি চোখে, জাগতিক সূচকের মানদণ্ডে এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক ফলাফল দেখা সম্ভব নয়। আবার চলমান প্রক্রিয়ায় ফুটবল মাঠের গোলের ফলাফলে নির্ধারিত জয়-পরাজয়ের মতো তা খুব উজ্জ্বলভাবে সবার চোখের সামনে দেখা দেবে, ব্যাপারটি সেরকমও নয়। উন্নতমানের বই পাঠ, বই নিয়ে ভাবনাচিন্তা, সঙ্গীত-শিল্পকলা-চিত্রকলা-ফটোগ্রাফি-সিনেমার মতো সৃজনশীল মননধর্মী চিন্তাজাগানিয়া বিষয়াদির লাগাতার চর্চা এমন সূক্ষ্ম বিষয় যার সংখ্যাতত্ত্বে বিচার অসম্ভব।
কিন্তু ঢাকা শহরসহ জেলা শহরগুলোতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মোবাইল লাইব্রেরি কার্যক্রম, সারাদেশের হাজার হাজার স্কুল-কলেজে বই পাঠের মাধ্যমে প্রতি বছর লাখ-লাখ শিক্ষার্থীর জন্য মানবিক উৎকর্ষ কার্যক্রম, বই পড়ে বই পুরস্কার দেয়ার প্রণোদনামূলক কার্যক্রম, আলোর ইশকুলের মাধ্যমে সঙ্গীত-শিল্পকলা-চিত্রকলা-রাজনীতি-ইতিহাস-সমাজ বিষয়ে নিয়মিত পাঠচক্রে সুদীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন পাঠ কার্যক্রম, ইংরেজি শিক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে সহজে বাংলা অর্থ ও উচ্চারণসহ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ইংরেজিতে পাঠ কার্যক্রম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রকাশনার মাধ্যমে বাজারে কাটতিহীন অথচ চিরায়ত সাহিত্য-দর্শনের বইয়ের প্রকাশনা অব্যাহত রাখা ও বই বাজারে তা সরবরাহ করাসহ অনলাইনে বই পাঠের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রায় নিভৃতে প্রতিবছর লাখ-লাখ তরুণ হৃদয়কে আলোড়িত করছে।
যখন সবাই সার্টিফিকেটনির্ভর মুখস্থ বিদ্যা আয়ত্ত করে জীবিকার বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে এবং সেটাই মূলস্রোত, তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার বিপরীতে, তার সমান্তরালে এক ভিন্নধর্মী সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে আলোকিত মানুষ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। স্রোতের বিপরীতে, স্রোতের বিরুদ্ধে এ লড়াই শত হতাশার মধ্যেও এক সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল আলোকময় কল্যাণকামী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে রাখছে। জাতির নিয়তি পরিবর্তনে আত্মোৎসর্গের ব্রত নিয়ে অহর্নিশি জেগে আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গত ৩৫ বছর ধরে। তাই হয়ত এ প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি পুস্তকে লেখা আছেÑ
‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কোনো গৎ-বাঁধা, ছক-কাটা, প্রাণহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সপ্রাণ সজীব পরিবেশÑজ্ঞান ও জীবন-সংগ্রামের আনন্দ-দ্বৈরথে নিরন্তর অবগাহন সেরে সম্পূর্ণতর মনুষ্যত্বে ও উন্নততর আনন্দে জেগে ওঠার এক অবারিত পৃথিবী।....
এক কথায়, যাঁরা সংস্কৃতিবান, কার্যকর, ঋদ্ধ মানুষ-যাঁরা অনুসন্ধিৎসু, সৌন্দর্যপ্রবণ, সত্যান্বেষী; যাঁরা জ্ঞানার্থী, সক্রিয়, সৃজনশীল ও মানবকল্যাণে সংশপ্তক-‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ তাঁদের পদপাতে, মানসবাণিজ্যে, বন্ধুতায়, উষ্ণতায় সচকিত একটি অঙ্গন।’
৭.
৩৬ বছরে পা রেখেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আগামী ১৪ মার্চ শুক্রবার দিনব্যাপী এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৩৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের জন্মযাত্রার সাত বছরের মাথায় শুরু হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বাংলাদেশ তার তাবৎ সমস্যা নিয়ে, বহুরকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে চলেছে। অনেক বর্জনের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। নারী শিক্ষা, শিশু মৃত্যুর হার রোধ, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি নানা বিবেচনায় বাংলাদেশ তার চারপাশের অনেক বড় দেশকে পিছিয়ে এগিয়ে গেছে। আজ সংখ্যাবিবেচনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে কোয়ালিটিতে, গুণগত মান উন্নয়নে। আজ তাই আমাদের লড়াই কোয়ানটিটি নয়, কোয়ালিটি প্রতিষ্ঠার। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সর্বত্রই আজ দরকার গুণগত মানসম্পন্ন আলোকিত টেকসই বৈষম্যহীন উন্নয়ন। আর এটা সম্ভব কেবল তখনই যখন আলোকিত বৈভবময় উৎকর্ষমণ্ডিত মানুষেরা দলে দলে এগিয়ে আসবেন সকল ক্ষেত্রে, সকল কর্মে। আলোকিত হৃদয় সংবলিত মানুষদের সম্মিলনেই তৈরি হবে এক উন্নততর বাংলাদেশের। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাই আজ আমাদের বড় স্বপ্নের জায়গা। ভালোবাসার পীঠস্থান। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আশাবাদী এক আলোকিত জীবনের স্বপ্নবীজ বুনে দীক্ষা দেয় নিজ নিজ কর্মে মনোনিবেশের। এই শিক্ষার আলো কেন্দ্র থেকে পরিধিতে যত ব্যাপ্ত হবে, তত বড় হবে দেশ, শ্রেষ্ঠত্ব পাবে মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
৮.
পুনশ্চ : লেখাটা শেষ করতে চাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি লেখা দিয়েইÑ
একটা গল্প শুনেছিলাম কিছুদিন আগে। গল্পটা অদ্ভুত। গল্পটা পাঁচ-ছয় বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটা যেমন দুর্দান্ত আর ডানপিটে, তেমনি বুদ্ধিমান। কখন কী অঘটন ঘটিয়ে বসে এ নিয়ে বাসার সবাই তটস্থ।
ছেলেটার বাবা যে-ঘরটায় পড়াশোনা করেন, তার দেয়ালে ছিল একটা ছোট্ট সাইজের মানচিত্র। মানচিত্রটা নেহাতই মামুলি, কিন্তু পেশাগত কারণে ওটা ছাড়া ভদ্রলোকের একমুহূর্তও চলে না।
একদিন সকালে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই দেখলেন, দেয়ালে মানচিত্র নেই। বুঝতে তাঁর বাকি রইল না, সেটা কোথায়। ছুটে গেলেন ছেলের ঘরে। যা আশঙ্কা করে গিয়েছিলেন, দেখলেনও তাই। ছেলের অসামান্য প্রতিভার ছোঁয়ায় মানচিত্রটা ততক্ষণে ছেঁড়া কুটি কুটি হয়ে ছড়িয়ে আছে ঘরের মেঝের ওপর।
কী করে এই মানচিত্র জোড়া দেয়া যায় এখন? রাগে হতাশায় দপদপ করতে থাকে ভদ্রলোকের মাথার শিরা। ক্ষোভের মাথায় ছেলের দুই গালে দুই চড় কষে খেঁকিয়ে উঠলেন : ‘ছিঁড়লি তো মনের সুখে! পারবি, পারবি এখন ছেঁড়া কাগজগুলো জোড়া দিয়ে আগের ম্যাপটা বানাতে?’ বলে নিরুপায়ের মতো ফিরে গেলেন নিজের ঘরে।
ঘণ্টাখানেকও যায়নি, ভদ্রলোক ঘরে বসে কাজ করছেন; হঠাৎ ছেলে এসে হাজির। হাতে আগের সেই হুবহু মানচিত্র। তার অপকর্মের ফসল টুকরো ছেঁড়া কাগজগুলো জোড়া দিয়ে ম্যাপটা ফের বানিয়ে তুলেছে সে। ছেলের বয়স বড়জোর পাঁচ-ছয়। মানচিত্র তার তো চেনার কথা নয়! এমন নিখুঁত করে কীভাবে জোড়া লাগল সে-মানচিত্রটা! অবাক হয়ে ভাবলেন ভদ্রলোক।
‘মানচিত্রটা চিনতি তুই?’ প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘না।’
‘তাহলে ঠিকঠাক জোড়া লাগালি কী করে?’
‘বারে, মানচিত্রটার উল্টোপিঠে ইয়াবড় একটা মানুষের ছবি ছিল যে! দেখনি তুমি? ছেঁড়া টুকরোগুলো জোড়া দিয়ে সেই মানুষটাকে আস্তে আস্তে বানিয়ে ফেলেছি, উল্টোপিঠের মানচিত্রটা তার সঙ্গে আপসাফ জোড়া লেগে গেছে।’
গল্পটা এখানেই শেষ।
শুনে মনে হয়েছিল, আমাদের জাতির ছেঁড়া, ভেঙে-পড়া মানুষটাকে যদি জোড়া দিয়ে এমনি ঠিকমতো গড়ে তোলা যায়, তবে আমাদের মানচিত্র অর্থাৎ দেশটাও তো এমনিতেই গড়ে উঠতে পারে। আমরা সারাদেশের সবখানে সেই মানুষকেই তো আজ গড়ে-তোলার চেষ্টা করছি। দেশ কি এর সাথে একদিন গড়ে উঠবে না?
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর ভাবনা
* আজ চারপাশ থেকে ঘিরে-আসা গাঢ় অন্ধকারের ভেতর আমাদের যা সবচেয়ে বেশি দরকার তার নাম ‘আলো’। সামান্যতম হলেও, ভিক্ষার মতো তুচ্ছ আর অসম্মানজনক হলেওÑছোট্ট একমুষ্টি আলো।
* ইংরেজ বেনিয়ারা একদিন যেভাবে এদেশের মানুষকে ‘চা’ ধরিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে আজ বই ধরাতে হবে আমাদের। বই ধরানোর প্রক্রিয়া হবে ‘চা’ ধরানোরই অনুরূপÑহুবহু এক। শুধু উদ্দেশ্য হবে আলাদা। হাজার হাজার বই পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আজ সারাদেশের ছেলেমেয়েদের পড়ার আনন্দে মাতিয়ে তুলতে হবে। আর সেই সঙ্গে যুক্ত করতে হবে মানসিক বিকাশের উপযোগী সুন্দর সাংস্কৃতিক সব কর্মসূচি। ভালো ভালো পুরস্কারের প্রলোভনের সামনে ফেলে তাদের জয়ের পিপাসাকে দীপিত করে তুলতে হবে। কিন্তু তা কেবল বই পড়ার মত একটা উচ্চায়ত দরকারেই। এভাবেই নিজের অজান্তে তারা গৃহীত হয়ে যাবে বইÑএর অমেয় অনির্বচনীয় জগতে। বইয়ের ভেতর দিয়ে বিকাশের দিকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা শ্রেয় ও মহানের জন্য আর্ত হয়ে উঠবে।
* বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লক্ষ্যটা কিন্তু সামান্য : ‘আরো একটু ভালো’। জীবন, সৌন্দর্য, বাস্তবতা, সংগ্রামের নিরন্তর কর্ষণের ভেতর দিয়ে উদ্যত মনুষ্যত্বে জেগে ওঠার ছোট্ট মূল কথাও কিন্তু ঐটুকুই : ‘আরো একটু ভালো’।
যদি জীবনে পুলিশের একজন দারোগাও হতে হয় ‘আরো একটু ভালো’ দারোগা হ’য়ো। যারা বাস্তব পৃথিবীর লোক তাঁরাই শুধু জানেন একটা খারাপ দারোগা একটা ছোট্ট জীবনে কত মানুষের কত কষ্ট আর দুর্ভোগের কারণ। উল্টোদিকে একজন ভালো দারোগার কাছে কত মানুষের কত সুখ, আশ্রয়, নিরাপত্তা।
প্রগতি বা প্রতিক্রিয়া এই দু’দলের কারো ব্যাপারেই কোন দায় নেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের। আমাদের লক্ষ্য একটাই : মানুষের গুণগত বিকাশ।
দেশের বুদ্ধিমান মেধাবী সৃজনশীল তারুণ্যকে বিকাশের একটা অবারিত আকাশ দেয় এই কেন্দ্র, আর বলে : যদি প্রগতিশীল হও তবে ‘আরো একটু ভালো’ প্রগতিশীল হ’য়ো, প্রতিক্রিয়াশীল হতে হলে ‘আরো একটু ভালো’ প্রতিক্রিয়াশীল।
এই পৃথিবী ‘আরো একটু ভালো’র কাছেই চিরকাল নিরাপদ, কোনো মতবাদ বা বিশ্বাসের কাছে নয়।
* এমন একটা অসুস্থ কালে ও পরিপার্শ্বে আমাদের দায়িত্ব একটাইÑসুস্থ থাকা। শুধু লক্ষ্য রাখা, আমরা যেন হতাশায় ভেঙে না পড়িÑযেন পাগল না হয়ে যাইÑআত্মহত্যা করে না বসি। চারপাশে সবাই ক্রমাগতভাবে কেবলি সুস্থতা হারাচ্ছে। সুস্থতা হারালে আমাদের বুদ্ধি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। আমাদের আক্রমণের ধার দুর্বল হয়ে পড়বে, আমরা হেরে যাব। এই নিñিদ্র কালবেলায় পরাজয়কে ঈশ্বর বানাবার বিলাসিতা কিছুতেই চলতে পারে না।
* আমি সংগঠনে বিশ্বাস করিÑবিশ্বাস করি দলেÑশক্তিমান সমমনা মানুষদের যূথবদ্ধ সহযোগিতায়।
আমাদের দলের সভ্যরা হবে সমমনের কিন্তু কিছুতেই সমমতের নয়। এখানেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য। ঐসব প্রতিষ্ঠানের মূলে আছে একটা বিশেষ বিশ্বাসের ভিত্তিÑসমস্ত মানুষ সেই বিশ্বাসের একক ধারাÑপ্রবাহে নতজানু। কিন্তু আমাদের শক্তিমান মতপার্থক্যই আমাদের শক্তি। আমরা কিছুতেই একে অন্যের প্রতিকৃতি নই। এই উজ্জ্বলিত আত্মবিশ্বাসই হাজার হাজার প্রদীপের মত আমাদের প্রত্যেককে শবেবরাতের রাতের বিপুল উৎসব সভায় আলোকিত করে রাখে।
চিন্তার জগতে দল গড়ে ওঠে, ভেঙেও যায়। হয়ত ভেঙে যাবার জন্যেই গড়ে ওঠে। এই ভাঙা-গড়া কেউ রোধ করতে পারবে না। আমরা কেউ কারো উঞ্ছ বৃত্তিতে আগ্রহী নই। তাই আমাদের দল ভেঙে যাবে।
দশটা বছর এমনকি পাঁচটা বছরÑনয়ত আরো অল্প সময়ের জন্যেই ভেসে থাকবে আমাদের এই ভালোবাসার সাম্পান। কিন্তু উদ্দীপনামদির এই কয়েকটা দিনের সময় পরিসরে সম্ভাবনার যে উচ্চতম শীর্ষকে আমরা পলকের জন্য ছুঁয়ে যাব, সেই অসম্ভবকে স্পর্শের পিপাসায় জীবনের পরবর্তী দিনগুলোকে আত্মবিস্মৃতের মত পার করে, একসময় নিঃশব্দে বিদায় নেব আমরা।
* বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য দেশের মানুষকে বুঝিয়ে উঠতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই হলাম। দৈনন্দিন জিনিশপত্তর বা বাসনÑকোশনের মত কোনো জিনিশকে হাতে ধরে দেখিয়ে না দিতে পারলে সাধারণ মানুষ তাকে বুঝতে পারে না। আমাদের কর্মসূচীগুলোর ভেতর দিয়ে সারাদেশে কিশোর তরুণদের ভেতর আজ ধীর নিঃশব্দে যে অমেয় চেতনার বিকাশ ঘটে চলেছে, আজ থেকে পঁচিশ, পঁয়ত্রিশ বা পঞ্চাশ বছর পর তাদের নানান কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে সেই চেতনার প্রকাশ ঘটে সম্পন্নতর একটা বাংলাদেশের সৃষ্টি হবে, কি করে একথা একজন সাধারণ মানুষকে বোঝান সম্ভব?
* বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নিজস্ব কোনো মতাদর্শ নেই। আমরা অনেক সময়ই রসিকতা করে এই কেন্দ্রকে বলি ‘পোস্ট অফিস’; বলি ‘ক্লিয়ারিং হাউস’। উন্নত, ব্যাপক ও পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন কার্যকর ও শক্তিমান মানুষ গড়ে-ওঠার এ নেহাতই একটা ‘সুযোগ কেন্দ্র’। কাউকে কোনো বিশেষ মতবাদে দীক্ষিত করে তোলার অশুভ মতলব বা দুরভিসন্ধি স্পষ্টতই নেই এই কেন্দ্রের। একজন সভ্যের অন্তর্প্রবণতাকে পরিপূর্ণ যোগ্যতায় বিকশিত হবার সুযোগ দেয়াই এই কেন্দ্রের লক্ষ্যÑতারপর যার-যার পথ তার নিজের।
এক ও অভিন্ন কোনো মতাদর্শে এই কেন্দ্রের সকল সভ্য বিশ্বাসী হচ্ছেÑএরকম অবস্থা এই কেন্দ্রের মৃত্যুরই নামান্তর। এই কেন্দ্রের প্রতিটি সভ্যের মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির শক্তিমান পার্থক্যের ওপরেই এই প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ শক্তি নির্ভরশীল।
আগেই বলেছি, এই কেন্দ্রের নিজস্ব কোনো মতাদর্শ নেই। তবু যদি এই কেন্দ্রের মতাদর্শ সম্বন্ধে কেউ জানতে চায় তবে বলব তা একটিই : চিত্তের সমৃদ্ধি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন