সাপ্তাহিকী
|
সাইফ বরকতুল্লাহ
|
|
বাংলাদেশে মিডিয়ার রাজনীতি ( পর্ব-০৬ )
02 Sep, 2013
ঘ) সাম্প্রতিক সময়ে প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইলেকট্রনিক ও সামাজিক মাধ্যমগুলো। তবে স্বাধীন মিডিয়ায় এখন মূল অন্তরায় দাঁড়াচ্ছে কর্পোরেট হাউজগুলো। ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরাই এখন অধিকাংশ মিডিয়ার মালিক। পত্র-পত্রিকা তথা মিডিয়াগুলো এখন ভিশন-মিশন ছাপিয়ে সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে মালিকদের ইশারায়। মিডিয়া এখন অর্থ উপার্জন এবং রাতারাতি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার একটি সহজ সিঁড়ি। অর্থ লাভের পাশাপাশি আবার কখনও বা বিশ্বাস মিডিয়াকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে গণপ্রত্যাশা থেকে অনেক দূরে।
ঙ) সম্প্রতি গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় আমরা দেখেছি বিভিন্ন মিডিয়ায় বিভিন্ন রকম কৌশল। এটাও মিডিয়ার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেরই খেলা বলা যায়। সম্প্রতি চ্যানেল টোয়েন্টিফোর এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক হাসান মাহমুদুল ‘গাজীপুরের সিটি নির্বাচনের ফল প্রচারে কেওয়াস ও ভিন্ন ভাবনা”- এই শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি লিখেন, শূন্য বড় রহস্যময়; নিজের মূল্য নেই কিন্তু ডানে বসলেই দশ গুণোত্তর ধারায় বাড়িয়ে দেয় পূর্ববর্তী সংখ্যার মান। এই শূন্যর এক অদ্ভুত ও রহস্যময় সমাবেশ দেখা গেল গাজীপুর সিটি নির্বাচনের তথাকথিত ব্রেকিং ফলাফলে। একাত্তর, ইন্ডিপেনডেন্ট, দেশ- এই তিনটি টিভি চ্যানেল যখন ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নান ও আওয়ামী সমর্থিত আজমত উল্লা খানের চূড়ান্ত ভোটের ফিগার স্ক্রিনে ছাড়ল ৪,৬৮,০০০ ও ৩,১২,০০০; তখন দর্শকের সামনে ছয় ছয়টা শূন্য। কারো মনে হলো না, আরে দশ লাখ ভোটারের মধ্যে যেখানে নির্বাচন কমিশন বলছে ৫৮ শতাংশ টার্নওভার সেখানে দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের যোগ ফল দাঁড়ায় ৭ লাখ ৯০ হাজারের মতো। তাহলে তো টার্নওভার হওয়ার কথা প্রায় ৭৯ শতাংশ। এই যে তথ্য বিভ্রাট এর সূত্রপাত ফল প্রকাশের একেবারে প্রথম পর্যায় থেকে। বিষয়টি নিয়ে অনলাইনে প্রথম লিখেছেন সময়ের বার্তা প্রধান তুষার আবদুল্লাহ। ‘ভোটের ফলাফল প্রচারে ইঁদুরদৌড়’ শিরোনামের অই কলামে তিনি স্বীকার করেছেন, তার টেলিভিশন স্টেশনও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে। এই বিভ্রান্তি কেমন মাত্রায় ছিল তার একটা নমুনা দিই। এখানে রাত ১১টা ১১ মিনিটে ২০৩টা কেন্দ্রের ফল দেয়া হয়েছে এমন- এমএ মান্নান: ২,৩০,১২৭ এবং আজমত উল্লা: ১,৮৫,৩৯৪। কিন্তু রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে সময় প্রচার করেছে ২৭৯টি কেন্দ্রের। তখন মান্নান: ২,০৩,১২৭ এবং আজমত উল্লা: ১,২৫,৩৯৪ ভোট। অবশ্য এই বিভ্রান্তি তৈরির জন্য তুষার আবদুল্লাহ ক্ষমা চেয়েছেন। সেই সঙ্গে তার ক্ষুব্ধ জিজ্ঞাসা: একাত্তর, ইন্ডিপেন্ডেন্টসহ আরো কিছু গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। এই গণমাধ্যমগুলো রাত একটার আগেই তথাকথিত ব্রেকিং চালালো কেন? যা হোক পুরো আষাঢ় মাসে অনুষ্ঠিত গাজীপুর নির্বাচনের ফল জানাতে কতিপয় চ্যানেলের আষাঢ়ে গল্প ফাঁদার মতো বিষয়টা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু জনৈকের মন্তব্য কোড করে তুষার আবদুল্লাহর বক্তব্য-‘৭১-র এই রিপোর্ট সত্য হইলে তো ভোট দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮০ হাজার। এত ভোট আইলো কইত্থে। রাবিশ মিডিয়া কোনহানকার...’। এই বক্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে একাত্তরের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক পলাশ আহসান পাল্টা লেখা লিখলেন। ‘আয়নায় নিজের চেহারাও দেখুন’ শিরোনামের লেখাটিতে পলাশ সময় টেলিভিশনে প্রচারিত আইসিইউতে রেশমার ইন্টারভিউয়ের প্রসঙ্গ টেনে বললেন- আগে নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখুন। এই আয়না দেখানোর কাজটি করতে গিয়ে পলাশ নিজের স্টেশনের সম্মান উদ্ধারে যেসব কথা বললেন তাতে তেঁতুলের তেজ থাকলেও জানা গেল না কীসের ভিত্তি তার স্টেশন সেদিন সবার আগে ব্রেকিং দিল, এমএ মান্নান ৪ লাখ ৬৮ হাজার ভোট পেয়েছেন? পলাশ বলেছেন, অসমর্থিত সূত্র। তুষার আবদুল্লাহ আর পলাশ আহসান; একজন সিনিয়র সাংবাদিক একটি স্টেশনের বার্তাপ্রধান আর অন্যজন একটি স্টেশনের আমারই মতো এডিটোরিয়াল বোর্ডের কনিষ্ঠতম পদে নিয়োজিত তরুণ। এদের মধ্যে এই কলাম যুদ্ধ কারো কারো মনে বাড়তি বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে। (বাঙ্গাল বলে কথা, কাইজ্যা ভালোবাসি)।
তবে এই যুদ্ধ থেকে আমরা যারা মোটা মাথা সাংবাদিক, তাদের কাছে দুটি ম্যাসেজ আসে। প্রথমত আমি হতাশ হয়েছি। কারণ, যারা আজ তর্কে লিপ্ত তাদের স্টেশন সেদিন শুধু বিভ্রান্তিই তৈরি করেননি, বরং যারা বস্তুনিষ্ঠভাবে ফলাফল প্রচার করছিল তাদের ক্রেডিবিলিটিকে মারাত্মকভাবে হেয় করেছিল। অন্য কারো কথা জানি না, আমরা চ্যানেল টোয়েন্টিফোর সেদিন প্রতিটি কেন্দ্রের ফলাফল পুলিশ কেন্ট্রাল রুম থেকে অথবা সরাসরি প্রতিনিধি/রিপোর্টারদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে প্রচার করছিলাম। আমরা প্রতিটি সংখ্যাকে ওউন করছিলাম। যেটা ওউন করিনি, সেটা প্রচার করিনি (যেমন: বিএনপি প্রার্থীর মিডিয়া সেন্টার)। তবু আমরা এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ রাত ১টার আগে ব্রেকিং দিয়ে অসমর্থিত সূত্রে পুরো ফলাফল দিয়ে দেয়া হলো। কেমনটা লাগে বলেন?
আপাতত নিজের ঢোল পেটানো বন্ধ করে আলোকপাত করতে চাই দ্বিতীয় দিকটির দিকে। তুষার আবদুল্লাহ ও পলাশ আহসানের লেখার দিকে একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একে অন্যের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আক্রমণের আড়ালে এই দুজন আসলে একটি প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। তুষার তার বক্তব্যের প্রায় শেষ দিকে বলছেন: ‘জানাটা জরুরি ৮৫ ভাগ ভোটার উপস্থিতির ফল দুটি টেলিভিশন কোন সূত্রে পেল এবং যাচাই-বাছাই ছাড়া কেন প্রচার করল, সেই সঙ্গে ওই সূত্রকে আগামীতে সকলে মিলে বর্জন করার শপথ নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ে না নেমে ফল ঘোষণার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো কেবল রিটার্নিং অফিসারের ঘোষিত ফলাফলের প্রতিই আস্থা রাখতেও পারে কি না। সবাই একই গতিতে ফলাফল প্রচার করলে, অস্থিরতা কমে আসবে।’ আর পলাশ বলছেন: ‘যেকোনো সূত্র থেকে যেনতেন উপায়ে ফলাফল প্রকাশের ধারা শুরু হয়েছে সাম্প্রতিককালে। বিশেষ করে এই ধারা প্রকট হয়েছে গত চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়। তাহলে সবাইকেই একটি জায়গায় ঐকমত্যে আসতে হবে। দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সবাইকে একটা সিদ্ধান্তে তো পৌঁছুতে হবে। সেটা দর্শকদের স্বার্থেই। বড় কথা বিভ্রান্তি দূর করার স্বার্থে।’ খুব ভালো প্রস্তাব। সবক্ষেত্রে ফাস্ট-ফাস্ট কাজ করা সময় প্রধান স্লো স্লো ব্রাশ করার মতো বলছেন, নির্বাচনের ফলাফল রয়েসয়ে দেয়া যায় কি না? আর পলাশ প্রথমে প্রতিষ্ঠানের সম্মান বাঁচাতে তাকে মরিয়া আক্রমণ করলেও ‘রিটার্নিং অফিসারের ঘোষিত ফলাফলের প্রতিই আস্থা রাখতে পারেন কি না’- তুষার আবদুল্লাহর এই প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছেন। বলছেন, ‘দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সবাইকে একটা সিদ্ধান্তে তো পৌঁছুতে হবে’ । যাক, ব্যক্তিগত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের বাইরে এথিক্সের জায়গায় ঐকমত্য আছে তাহলে। কিন্তু ভূতের মুখে রাম নামের মতো অধর্মকারীদের মুখে ধর্মের কথা শুনলে কারো কারো তো ভয় হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আপাত এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা তথা মিডিয়া কেওয়াস- ‘গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত; দায়িত্বশীল হতে হলে সরকারি/রিটার্নিং অফিসের বক্তব্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে’- এমন বক্তব্যই স্টাবব্লিশ করছে কি না? )সূত্র: নতুনবার্তা, ১৩ জুলাই ২০১৩)
ছ) সম্প্রতি মিডিয়ার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের চরম খেলা দেখা গেল, সরকার দলীয় এমমি গোলাম মাওলা রনি ও ইনডিপেনডেন্ট টিভি এই দুই পক্ষের মধ্যে। ফেসবুক থেকে নেওয়া কয়েকটি স্টেটাস পড়লে এ বিষয়ে আরো স্পষ্ট হওয়া যায়।
১. প্রেসবার্তা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, পরীক্ষাটা কিন্তু এখন ইনডিপেনডেন্ট টিভির !! এই শিরোনামে স্ট্যাটাসে লেখা আছে, ইনডিপেনডেন্ট টিভির পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি দাখিলের ২৪ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ সরকারের নির্দেশে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করলো। সেই রিপোর্টকে বিশ্বাস করে আদালত মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে জামিন বাতিল করে একজন সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলো। এর মধ্য দিয়ে সরকার, পুলিশ এবং বিচারক খুব দ্রুততার সহিত তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। এখন ইনডিপেনডেন্ট টিভির পরীক্ষা দেবার পালা। তাদের উচিত খুব দ্রুততার সাথে শেয়ারবাজার কেলেংকারী নিয়ে অনুসন্ধান করা। তালাশের পর্বে কেলেংকারির হোতাদের মুখোশ খুলে দেয়ার মাধ্যমে ইনডিপেনডেন্ট টিভিকে এখন প্রমাণ করতে হবে, তারা সংসদ সদস্য রনির পিছনে এমনি এমনি ঘোরেনি। জনগণের স্বার্থেই ঘুরেছেন। তথ্যের জন্য ঘুরেছেন। দরবেশের আদিষ্ট হয়ে ঘোরেন নি। আর ইনডিপেনডেন্ট টিভি যদি তা না করে তাহলে রনি এ দেশের মানুষের কাছে অনেক বড় হিরো হয়ে আবির্ভূত হবেন। অন্যদিকে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন খালেদ মুহীউদ্দিনরা। -Atikur Rahaman (সূত্র: ফেসবুক)
২. যাক! সাংবাদিক পেটানোয় রনিকে গ্রেপ্তার করা হলো। তালাশ অনুষ্ঠানে একটা ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখতে চাই। এবং... পরবর্তীতে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারী নিয়েও তালাশ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করবে বলে আশা করি। স্বাধীন ও সৎ সাংবাদিকতা করার যোগ্যতা নিশ্চয়ই আছে তাদের। -Abu Sufian (সূত্র: ফেসবুক)
আবার অনেক পত্রিকাই, সালমান ও রনির দ্বন্দ্ব শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সূতরাং পাঠক, বুঝতেই পারছেন, মিডিয়ার কর্পোরেট যুদ্ধ ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ।
এ পর্বের প্রথম অংশ পড়ুন : http://www.bdtoday.net/thisweekdetail/detail/480
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন