বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে আজ দূর্যোগের ঘনঘটা। তত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কে আগামী সাধারণ নির্বাচন আজ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। প্রধান বিরোধী দল তত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেনা, আবার সরকারী দল কোন অবস্থাতেই তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেনে নির্বাচনে যাবেনা। সরকারী দল যে ভাবেই হউক আগামীতে ও ক্ষমতায় ঠিকে থাকতে চায়, অন্যদিকে বিরোধি দল যে কোন ভাবেই হউক পুনরায় ক্ষমতায় যেতে চায়। উভয়েরই চুড়ান্ত লক্ষ্য ক্ষমতার মসনদ। আর ক্ষমতার মসনদ আরোহনের এ লড়াই উভয় দলের জন্যই এক মরনপণ লড়াই। কেননা উভয় দলই জানে মসনদচ্যুত হলেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়্ । হত্যা, খুন, ঘুম, জেল, জুলুম, হামলা, মামলার শিকার হতে হয়। বিশেষ করে বর্তমান সরকারী দল মনে করে , যে ভাবে তারা বিরোধি দলের উপর নির্যাতন চালিয়েছে এমনকি যে ভাবে বিরোধি দলীয় নেতৃকে গৃহহীন করেছে তার ছেলেদের মামলা দিয়ে দেশান্তরী করেছে তার প্রতিশোধ তারা নেবেই।
সরকারী দল ভাল করেই জানে, যে সকল অপকর্ম তারা করেছে বিশেষ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, শেয়ারবাজার, হলমার্ক,পদ্মাসেতু কেলেঙ্কারি ইত্যাদিতে যে ভাবে জড়িয়ে পড়েছে তাতে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে মসনদে ফিরে আসা আর তদের পক্ষে সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক চারটি সিটি নির্বচনের ফলাফলে তারই প্রতিফলন ঘঠেছে। ফলে জামাতকে চাপে রেখে তারা তাদের অধীনে নির্বাচনে রাজী করানোর প্রচেষ্টা নিয়েছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সফল না হলে পরিস্থিতি আর ও ভয়ানক আকার ধারন করবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা হবে চরম অত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। ইতোমধ্যে শাহবাগ স্কয়ারের গণজাগরণ মঞ্চকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের উদ্বোগে গঠিত হেফাজতে ইসলাম বুমেরাং হয়ে দাড়িয়েছে।
সরকারের আমন্ত্রণে দাওয়াত খেতে এসে, বিরোধী নেতৃর আহ্বানে হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বর না ছাড়ার ঘোষনার পর নিমন্ত্রণকারীকেই সাড়াশী আক্রমন চালিয়ে তাদের তাড়াতে হয়েছে। উভয় নেতৃর মসনদের লালসার শিকারে পরিণত হয়ে অসহায় ভাবে জীবন দিতে হয়েছে কিছু নিরীহ এতিম মানব সন্তানকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। হত্যা- ঘুম- খুন- রাহাজানী- মারা-মারি-কাটা-কাটি-হিংসা-বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসার আগুনে দাউ দাউ করে আজ জ্বলছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত্বায়নের কাছে দেশ আজ অবরুদ্ধ- মানুষ আজ জিম্মী। অদ্ভ’ৎ- উদ্ভট, পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, দেউলিয়া-দুর্বল নেতৃত্ব রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্টার প্রতিযোগিতায় আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিহিংসা পরায়ন দুই পলাতক যুবরাজকে দেশের রাজনীতিতে টেনে এনে প্রতিষ্ঠা দিতে উভয় দলই আজ উঠে পড়ে লেগেছে। দেশের মানুষের সামনে আজ নেই কোন আশার আলো, নেই ভরসার কোন আলোকবর্তিকা। মসনদের অন্ধ মোহ, লোভ লালসা আর ক্ষমতার দ্বন্ধে দেশ ও জাতি আজ বিভক্ত। শাহবাগ আর শাপলা চত্বর , আস্তিক আর নাস্তিক বিতর্কে দেশ আজ বিভাজিত। গণতন্ত্রের বাড়া ভাতে আজ চাই পড়েছে। একটি ব্যার্থ রাষ্ট্রের পথে আজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ যার জন্ম হয়েছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। এক দীর্ঘ সংগ্রাম আর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে। যে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল রাম, রহিম, জন, পল। যে যুদ্ধে ইজ্জত দিয়েছিল গীতা, সীতা, সখিনা, জরিনা। বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম নেই যে গ্রামে শহীদ মিনার নেই, নেই শহীদের কবর কিংবা বীরঙ্গনার আর্তনাদ। বাংলাদেশের এমন কোন এলাকা নেই, যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংস যজ্ঞের চিহ্ন নেই। সৌভাগ্য এ দেশের মানুষের যে ফিলিস্তিন, দক্ষিণ আফ্রিকা, লাওস, কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েৎনামের মত সুদীর্ঘ কোন যুদ্ধ তাদের করতে হয়নি। ভাগ্যবান বাঙ্গালী জাতি সে যুদ্ধে পেয়েছিল এক অসাধারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুদৃঢ় এক জাতীয় ঐক্য আর মহান আল্লাহর আশির্বাদ। যার ফলে আধুনিক মারনাস্ত্রে সু-সজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ খালি হাতে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পরাজিত করে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল স্বাধীন- সার্বভৌম একটি দেশ, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ যে রাষ্ট্রের জন্মের পিছনে রয়েছে ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্বার এক সুদীর্ঘ অন্দোলন- সংগ্রামের ইতিহাস । রয়েছে সৎ,ত্যাগী, আদর্শবান, যোগ্য নেতৃত্বে এক সফল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ইতিহাস। আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে যে সকল শক্তি বিরোধিতা করেছিল। তাদের চক্রান্ত ও ষঢ়যন্ত্র কিন্তু আজ ও থেমে নেই। বাংলাদেশের ভৌগলিক ও কৌশলগত অবস্থান তাদেরকে এ দেশটির প্রতি আর ও বেশী ভাবে আকৃষ্ট করেছে। বাংলাদেশের অনাহরিত অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, বিস্তির্ণ সমুদ্র বন্দর, বিশাল মানবসম্পদ আর রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা তাদেরকে আজ আরও বেশী উৎসাহিত করে তুলেছে। ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে শুরু হয়েছে আর এক নতুন খেলা। ইচ্ছায় হউক আর অনিচ্ছায় হউক সে খেলার দাবার গুটি রূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এ দেশেরই কতিপয় উচ্চাভিলাসী দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিবিদ। উত্তরাধিকারের দাবীতে রাজনীতিতে পূনর্বাসিত হয়ে পরিবারতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে তারা পালা ক্রমে দেশটাকে লুটে পুটে খাচ্ছে। তাদের একমাত্র পুজি, তারা দুই জাতীয় বীরের রক্তের উত্তরাধিকার। মসনদের অন্ধ-মোহ-লোভ-লালসায়, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পরস্পর পরিপূরক- পরস্পর সম্পূরক সেই দুই জাতীয় বীরের লাশকে ও তারা আজ পরস্পর বিরোধি করে মূখো মূখি দাড় করিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির হাতের ক্রীড়নক হয়ে দেশটাকে আজ তারা রসাতলের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পলি মাটির দেশ, বাংলাদেশ জোয়ার ভাটার দেশ। এ দেশের মানুষ বড় সহজ- সরল। এ দেশের মাটি, বর্ষায় গলে গিয়ে যেমন নরম কাদায় পরিনত হয়, আবার গ্রীষ্মের দাব দাহে শক্ত-কঠিন হয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এ দেশের নদী-সমুদ্রের জল, জোয়ারে জেগে উঠে যেমন দুক’ল প্লাবিত করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আবার ভাটার টানে শুকিয়ে মরে কাঠ হয়ে যায়। বাংলার অদ্ভুৎ এই মাটি- প্রকৃতি আর মানুষের কারণেই কোন অর্জনকেই বাঙ্গালী জাতি বেশী দিন ধরে রাখতে পারে না। আর তাই একাত্তরের স্বাধীনতা পচাত্তরেই পথ হারায় আবার নব্বইয়ে জেগে উঠে। স্বৈরাচার নিপাত যায়- গণতন্ত্র মুক্তি পায়। কিন্তু অদ্ভুৎ-উদ্ভট পরিবারতন্ত্রের কাছে গণতন্ত্র আবার ও হারিয়ে যায়। দূর্ভাগা এ জাতীর সকল আশা ভরসাকে ব্যার্থ করে দিয়ে উত্তরাধিকারের দাবীতে ক্ষমতায় আসীন দুই নেতৃ দেশটাকে আবার ধ্বংশের পথে নিয়ে যায়। বাঙ্গালী জাতির ললাটে জুটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি গ্রস্থ রাষ্ট্রের খেতাব। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি আর তাদের দোসর সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদী শক্তি দেশটাকে নিয়ে এক নতুন খেলা শুরু করে।এক পুতুল আর এক পুতুলের মা‘কে শিখন্ডি করে পালাক্রমে, দেশটাকে নিয়ে তারা পুতুল খেলা শুরু করে। গণতন্ত্রের পরিবর্তে এক অদ্ভুৎ-উদ্ভট , পরিবারিক স্বৈরতন্ত্রের কাছে বাংলাদেশ আবার ও হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের সামনে আজ তাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর গণতন্ত্র আজ হুমকীর সম্মূখিন। চক্রান্ত আর ষঢ়যন্ত্রকারীরা জাতীয় দুই বীরের দুর্বল -দেউলীয়া নেতৃতত্বের মাঝে ক্ষমতার এক অন্ধ- মোহ-তৃষ্ণা জাগিয়ে দিয়েছে। পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ আর ঘৃণা জাগিয়ে তুলে তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুণ জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাঙ্গালী জাতিসত্বার অভ্যুদ্বয়ের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐক্যবদ্ধ শক্তি আজ খন্ডিত-বিভাজিত। আক্রমন-প্রতিআক্রমনের মাধ্যমে একে অন্যকে নিশ্চিহৃ করে ফেলার জন্য পরস্পর আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। হত্যা, খুন, ঘুম,আর প্রতিহিংসার আগুনে আজ দাউ দাউ করে জ্বলছে বাংলাদেশ। এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে আজ দ্রুত ধাবমান বাংলাদেশ। দেশ ও জাতীর চরম এই ক্রান্তি লগ্নে আজ তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশ প্রেমিক জাতীয শক্তির ইস্পাত কঠিন সুদৃঢ় এক জাতীয় ঐক্য। প্রয়োজন দ্বিদলীয় জোট-মহাজোটের বাহিরের ও সকল দেশ প্রেমিক শক্তিকে নিয়ে একটি জাতীয় সংকলাপ। প্রয়োজন শাহবাগ আর শাপলাচত্বরের দুরত্ব ঘুচিয়ে এনে শান্তি আর সমঝোতার পথে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার। প্রয়োজন স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় ইস্পাত-কঠিন-সুদৃঢ় এক এক্যবদ্ধ জাতিসত্বা। প্রয়োজন ত্যাগী, মেধাবী, সৎ, আদর্শবান , যোগ্য , দেশপ্রেমিক, বলিষ্ট নেতৃত্ব । প্রয়োজন পরিবর্তনের অঙ্গীকারে ঐক্যবদ্ধ এক মহা গণজাগরণ।
লেখক, আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন