সাপ্তাহিকী
|
এস এম মুকুল
|
|
অর্থনীতিকে গতিশীল করতে প্রয়োজন ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক
25 Aug, 2013
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকিংয়ের পরিবর্তে 'গণব্যাংকিং'ব্যবস্থ্থা চালু করে তার সুফল গণমানুষের কাছে পেঁৗছে দেয়ার উদ্যোগে গ্রামবাংলার সর্বত্র ব্যাংকের বহু শাখা খোলা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল সঞ্চয় সংগ্রহ করে উন্নয়নমূলক খাতে বিনিয়োগ করে দেশ ও দশের কল্যাণ সাধন করা। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ গরিব ও নিরক্ষর বলে প্রাথমিক পর্যায়ে যেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। সঞ্চয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে গ্রামের মানুষ ছিল অজ্ঞ। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক দেশের সর্বত্র গ্রাম পর্যায়ে সব শাখায় সাধারণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে 'ডিপোজিট ব্যাংকিং' শুরু করে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফলে গ্রামীণ পর্যায়ে মানুষের মধ্যে একটি সঞ্চয় প্রবণতা গড়ে ওঠে। এই হলো আমাদের প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার চিত্র।
দেশের গ্রামাঞ্চলের যেসব গরিব ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছেন তারা অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা জানেন না। দেখা যাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা নিয়ে যায় না। পক্ষান্তরে সরকারি ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি এবং সেবার পদ্ধতিগত জটিলতা ও অসহযোগিতার কারণে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের টার্গেট জনগণকে ব্যাংকিং সুবিধায় আনা যেতে পারে। গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মধ্যমানের ব্যবসায়ী, ছোট ও বড় কৃষিনির্ভর পরিবার এমনকি চাকরিজীবী কৃষিনির্ভর পরিবারের সঞ্চিত টাকা এখনো ঘরে অলস অকাজে পড়ে থাকে। ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংকের মাধ্যমেই সম্ভব এ টাকার যথাযথ ব্যবহার করা। মোট কথা ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক চালু হলে গ্রামের মানুষের মধ্য সঞ্চয় ও ঋণ প্রবণতা গড়ে উঠবে। দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে তা জাতীয় অগ্রগতির কাজে বিনিয়োগ ছাড়া দেশের আর্থিক কল্যাণ সম্ভব নয়। দেশকে সুন্দর ও দেশের মানুষকে সুখী করতে হলে দরকার গ্রামমুখী উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপন এবং গ্রামীণ সঞ্চয়ের সমাবেশ ঘটানো। বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি। শিল্পে অনগ্রসর ও কৃষিনির্ভর আমাদের অর্থব্যবস্থা। গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ প্রত্যক্ষভাবে কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষি খাত থেকে উপার্জিত আয়ের উদ্বৃত্ত অংশ সঞ্চয় হিসেবে রাখলে কৃষি তথা কৃষির সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নসহ তাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করা সম্ভব।
আমাদের দেশের জনসাধারণের তিনটি ভাগ রয়েছে। একটা শ্রেণির হাতে অঢেল টাকা রয়েছে। আরেকটা শ্রেণি দিন আনে দিন খায় অবস্থা। এ শ্রেণির মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই বড় কথা। ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের কথা ভাবেন না তারা। এর মধ্যে আরেকটা শ্রেণি আছে_ তার নাম মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংখ্যায় সবচেয়ে বড় এবং ব্যাপক। এ শ্রেণির আছে সীমিত আয়, আছে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের স্বপ্ন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মধ্যমণিও এ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এ শ্রেণিকে কেন্দ্র করেই সব অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয়। কেননা, একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ শহরে, মফস্বলে এবং গ্রামে সমানভাবে অবস্থান করছে। যাদের অধিকাংশই ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে।
এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে আছে_ কৃষিজীবী পরিবার, মধ্যবিত্ত রোজগারি পরিবার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিবার এবং কৃষি ও অন্য সহযোগী পেশানির্ভর পরিবার। যাদের প্রয়োজনীয় টাকা সরাসরি লেনদেন হয়। তাদের সঞ্চয় নিজেদের কাছে বা ঘরে জমা রাখে। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো ব্যাংক সেবা নিয়ে তাদের কাছে যাচ্ছে না। অথচ এই পরিম-লে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। গ্রামে অনেক কৃষিজীবী পরিবার রয়েছে যারা বছরে কয়েকশ মণ ধান ঘরে তোলেন। এসব পরিবারের খরচের অতিরিক্ত অংশ অলস পড়ে থাকে ঘরে। এছাড়া তাদের আরো কিছু আয় খাত থাকে। এসব খাতের আয় করা টাকা কোনো নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগও হয় না। গ্রামে লগি্ন খাতে প্রচুর টাকা হাতে হাতে বাণিজ্য করছে। এসব টাকা নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েই লেনদেন হয়। গ্রামে একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক সহজে ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে চান না না। কিন্তু ব্যাংক যদি তার কাছে এগিয়ে যায় তাহলে তাদের চোখ খুলবে। একজন সাধারণ শিক্ষকের সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য সঞ্চয় ও ঋণব্যবস্থা কিংবা বিবাহ সঞ্চয় বা ঋণ সুবিধার কথা জানলে ব্যাংকিং লেনদেন সম্পর্কে তাদের আগ্রহ স্বাভাবিক হবে। যতদূর জানি সরকারের এ বিষয় নিয়ে ভাবনা আছে। উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত কার্যকর করলে এ ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংকিং জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
'বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৯' তথ্য জানা গেছে, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এবং গ্রামীণ মানুষকে ব্যাংকিং সেবা দিতে গ্রামাঞ্চল ব্যাংকগুলোর শাখা খোলার বিধান থাকলেও নানা কৌশলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অধিক মুনাফা লাভের লক্ষ্যেই গ্রামীণ এলাকায় শাখা না খোলার প্রধান কারণ। গ্রামীণ অর্থনীতি এবং কৃষি খাতকে চাঙ্গা করতে গ্রামীণ এলাকায় শাখা খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সুবিধা ঘোষণা করলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ সুযোগ নিচ্ছে না। কোনো ব্যাংক ৫টি শাখা খুললে তার মধ্যে একটি পল্লী এলাকায় খুলতে হবে। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা না করে জেলা শহরগুলোকে পল্লী এলাকা হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। থানা পর্যায়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের ব্যবসা কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। যে কারণে মূলত গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করছে না দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো গ্রামের চেয়ে শহরকেন্দ্রিক ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক, স্থানীয় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক এ চার ধারার তফসিলী ব্যাংক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, মার্চ ২০০৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৪৮টি তফসিলী ব্যাংক ৬ হাজার ৯০০টি শাখার মাধ্যমে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করছে। পাশাপাশি তফসিলভুক্ত নয় এমন জাতীয় সমবায় ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও গ্রামীণ ব্যাংক রয়েছে। জানা গেছে বাংলাদেশে কার্যত তফসিলী ব্যাংকগুলোর মোট ৩ হাজার ৯৮৬টি শাখা গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। আর শহরে অবিস্থিত শাখার রয়েছে ২ হাজার ৯১৪টি। ২০০৯-এর মার্চ পর্যন্ত স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের মোট শাখার মাত্র ৩০ দশমিক ২৬ শতাংশ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট শাখার ৬৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের মোট শাখার ৮৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। কোনো বিদেশি ব্যাংকের শাখা গ্রামাঞ্চলে নেই।
ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক এক অর্থে সাধারণ মানুষের ব্যাংকিং সেবা। আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটা বিশাল বড় অংশ এখনো ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে। যারা এ সেবার বাইরে তাদের অবস্থান গ্রামাঞ্চলে এবং মফস্বলে। গ্রামাঞ্চলে যারা দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী_ যারা প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে তাদের মধ্যে ঋণ ও সঞ্চয় সেবা পেঁৗছে দিতে ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংকের মাধ্যমে জনগণের নিকট থেকে সংগ্রহ করা আমানত টার্গেট জনগোষ্ঠীকে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম তহবিলের জোগানে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামে অর্থপ্রবাহ বাড়ানো, গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে ব্যাংকিং সুবিধা পেঁৗছে দেয়া, ঋণ তহবিল জোগান এবং গ্রাহকদের কাছে দ্রুত রেমিট্যান্স পেঁৗছে দেয়া সম্ভব।
আমরা ইন্দোনেশিয়া রাকাইয়াত ব্যাংক এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের কথা বলতে পারি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি সমন্বয় ও ঋণ বিতরণে এদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও উগান্ডায় ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সাফল্যও ভালো। কিন্তু এই একটি ব্যাংক দিয়ে মধ্যবিত্ত ও গরিব বিশাল জনগোষ্ঠীকে সেবার আওতায় আনা সম্ভব নয়। আরো কিছু ব্যাংককে অনুমোদন দিয়ে সারা দেশের এ বিশাল অঙ্কের টাকার প্রবাহকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা সম্ভব হলে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিরাট সুফল বয়ে আনতে পারে। গ্রামাঞ্চলের অর্থপ্রবাহ বাড়াতে এবং উৎপাদনমুখী ও কৃষিভিত্তিক প্রকল্প গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যাংক পুঁজির জোগান দিতে পারবে। এ পদ্ধতি গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
আমাদের জাতীয় আয়ের একটা বড় অংশ আসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। প্রবাসী জনশক্তির অধিকাংশের পারিবারিক অবস্থান গ্রামে বা মফস্বল শহরে এবং তারা মধ্যবিত্ত পরিবারের অংশ। আমাদের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি এবং সেবাদান এখনো এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সেবা পেঁৗছে দিতে পারেনি। এমন অবস্থায় ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক স্থাপিত হলে গ্রাহকদের রেমিট্যান্সের অর্থ দ্রুত পেঁৗছানো সম্ভব হবে।
যেহেতু এ ব্যাংকগুলোর অবস্থান হবে মফস্বল বা গ্রামীণ এলাকায়, কাজেই গ্রামের একটি পরিবার তার প্রবাসী স্বজনের পাঠানো অর্থ খুব কম সময়ে, নিরাপদে এবং কাছে থেকে পাওয়া সম্ভব। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থও এসব ব্যাংকের মাধ্যমেই ব্যবহৃত হবে। এর ফলে অলস টাকাগুলোর নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগ সুফল পাওয়া যাবে। ব্যাংকিং ঋণ ও সঞ্চয় সুবিধার আওতায় চলে আসবে গ্রামীণ জনগণ। এমন কিছু প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করতে হবে_ যাদের সারাদেশে সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক রয়েছে বা বেশকিছু জেলার উপজেলা পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চলমান আছে। যারা পর্যায়ক্রমে এ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে পারবে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়ে তাদের কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক ও গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে পৃথক আইনে পরিচালনা করা যেতে পারে।
এস এম মুকুল: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন