সাপ্তাহিকী
|
সম্পাদক
|
|
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত যখন বধ্যভূমি
08 Sep, 2013
কুড়িগ্রাম সীমান্তে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানি খাতুন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যকে খালাস দিয়েছে ওই বাহিনীর নিজস্ব একটি আদালত। সেনাবাহিনীর কোর্ট মার্শালের মতোই বিএসএফের নিজস্ব আদালতে কঠোর গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার মধ্যে ওই বিচার কাজ চলে। বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পরই অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। ২০১১-তে ঘটে যাওয়া ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর বাংলাদেশ, ভারত এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছিল। পরে অবশ্য ২০১৩’র আগস্টে ভারতের কুচবিহার জেলায় বিএসএফ ছাউনিতে ওই বাহিনীর আদালতে ফেলানি হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। এই বিচারকার্যে ফেলানির বাবা ও মামার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। বিএসএফের নিজস্ব আদালতে ওই বিচার শেষে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে রায়ে বলা হয়েছে। এ রায়ের পরে ফেলানির বাবা, যিনি এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষী, হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ রায়ের পরে একটিই মাত্র প্রশ্ন - তাহলে র্কাঁটাতারের উপরে পঞ্চদশী ফেলানিকে হত্যা করলো কে? এই প্রশ্নের কোনো মীমাংসা পাওয়া গেল না। ফেলানি নিহত হওয়ার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এমনই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, যে কারণে মার্কিন প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি ২০১১’র জুলাই-আগস্ট সংখ্যায় এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। স্কট কার্নি, জ্যাসন মিকলেইন ও ক্রিসটেইন হোলসারের সেই প্রতিবেদনটির বাংলা ভাষান্তর প্রকাশ করা হলো।। - সম্পাদক)
গুটিশুটি হয়ে পোড়ো - একটি দালানের ভেতর ঢুকে পড়েই ফেলানি তার সোনার তৈরি বিয়ের গয়নাগুলো পরে নিল। পঞ্চদশী ফেলানির বাবা নূরুল ইসলাম জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করলেন কাঁটাতারের বেড়াটা কতো দূরে এবং এর অবস্থাটা কেমন। এই বেড়াটিই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত-রেখা চিহ্নিত করে রেখেছে। আর এটিই ফেলানির বউ সাজার পথে সর্বশেষ বাধা।
এক সপ্তাহ পরই সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত নিজের পৈতৃক গ্রামটিতে ফেলানির বিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকার কথা তাদের মাথায়ই আসেনি। কারণ দিল্লি থেকে ভিসা ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করতেই কয়েক বছর লেগে যাওয়ার কথা। তাছাড়া বাংলাদেশের যে গ্রামটিতে নূরুল ইসলাম বড় হয়েছেন সীমান্তবর্তী ভারতীয় বাসস্ট্যান্ড থেকে সেটির দূরত্ব মাইল খানেকেরও কম। তথাপি তারা জানত, কাজটি খুবই বিপজ্জনক। এটি সর্বজনবিদিত যে, সীমান্তে প্রহরারত ভারতীয় রক্ষীরা কাউকে সীমান্ত অতিক্রম করতে দেখলে গুলিটি আগে চালায় এবং প্রশ্নটি পরে করে। ইসলাম একজন দালালের মাধ্যমে সীমান্তরক্ষীকে ৬৫ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ টাকা ঘুষ পাঠিয়েছেন। তবে তার জানার কোনো সুযোগই ছিল না টাকাটা ঠিক হাতেই পড়েছে কিনা। বাবা আর মেয়ে প্রহরীদের পেছন ফেরার অপেক্ষায় রইল। তারা পেছন ফিরলেই একটি মই বেয়ে উঠে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ওপারে পৌঁছে যাবে। দালালটি তাদের কয়েক ঘন্টা বসিয়ে রাখল নিরাপদ সুযোগের অপেক্ষায়। কিন্তু ততক্ষণে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে সকালের ঘন কুয়াশা ভেদ করে। সুতরাং পার হওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বাধা সরিয়ে নূরুল ইসলামই প্রথম সীমান্ত পার হয়ে গেলেন। কিন্তু ফেলানি যে দুর্ভাগা। তার সালোয়ার কামিজের পাড় কাঁটাতারে আটকে গেল। সে ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে এক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী দৌঁড়ে এসে খুব কাছ থেকে একটিমাত্র গুলি ছুড়ল ফেলানিকে লক্ষ্য করে। ঘটনাস্থলেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ফেলানি। মেয়ের মৃতদেহটি কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলন্ত অবস্থায় রেখেই বাবা পালিয়ে গেলেন। সীমান্তরক্ষীরা নামিয়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত মৃতদেহটি আরো অন্তত ঘন্টা পাঁচেক সময় ওই একইভাবে কাঁটাতারের মধ্যেই ঝুলে ছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা মৃতদেহটি পরের দিন সীমান্তের অপর পাড়ে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে। জানুয়ারিতে ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর নূরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ স্বরে আমাদের জানান, মৃতদেহটি তাদের কাছে ফেরত দেয়ার আগে সৈন্যরা তার শরীর থেকে সোনার গয়নাগুলোও চুরি করে নিয়েছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের সীমান্ত বিষয়ক জটিলতা সংবাদ শিরোনাম হয়ে থাকে। অথচ এক দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার এক হাজার ৭৯০ মাইল দীর্ঘ সীমান্তটির বেশির ভাগ অংশেই বেড়া নির্মাণ করা হয়ে গেছে এবং এটি বিশ্বের অন্যতম রক্তঝরা সীমান্তঞ্চলে পরিণত হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা ফেলানির মতোই প্রায় এক হাজার মানুষকে এখানে গুলি করে হত্যা করেছে। ভারত তার ২৫ বছর মেয়াদি সীমান্তবেড়া নির্মাণের কাজটি আগামী বছরের মধ্যেই শেষ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে খরচ পড়বে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার। এই বেড়া নির্মাণকে ভারতীয়রা নিজেদের জন্য একটি সর্বরোগ হরণকারী প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচনা করছে। তারা মনে করছে, এই বেড়া নির্মাণের ফলে মুসলিম জঙ্গিবাদ ও কাজের সন্ধানে বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশকারী বিদেশীদের আটকানো সহজ হবে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে যে শরণার্থী সঙ্কট বিরাজমান তার হাত থেকেও ভারত রেহাই পেয়ে যাবে এই সীমান্তবেড়ার কল্যাণে। কিন্তু বাংলাদেশীদের কাছে এই সীমান্তবেড়াটি তাদের এক নিকট প্রতিবেশীর অযৌক্তিক ভীতির চিহ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের কাছে মনে হচ্ছে, তাদের প্রতিবেশীটি তার নব-আবিষ্কৃত সম্পদরাজির নিরাপত্তা বিধানে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদিও দেশটির বিপুল জনগোষ্ঠী এখনো চরম দারিদ্র্যের মধ্যেই বসবাস করছে। এই সীমান্তবেড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে অভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক একদা বন্ধুপ্রতীম দেশ দুটির সম্পর্ক আজ কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে একটি প্রতিবেশীকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য অন্য প্রতিবেশীটি কী পরিমাণ রক্ত ঝরাতে বদ্ধপরিকর।
ভারত তার এই পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীটির প্রতি যে সব সময়ই এতটা বিরূপ ছিল তা কিন্তু নয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত যে যুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল সেই যুদ্ধে তারা কিন্তু ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্রই ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধ বাংলাদেশের দুর্বল অবকাঠামোকে ধ্বংসই করে দিয়েছিল এবং দশ লাখেরও বেশি মানুষ সে সময় নিহত হয়। ফলে দেশটিকে অনিবার্য এক দুর্ভাগ্যই বরণ করে নিতে হয়েছিল। বাংলাদেশ এখন ১৬ কোটি মানুষের একটি দেশ - যা আয়তনে আইওয়ার চেয়েও ছোট। জনসংখ্যার অর্ধেকেরই দৈনিক মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ১.২৫ মার্কিন ডলারেরও কম। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসূচকের বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই নিচের দিকে।
দুর্যোগ দুর্বিপাক দেশটির নিত্যদিনের সঙ্গী। একটি ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত দেশটির ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ৫৪টি নদী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সব ধরনের নেতিবাচক প্রভাবেরই শিকার সে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে বলে যে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের নদীগুলোতে ধীরে ধীরে সমুদ্রের লোনাজল প্রবেশ করছে। উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করছে। আর হিমালয় থেকে নেমে আসছে গলিত হিমবাহ। সব কিছু মিলে ইতোমধ্যেই দেশটির অধিকাংশ উর্বর কৃষি জমিকে লবণাক্ত মরুভূমিতে পরিণত করেছে। ফলে এর সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ আরো অন্তত ডজনখানেক নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, হ্যারিকেন ক্যাটরিনার মতো ঝড় যদি বাংলাদেশে আঘাত হানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, যার আশঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলেছে, তবে তার ফলাফল হবে ভয়াবহ। এতে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের হুমকি রয়েছে। আর অস্থিতিশীলতার এই ঢেউ বৈশ্বিকভাবেই অন্যত্র গিয়ে আঘাত হানবে। দেশটিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নতুন জাল বিস্তৃত হবে। খাদ্য ও পানির প্রাপ্যতা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেবে এবং অবশ্যই লাখ লাখ শরণার্থীর সৃষ্টি হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তেমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বাস্তুচ্যুত এই মানুষ প্রথমেই কোথায় যেতে চাইবে। বাংলাদেশের সঙ্গে মাত্র দুটি দেশের সীমান্ত রয়েছে। এর একটি হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত এবং অন্যটি সামরিক একনায়কত্বের শাসনাধীন বার্মা। আপনিই বলুন, কোন দেশটি আপনি বেছে নেবেন?
শরণার্থী গ্রহণ করার একটি ইতিহাস ভারতের আছে। সে তিব্বতের প্রবাসী সরকার থেকে শুরু করে শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী পর্যন্ত সবাইকে আশ্রয় দিয়েছে। পূর্ব দিক থেকে গণহারে অভিবাসীর আগমন আশঙ্কা করে নয়াদিল্লি তাই একটি বালির বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যয়বহুল এবং স্থায়ী একটি পুনর্বাসন অঞ্চল নির্মাণ না করে সে বরং সশস্ত্র রক্ষী সম্বলিত একটি সীমান্তবেড়া নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে। এটি শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার এই কর্মসূচিকে আরো বেশি বেগবান করে। উদ্দেশ্য, দলীয় কর্মীদের মধ্যকার মুসলিম বিদ্বেষ প্রশমিত করা। বেড়ার দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকল এবং সেই সঙ্গে বেড়ে চলল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বছরের পর বছর ধরে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে আসছেন। অবশেষে ভারতীয় পক্ষও দফায় দফায় ওয়াদা করে, সীমান্তরক্ষীরা অবৈধ পারাপারকারীদের ওপর জীবনহানিকর মারাত্মক কোনো অস্ত্র ব্যবহার করবে না। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাস্তবে এর কোনো প্রমাণ তারা রাখেনি। আগামী বছরের মধ্যেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সব সীমান্তপথ বেড়া দিয়ে আটকে দেয়া হবে। তবে একথাও ঠিক, নিরাপত্তার কড়াকড়ি দিয়ে সীমান্ত অঞ্চলকে বিপদসংকুল করে তোলা গেলেও তাকে কিন্তু প্রকৃত অর্থে নিরাপদ করা যাবে না।
একশ’রও বেশি সীমান্তবর্তী গ্রাম অবৈধ ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যদিয়ে দৈনিক কয়েক হাজার অবৈধ অভিবাসী আসা-যাওয়া করছে। এসব গ্রামের প্রতিটির রয়েছে একজন করে লাইনম্যান। উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে সক্রিয় কয়কোয়েট বা ক্ষুদ্র কুকুরদের সঙ্গে এদের কর্মকাণ্ডের মিল রয়েছে। এরা চোরাচালানিদের সঙ্গে জড়িত থাকে। সীমান্তরক্ষীদের ঘুষ দিয়ে অন্যমনস্ক করানোর ছলে অবৈধ অভিবাসীদের পারাপারে সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন ‘মাসুম’-এর প্রধান কিরিটি রায় বলেন, সঠিক জায়গায় ঘুষ দিতে পারলে পুরো গ্রামটিই এপার থেকে ওপারে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব। সংগঠনটি বাংলাদেশের ‘অধিকার’ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে যৌথভাবে গত ডিসেম্বরে সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রায় বলেন, সাধারণ লাইনম্যানের সঙ্গে একটি বোঝাপড়া না করে কেউই সীমান্ত পার হওয়ার ঝুঁকি নেয় না। কেউ যদি লাইনম্যানদের ফাঁকি দিয়ে নিজে নিজেই সীমান্ত পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তবে লাইনম্যানরা সেটি সীমান্তরক্ষীদের নজরে নিয়ে আসে এবং গুলি চালাতে বলে। অদক্ষ একটি ঘুষ প্রদান পদ্ধতি চালু থাকার কারণে এক দশকে প্রায় এক হাজার নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে বলে কিরিটি রায় মন্তব্য করেন।
সীমান্তবেড়ার পশ্চিমপাড়ে অভিবাসনকে কেন্দ্র করে একটি কুৎসিত রাজনীতি চালু রয়েছে। সেখানকার জনমত বাংলাদেশ সীমান্ত দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। ফলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। নয়াদিল্লিভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড এনালাইসিসের হিসাব মতে, ভারতে বর্তমানে এক থেকে দুই কোটি অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী অবস্থান করছে (যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ১২ লাখ)। মুসলিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এমনিতেই খুব একটা ভালো নেই। উপরন্ত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র ইসলামী মৌলবাদের যেভাবে উত্থান ঘটছে তাতে সেই সম্পর্কে আরো ভঙ্গুরতা দেখা দিয়েছে। ভারতের রাজনীতিকরা এই অবস্থাটির সুযোগ নেয়ার জন্য বসে আছেন। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ২০০৯ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশীদের ভারতে আসার কোনো দরকার নেই। বিজেপিও মনে করে, বাংলাদেশের সাদর আমন্ত্রণ জানানোর কোনো কারণ নেই। বিজেপির বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নেতা তথাগত রায় তো ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে জনবিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখারই আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশী অভিবাসীদের ভারতে প্রবেশের আশঙ্কা যদি শেষ পর্যন্ত বাস্তবেই রূপ নেয় তবে ভারতের ৯০ কোটি হিন্দুর ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়া কিংবা সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তরই থাকবে না বলে রায় মনে করেন।
সীমান্ত অঞ্চল ক্রমেই একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বরাবরই দাবি করে আসছেন, সীমান্তরক্ষীরা নেহাৎই আত্মরক্ষার প্রয়োজনে গুলি করে থাকে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন ‘মাসুম’ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, নিহতদের মধ্যে এমন একজনেরও পরিচয় পাওয়া যায়নি যার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল। কারো হাতে বড়জোর একটি লাঠি কিংবা কাস্তে ছিল। মানবাধিকার সংগঠন দুটি বিএসএফের বিরুদ্ধে নির্বিচারে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর অভিযোগ এনেছে। নিহতদের অধিকাংশই ছিল কৃষক। এরা বেঠিক সময় বেঠিক স্থানে পড়ে ঘটনার শিকার হয়েছে। জানুয়ারিতে বাংলাদেশী সৈন্যরা আমাদের জানায়, ছয়জন ভারতীয় সীমান্তরক্ষীকে তারা শাহজাহান আলী নামের এক বাংলাদেশীকে সীমান্তবর্তী নোম্যান্সল্যান্ড এলাকায় প্রলুব্ধ করার ভঙ্গিতে ডেকে নিয়ে যেতে দেখেন। এরপর তারা লোকটিতে উলঙ্গ করে প্রহার করতে থাকে। তারা তার পা দুটি ভেঙে ফেলে। আর আহত অবস্থায় বাংলাদেশ সীমান্তে ছুড়ে ফেলে দেয়ার আগে তারা তার পুরুষাঙ্গটি ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। লোকটি পরে রক্তক্ষরণের ফলে মারা যায়। শাহজাহান আলির ঘটনা প্রত্যক্ষকারী বাংলাদেশী একজন সৈনিক বলেন, ভারতীয় রক্ষীদের উন্মত্ততা দেখে মনে হয়েছে তারা মাতাল অবস্থায় ছিল। মনে হয়েছে তারা যেন নেশাগ্রস্ত ছিল। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক কোনো ইস্যুতে পরিণত না হওয়ায় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা এসব ঘটনায় তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের রক্ষীদের বিরুদ্ধে বন্দুক চালাতে পারে না। তারা কেবল নীরবে স্বদেশীদের মৃতদেহগুলো তুলে নিয়ে আসে।
তবে ফেলানির মৃত্যু বাংলাদেশে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। কাঁটাতারে ঝুলে থাকা তার মৃতদেহের ছবি দেশের সব সংবাদপত্রই প্রথম পৃষ্ঠায় ছেপেছে। রাজধানী ঢাকায় বহু দেয়ালেই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ফেলানির ছবিসমেত ‘সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা হোক’ লেখা পোস্টার সেঁটে রাখতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের একজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমানে বিরোধী দল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, সীমান্তের বেড়াটি হচ্ছে আমাদের বার্লিন দেয়াল। এই হত্যাকাণ্ডটি ভারতকেও কিছুটা সচেতন করে তুলেছে বলে মনে হয়েছে। মার্চে নয়াদিল্লি আবারও ঘোষণা দেয়, সীমান্তরক্ষীরা মানুষ হত্যাকারী অস্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে এবং এই ঘোষণা একবারের জন্য হলেও কার্যকর হয়েছিল। এক দশকের মধ্যে এই প্রথম কোনো একটি মাস অতিক্রান্ত হলো যে সময়ের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যরা সীমান্তে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি।
কিন্তু এপ্রিলে এসেই আবার ভারতীয় সৈন্যরা তাদের অস্ত্র তাক করল এবং একজন গরু ব্যবসায়ীকে হত্যা করল। এছাড়া অন্য তিনটি ঘটনায় আরো তিনজনকে তারা হত্যা করেছে। মনে রাখা দরকার, তারের বেড়ার কার্যকারিতা যখন দুর্বল হতে থাকবে সীমান্ত অঞ্চলকে বধ্যভূমিতে পরিণত করার উত্তেজনাও তখন বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে।।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন