সাপ্তাহিকী
|
ডঃ কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির
|
|
সোজা খুঁটির বাঁকা ছায়া
08 Sep, 2013
মানুষ এবং পশু-পাখির মধ্যে প্রধান পাথক্য হচ্ছে- বিবেক। বিবেক আছে বলেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত। কথায় বলে- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিচারক হচ্ছে বিবেক। একশত ভাগ সুবিচারের গ্যারান্টি আছে সেখানে। সুবিচারের জন্য সেখানে লাগে না কোন সুউচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যারিস্টার, থাকে না কোন বাদী-বিবাদী, নেই কোন আপিল বিভাগ বা ফাঁসির আসামীর সাজা মওকুফ করার পদ্বতি। মানুষের তৈরি আইনের মারপ্যাঁচে নিরপরাধ কোন ব্যাক্তিকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া সম্ভব, কোন দাগী অপরাধীকে আইনের ফাঁক দিয়ে সুকৌশলে মুক্ত করাও অসম্ভব নয়। এধরনের বিচারে বিবেক সম্পন্ন সংশ্লিষ্ঠ বিচারক, উকিল বা ব্যারিস্টার তার নিজের বিবেকের কাছে ধরা পড়বে- এতে কোন সন্দেহ নেই। বলতে পারেন যদি বিবেক না থাকে! সেক্ষেত্রে তার অবস্থা কি হবে বা বিচারকার্য পরিচালনা করার অধিকার তার আছে কিনা সে বিচারের ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।
সন্দেহাতীতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একটি জাতির বিবেকদের মধ্যে অন্যতম। দেশের ক্রান্তিকালে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সত্যিকারভাবে প্রয়োজনীয় পথ দেখানো হচ্ছে তাদের কাজের অন্যতম। চিন্তাচেতনায় তারা থাকেন সব সময় অগ্রগামী। জাতীয় উন্নয়নে স্বপ্নের বাস্তবায়নে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাওয়া তাদের কাজ। বুদ্ধিজীবির সারিতেও তাদের অবস্থান সামনের কাতারে। আর এজন্যই একটি দেশের কাঙ্খিত উন্নয়নে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। রাজনীতিবিদগন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে সামাজিক সমস্যা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান পাওয়ার জন্য উন্মুখ থাকেন, তাদের উপর নির্ভর করেন নিশ্চিন্তায়। নোবেল-জয়ী সাড়া জাগানো আবিস্কারের পাশাপাশি নিরবে নিভৃতে প্রফেসরবৃন্দ জাতীয় উন্নয়নে ভুমিকা রাখেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি উন্নত দেশে ভ্রমন করে এবং এসব দেশের প্রফেসরদের সাথে কথা বলে বা তাদের সাথে চলাফেরা করে আমার অন্তত সেরকমই মনে হয়েছে।
কয়েকদিন আগের কথা৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ৮৫ ঘন্টা অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্ত হয়েছেন। বেশ চিন্তিত ছিলাম বিষয়টা নিয়ে কেননা দেশের বিবেক অবরুদ্ধ! যাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়েছিলেন তারাও সমগোত্রীয়- এ যেন বিবেক দ্বারা বিবেক অবরুদ্ধ। শরীরের কোথাও চুলকানি হলে সেখানে চুলকালে বেশ মজা লাগে। কিন্তু বেশী চুলকালে এক সময় ঐ স্থানে রক্ত বের হয় এবং তীব্র জ্বালা অনুভুত হয়। কাজেই বেশী চুলকানোর ইচ্ছে আমার নেই। যাহোক, সংকট নিরসনে শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে জাবির আন্দোলনরত শিক্ষকবৃন্দ ১৫ দিনের জন্য তাদের কর্মসূচী স্থগিত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দেশের অন্য একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের এমন অবস্থার জন্য খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক৷ এজন্য তার প্রতি সহমর্মিতা রইলো। আন্দোলনরত wশক্ষকবৃন্দও ধন্যবাদ পাবার যোগ্য কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকান্ডে পূর্বের গতি ফেরাতে আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থাকার কথা ক্লাসে, ব্যস্ত থাকার কথা গবেষণাগারে৷ শিক্ষা ও গবেষণা কাজ ফেলে আন্দোলনে নামা, শ্লোগান দেওয়া তাদের পক্ষে শোভনীয় নয়৷ এটা আমাদের জন্য এক লজ্জা৷ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল’র মত লজ্জা রাখার জায়গা পাওয়া দুস্কর। এব্যপারে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আত্বমর্যাদা সম্পর্কে অবশ্যই সম্যক অবগত। এত কিছু জানার পরও তারা কেন রাস্তায় থাকবেন, কেন তারা অন্য সব জরুরী কাজ ফেলে একজন উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখবেন। প্রশ্নটা সেখানেই। হিসাব মেলানো কঠিন। সহজ হিসাবে, একজন উপাচার্যের এ অবস্থার জন্য যতটুকু লজ্জা পাচ্ছি, আন্দোলনরত শিক্ষকবৃন্দের সংখ্যানুপাতে ততগুন বেশী লজ্জা পাচ্ছি। উপাচার্য মহোদয়ের জন্য খারাপ লাগার পাশাপাশি বারবার মনে হচ্ছে কেন শিক্ষকবৃন্দকে রাস্তায় নামতে হলো, কেন এমন ঘটনার অবতারণা করতে হলো। এর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারন হয়তো রয়েছে। তা নাহলে সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ এমন কঠিন পথে কেন গেলেন। যাইহোক, যৌক্তিকতার বিচার জাবির সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের উপর ছেড়ে দিলাম। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল’র মতে "স্বাধীন একটা দেশে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা ঘরে জোর করে আটকে রাখা যায় না"- এ বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। আমার জানামতে, বাংলাদেশে প্রচলিত আইন বা সংবিধান বা তার ব্যখ্যা একই কথা বলে। তবে ঘর বা কর্মস্থল থেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বের করে দেওয়াটা কি?- সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝিতে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শংকর চন্দ্র দত্তকে যখন মারধর করে ধাক্কা দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তখন অনেকে লজ্জা পেলেও অন্তত তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি। কুষ্টিয়ার পান্না মাস্টার কর্তৃক সহজ সরল শতাধিক মেয়েকে ধর্ষনের মত জঘন্য ঘটনার খবরেও লজ্জা ছিল অপ্রকাশিত। জাতি গঠনের কারিগর স্কুলের শিক্ষকবৃন্দের উপর ঢাকার বুকে বিষাক্ত মরিচ-স্প্রে দেওয়া হলেও লজ্জার অবস্থান অন্দরমহলেই ছিল। এরকম বহু ঘটনায় লজ্জার বহিঃপ্রকাশ না ঘটায় লজ্জিত হওয়ার অবকাশ থেকে যায় বৈকি। শিক্ষক সমাজের একজন হয়ে অন্য সবার মত আমিও দারুণভাবে লজ্জিত হই এসব ঘটনা প্রবাহে, হৃদয়ে হয় রক্তক্ষরণ। এরকম অনেক ঘটনা প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজে ঘটছে। অধ্যাপক শংকর চন্দ্র দত্ত তাড়া খেয়ে বাসায় ফিরলে নিশ্চয় তার সন্তানেরা জানতে চেয়েছিল- বাবা, কারা তোমাকে বের করে দিয়েছে? অধ্যক্ষ সাহেব নিশ্চয় গর্ব করে বলেছেন- কলেজের ছাত্র-কর্মচারীরা, তোমরাও বড় হয়ে তোমাদের অধ্যক্ষকে এভাবে বের করে দিও।
অধ্যাপক আলী আহসান’র একটি কথা না বললেই নয়, তা হলো- মানুষের আবেগ যদি বুদ্ধি ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত না হয় তবে তা পাগলামিতে পরিনত হয়।জাতির বিবেক, বড় বুদ্ধিজীবি, ক্রান্তিকালের কান্ডারী, সবচেয়ে বড় মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে যথাস্থানে লজ্জিত হতে হবে, প্রয়োজনে উৎসাহিত হতে হবে, সাথে সাথে অবশ্যই হতে হবে সুউচ্চ বিবেকসম্পন্ন নিরপেক্ষ বিচারক। একপেশে চিন্তাচেতনা আর কর্মকাকান্ডের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কিছুটা লাভবান হলেও সার্বিকভাবে তার ছায়া বাঁকা হয়ে পড়বে জাতির উপর- এটা অবশ্যম্ভাবী। বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আংশিক বিবেকসম্পন্ন হয়ে অতি উৎসাহ দেখালে লজ্জিত হওয়া ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকে না। আমাদের চিন্তাচেতনা, চলাফেরা বা দিকনির্দেশনা যদি বিবেক দ্বারা পরিচালিত না হয় তাহলে সে লজ্জা বেড়ে যায় বহুগুন।
ডঃ কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির
সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
বর্তমানে, গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভাসিটি, সাউথ কোরিয়া।
পাঠক মন্তব্য
Your story was really inoifmatrve, thanks!
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন