সাপ্তাহিকী
|
এস এম মুকুল
|
|
প্রকৃতি থেকে দূরে থাকার পরিণতি ভয়ঙ্কর
08 Sep, 2013
আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। মানবজাতি বিলুপ্ত হওার জন্য দায়ী থাকবেন কিন্তু মানুষই। তার মানে কী? তার মানে আমরাই আমাদের ধ্বংস ডেকে আনছি! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি কথা। বেলজিয়ামে প্রকাশিত পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের খসড়া প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বাড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিবছর আরো বেশি মানুষ বন্যা এবং খরার মুখোমুখি হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে খাদ্যাভাব। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক প্রজাতি। বিষয়টি উদ্বেগজনক শুধু বৈজ্ঞানিক ও আবহাওয়াবিদদের জন্য নয়, রাজনীতিবিদ, সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের জন্যও বটে। কারণ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বিপুল হারে বাড়ছে। এর ফলে পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষের যে ভয়াবহ ক্ষতি হবে তা পূরণ করতে লাগবে আরো শত শত বছর। বেলজিয়ামের প্রতিবেদনে বলা হয় প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেন এগিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। এমন অবস্থায় বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, পুরো মানবজাতি যদি ধ্বংস নাও হয় তবে শত শত কোটি মানুষের মৃত্যু ঠেকানোর উপায় নেই। বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা যদি আর ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি ফা. হা. বাড়ে, তবে সারাবিশ্বে ৪০-১৭০ কোটি মানুষ পরিবেশের বৈরী অবস্থায় পড়বে। প্রতিবেদনে এমন পরিস্থিতি ২০২০ সাল নাগাদ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন বলেছে, তাপমাত্রা যদি আরো ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি বাড়ে, তাহলে ২০০ কোটি মানুষ খরার শিকার হবে। ২০-৩০ শতাংশ প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে পারে। অগণিত মানুষ বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, তাপপ্রবাহ, অপুষ্টিসহ নানান রোগে মারা যাবে। গড় তাপমাত্রা ৭ থেকে ৯ ডিগ্রি বাড়লে পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং বিশ্বের পরিবেশ পরিস্থিতি ভয়াবহ। আর এর জন্য আমরা- মানুষই দায়ী।
জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। গবেষকরা মনে করেন, আসল কাজ হচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমানো বা শিল্পায়নের আগের তাপমাত্রায় (অর্থাৎ দুই সেলসিয়াসের বেশি নয়) নিয়ে আসা। যুক্তরাজ্যের গবেষণাকেন্দ্র টিনডাল সেন্টারের পরিচালক জন শেলন হাবারের মতে, 'আমরা যদি দুই ডিগ্রির বেশিতে চলে যাই তাহলে তা হবে নরকে বসবাস।' আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে, জলবায়ু হচ্ছে রদবদল। এর কারণ ঘুমন্ত দৈত্যরা জেগে উঠছে। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় এন্টার্কটিক এলাকার বরফ ধসে যাচ্ছে। পূর্ব এন্টার্কটিকের বরফ ভূমির ওপর এবং পশ্চিম এন্টার্কটিকের বরফ গলে সাগরে চলে যাচ্ছে। ১৯৭৮ সালেই ওহিও স্ট্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন মাশরি এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এভাবে চললে বিশ্বের সমুদ্র স্তর পাঁচ মিটার উঁচু হবে। দেখা যাচ্ছে যত না দ্রুত বরফ জমছে তার থেকে দ্রুত বরফ সমুদ্রে পড়ছে। পাইন দ্বীপের উপসাগরে পশ্চিম এন্টার্কটিকের বরফ পড়ছে এবং ২০০ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বরফ গলে যাবে এভাবে। এ মহাদেশের পাইন দ্বীপ বছরে ২৫০ কিউবিক ফুট ক্ষয়ে যাচ্ছে। বাতাসে আমরা যে ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি ফেলি তার এক-চতুর্থাংশ কার্বন ডাইঅক্সাইড ভূমি ও বন শুষে নেয়। ভূমির এ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের পরিমাণ বাড়ার কারণ রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে গাছপালা দ্রুত বাড়ছে; তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ভূমিতে গাছ, পাতা, শিকড় ইত্যাদি জৈবিক উপাদানের পচন হচ্ছে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হওয়ার হারও দ্রুতভাবে বাড়ছে। আর এ জন্য ভূমির কার্বন কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এ কথাটি এখন শুধু পাঠ্য বইতেই খাটে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। চিরচেনা বাংলাদেশের এ ছয়টি রূপই বাংলাদেশকে দিয়েছিল রূপসী বাংলার খেতাব। সময়ের বিবর্তনে এসে সবকিছুই পাল্টে যাচ্ছে। এখন আর ঋতুভিত্তিক বাংলাদেশকে চেনা যায় না। বর্ষায় বৃষ্টি নেই, ঝড়ের সময় ঝড় নেই। শীতকালে শীত নেই। বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের আবহাওয়ার প্রকৃতি। এখন আর ছয় ঋতুর কোনো ঋতুকেই আলাদা করে চেনা যায় না। এক ঋতুতে আরেক ঋতুর বৈশিষ্ট্য দেখা দিচ্ছে। দেশে গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। কমে গেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। দেশের আবহাওয়া পরিবর্তনের একটা চিত্র দেখা যাচ্ছে। তবে এ পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে। কৃষকরা মনে করেন, এখন আর খনার বচন খাটে না। কারণ বছরের ছয়টা মৌসুম আর আগের মতো নেই। গত ২৫ বছরের তাপমাত্রার চিত্র থেকে দেখা যায়, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বছরওয়ারি তাপমাত্রার গড় ছিল ২৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু গত ১০ বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে। দেশে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমছে। পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে বর্ষা না হয়ে অসময়ে হচ্ছে। বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯৮৩ সালে ২ হাজার ৮৪০ মিলিমিটার, ১৯৮৪ সালে ২ হাজার ৮৩৬ মিমি, ১৯৮৮ সালে ২ হাজার ৮০৩ মিমি, ১৯৯১ সালে ২ হাজার ৭৬৭ মিমি এবং ১৯৯৮ সালে ২ হাজার ৭৭৭ মিমি এবং ১৯৯৯ সালে ২ হাজার ৬৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২ হাজার ৪৭১ মিলিমিটার।
আবহাওয়াবিদদের মতে, দেশের খরাপ্রবণ পশ্চিম অঞ্চলে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় খরার তীব্রতা ও সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। দেশের দক্ষিণ ও মধ্য-দক্ষিণ অঞ্চল খরাপ্রবণ হয়ে উঠবে। জলবায়ুর যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তা খুব বেশি পরিবর্তন নয়। তবে কোনো বছরে দেখা যায় বৃষ্টিপাত বেশি, আবার পরের বছর কম। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পাহাড় কাটার ফলে সেখানকার মেঘগুলো দেশের উত্তরাঞ্চলে সরে গিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে এবং একই সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রচুর বনায়নের ফলে সেখানে বৃষ্টিপাত কিছুটা বাড়ছে। আবহাওয়ার এ পরিবর্তন আর এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কিন্তু আমরা নিজেরাই। আমাদের নদীগুলো মরে গেছে। নদী আর খাল খনন হচ্ছে না। বনের গাছ কেটে আমরা সাবাড় করে ফেলছি। গাছ কাটার আগে গাছ লাগাচ্ছি না। গড়ে উঠছে না সবুজ বনায়ন। বন না থাকায় আমাদের পশুপাখিরাও বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করে আমরা জমির প্রাকৃতিক উর্বরা শক্তি নষ্ট করে ফেলেছি। মাটির বিষ পানিতে মিশে আমাদের মাছের প্রজাতি নষ্ট করে দিয়েছে। কল-কারখানা, যানবাহন ও ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, শব্দ দূষণ, ট্যানারির বর্জ্য, নগরীর সাধারণ ও শিল্প বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে বিষিয়ে তুলেছে পরিবেশকে। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে পরিবেশ। তাই সামনে ভয়ানক বিপদ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে। গাছ লাগিয়ে সবুজ বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে। জনগণ কেউ সচেতন হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। না হলে এর ভয়াল পরিণতির শিকার হবো আমরাই। আসুন সচেতনই। সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলি। বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য রক্ষা করি।
জি-সেভেনের বৈঠকে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন ধনী দেশগুলোর নেতারা। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের চুক্তিতে যারা স্বাক্ষর দিয়েছিল তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও ছিল। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল আবহাওয়ার এ বিপজ্জনক পরিবর্তন রোধে পদক্ষেপ নেবে। বিশেষজ্ঞরা এ 'বিপজ্জনক' এর প্রধান তিনটি বিপদকে চিহ্নিত করেছেন। একটি হচ্ছে বৃদ্ধিজনিত পরিবর্তন। এটা হচ্ছে সাধারণ পরিবর্তন, যা মানুষ গ্রহণ করতে পারে। পূর্ব থেকে সতর্ক করে দিলে বা মানুষ অন্যত্র চলে গেলে এ আবহাওয়া পরিবর্তন তেমন ক্ষতিসাধন করতে পারে না। দ্বিতীয় বিপদ হচ্ছে প্রভাব বা পরিণতি। এর ফলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয় মানুষকে। যেমন_ ২০০২ সালে ইউরোপের হিট ওয়েভ, যার ফলে ত্রিশ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে।
মহাসমুদ্রের কনভেয়োর বেল্ট বিরাট পরিমাণ তাপ ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। এর প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে গালফ স্ট্রিম, যা কিনা পশ্চিম ইউরোপকে উষ্ণ রাখতে সক্ষম হচ্ছে। উত্তর আটলান্টিকের বরফ এ কনভেয়োরকে ঠেলে নিয়ে যায়, ফেলে যায় ঘন লবণাক্ত পানি, যা গিয়ে জমা হয় মহাসমুদ্রের পাদদেশে। যদি মহাসমুদ্র উষ্ণ হয়ে যায়; এমন উষ্ণ যে বরফ জমাতে পারছে না, তাহলে এ প্রক্রিয়া থেমে যাবে। এ প্রক্রিয়া থেমে যাওয়ার আরেকটি কারণ যদি ব্যাপক পরিমাণ মিষ্টি পানিতে এ লবণাক্ত পানি মিশে যায়। এসব প্রক্রিয়ার ফলে দেখা যাচ্ছে উত্তর আটলান্টিকের লবণাক্ততা কমে যাচ্ছে। ফলে অনুমান করা হচ্ছে ভবিষ্যতে ইউরোপ আরো দ্রুত ঠা-া হয়ে পড়বে। দুই কিলোমিটার ঘনত্বের গ্রিনল্যান্ডের রবফচূড়া গলে যাচ্ছে, এর ফলে সমুদ্র তলদেশ সাত মিটার উঁচু হয়ে পড়েছে। তুষারপাতের জন্যও বরফ জমে। দেখা যাচ্ছে বরফ যত না দ্রুত জমছে তার চেয়ে বেশি দ্রুত গলছে। গ্রিনল্যান্ডের পুরো বরফ গলতে এক হাজার থেকে তিন হাজার বছর লাগবে। তবে বিশ্বের তাপমাত্রা কমলেও এ বরফগলা থামবে না। মানবজাতির বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য যে কার্বন ডাইঅক্সাইড ছাড়ে তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মহাসাগর শুষে নেয় এবং কার্বনিক এসিড তৈরি করে। কার্বন ডাইঅক্সাইড বেশি ছাড়ার ফলে মহাসাগরের পিএইচ স্তর কমে যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৮৫ সাল নাগাদ পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ প্রবাল হারিয়ে যাবে। এশিয়ার মনসুন বা বর্ষাকাল, যার ওপর পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ নির্ভরশীল তা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বর্ষার তীব্রতা বেশি হতে পারে, অন্যদিকে মহাসমুদ্রের কনভেয়োরের বিলুপ্তির জন্য বর্ষা হ্রাস পেতে পারে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাবে। অবশ্য বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এখনো তীব্রভাবে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব। বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা, মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পারবে। এত বেশি পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ দূষিত গ্যাস পৃথিবীর বাতাসে ছড়াবে না। সমুদ্রতত্ত্ববিদ জেমস ম্যাককারথি বলেছেন, এরকম ভয়ঙ্কর খারাপ পরিস্থিতি নিশ্চয়ই তৈরি হবে না। কারণ আমরা কখনো এত বোকা হতে পারি না। আমরা নিশ্চয়ই এরকম বোকামি করব না। নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষ অবশ্যই সচেতন হবে।
এস এম মুকুল: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন