সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
শিক্ষা বিস্তারে ব্যক্তিগত ভাবে কাজ করে আমরাও দারিদ্র বিমোচনের কাজ করতে পারি
02 Sep, 2013
ছয় সাত বছরের একটি শিশু কাজ করছে, পেটের ক্ষুধা মিটানোর জন্য ইট টানার মত কঠিন একটি কাজ অথবা তার চেয়েও ঝুকিপুর্ণ কোন কাজ। এ রকম একটি ছবি দেখলে কার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে? বেশীর ভাগই হয়ত মনে মনে সহানুভুতি জানাবে। কেউ হয়ত আদর করে একটু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। কেউ কেউ রাষ্ট্রকে গালি দিয়ে চলে যাবে।
এ রকম একটি ছবিতে বিভিন্ন রকম মন্তব্য দেখছিলাম কদিন আগে। একজন মন্তব্য করল এটা তার বাবার দ্বায়িত্ব এবং সেজন্য এই শিশুটির এই অবস্থার জন্য তার কোন সহানুভুতি নাই।
কথাটি হয়ত কিছুটা সত্যি, সাধারনত আমরা ধরে নেই সন্তান পালনের দ্বায়িত্ব তার বাবার। কিন্তু এটাও সত্যি যে দরিদ্র-অশিক্ষিত মানুষেরা সন্তান বেশী নিয়ে থাকে কারন তারা সন্তান মানুষ করার খরচ নিয়ে ভাবিত থাকেন না, তারা সাধারনত সন্তান কে বিবেচনা করে “আয়” বাড়ানোর উপাদান (income generating tool) হিসাবে। একটু বড় হলেই কাজে লাগিয়ে দিতে পারবে, তাতে সংসারের আয় বাড়বে। ফলে সেই শিশুটিও সংসারের আয়ের জন্য শিশু-শ্রমে নিযুক্ত হবে, লিখাপড়া থেকে বঞ্চিত হবে এবং বংশানুক্রমে দারদ্রের ঘানি টেনে যাবে।
সুতরাং সমাজে শিশু-শ্রম চালু থাকলে, দারিদ্র বহাল থাকলে শিশুদের মানবেতর জীবন যাপনের এই রকম ছবি আসতে থাকবেই। এখানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা আছে, হয়ত আয়ের সীমাবদ্ধতা আছে। দুর্ণীতির কারনে ট্যাক্স আদায় হয় কম, আর দারিদ্র বিমোচনের জন্য ব্যপক কর্মসুচী নিতে পারে না। আর যে টুকু কর্মসুচী নিয়ে থাকে তাও দুর্ণীতি ও অদক্ষতার কারণে কাংখিত সুফল আনতে পারে না।
কিন্তু সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাদের ব্যক্তিগতভাবে কিছুই কি করণীয় নাই? এটা শুধু রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব কিম্বা সেই শিশুটির বাবার দ্বায়িত্ব বলে পার পেয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? যে শিশুটি পৃথিবীতে চলে এসেছে, সে তো নিজের ইচ্ছায় আসে নি। লিখাপড়া করতে না পারলে তার জীবনে কি পরিণতি হবে তা বুঝবার ক্ষমতাও তার হয় নি। সে হয়ত দরিদ্র হয়ে মানবেতর জীবন যাপন কে ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিবে। কিন্তু এই দরিদ্র মানুষগুলো পুরো সমাজ কে স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে যাবার পথে বাধা হয়ে থাকবে, সমাজ কে পিছন থেকে টেনে ধরে রাখবে, তার ভুক্তভোগি হবে সমাজের সবাই।
কিন্তু আমরা ব্যক্তিগত ভাবে কিইবা করতে পারি?
প্রথমতঃ আমরা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছে, জন-প্রতিনিধিদের কাছে এটা একটা দাবী হিসাবে তুলে ধরতে পারি। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র যারা চালান তারা ব্যপক ভাবে জনপ্রিয় দাবীকে উপেক্ষা করতে পারে না। আমাদের দারিদ্র বিমোচনের দাবী আমাদের সমাজ থেকেই আসতে হবে, বিশ্বব্যাংক বা অন্য প্রতিষ্ঠানের চাপানো কর্মসুচি হিসাবে নয়।
দ্বিতীয়ত আমরা নিজেরা যতটুকু পারি তার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষার বিস্তারের চেষ্ট করতে পারি। শিক্ষাই পারে একজন ব্যক্তিকে যোগ্য মানবসম্পদ করে গড়ে তুলতে, যার ফলে সে শুধু দারিদ্র থেকেই বেরিয়ে আসবে না, সমাজের একজন সম্পদে পরিণত হবে।
আমরা সচেতন হলে দেখতে পাব আমাদের কাছের কিম্বা দূরের আত্মীয়-স্বজনের বাচ্চারা কিম্বা এলাকার অন্য কোন দরিদ্র বাচ্চা হয়ত পড়াশুনা করতে পারছে না সামান্য অর্থের অভাবে। আমি হয়ত আমার বাচ্চার জন্য মাসে কয়েক হাজার টাকা খরচ করছি, কয়েকশ টাকা দিলে গ্রামে একটি শিশু তার পড়াশুনাটা চালিয়ে নিতে পারে। আমার একটা ছোট বিলাসিতা বা কম প্রয়োজনীয় চাহিদা বাদ দিতে পারলে একজন শিশু স্কুলে থেকে ঝরে পড়ার হাত থেকে বাচতে পারে, যা তার জীবনটাকে দারিদ্রের শিকল থেকে বের করে আনতে পারে। ব্যস্ততা কিম্বা অন্য কোন কারনের আমি নিজে এ কাজ সরাসরি করতে না পারলেও ধরনের কাজ হয়ত কেউ করছেন, তাকে অর্থ-সাহায্য এবং মানসিক সাপোর্ট দিয়ে এ কাজে অংশ গ্রহন করতে পারি। আমরা নিজেরাও যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া-শুনা করে আজকে এই অবস্থায় এসেছি সেগুলিও হয়ত কোন শিক্ষানুরাগির প্রতিষ্ঠিত, তারা এসব প্রতিষ্ঠান না করলে শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ত আরো খারাপ অবস্থায় থাকত।
সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কিম্বা দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে সচেতনতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। সাথে যোগ হোক আমার-আপনার প্রচেষ্টা, যারা এখনো শুরু করিনি। হয়ত প্রয়োজন বোধ করিনি অথবা সময় হয়নি চিন্তা-কাজ করবার। কিন্তু একটু সদিচ্ছা থাকলেই আমরা এই কাজ করতে পারি।
যে সমাজে আপনি বড় হয়েছেন, সে সমাজের আগামী দিনের একজন পথিকৃত, আজকের একজন শিশুর দ্বায়িত্ব যদি আপনি নিতে পারেন, তাহলে সমাজের বড় উপকার হবে। আপনার নিজের ছেলে-মেয়ের জন্য অকাতরে খরচ করে যাচ্ছেন হয়ত তাদের ভবিষ্যত ভালর জন্য, পাশাপাশি আরেকটি গরীব শিশুকে যদি শিক্ষার আলো দিয়ে যেতে পারেন, আমাদের শিশু ভবিষ্যতে যে সমাজে বাস করবে তার মান উন্নত করতে অপ্রত্যক্ষ ভাবে সহায়তা করলেন, তাতে আমাদের শিশুরা আরো ভাল সমাজে বাসের সৌভাগ্য লাভ করবে। আর আপনি যদি পরকালে বিশ্বাসে মুসলিম হন, তাহলে নিশ্চয় বিশ্বাস রাখবেন যে এ ধরনের কাজ গুলি হবে “সাদকায়ে যারিয়ার” অন্তর্ভুক্ত, যার সুফল আপনি মৃত্যুর পরেও পেতে থাকবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন