সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য ও স্ট্রাটেজী
মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের মূল লক্ষ্যটি হলো ইসরাইলের নিরাপত্তা বিধান ও তেল-সম্পদের উপর পূর্ণ দখলদারি। তবে সে লক্ষ্য পূরণে আরব বিশ্বকে ২২ টুকরোয় বিভক্ত রাখাটাই তাদের একমাত্র স্ট্রাটেজী নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজী হলো,ইরাক ধ্বংসের ন্যায় মিশরের মত গুরুত্ব আরব দেশগুলোকে আরো বিভক্ত করা,এবং সে বিভ্ক্ত টুকরোগুলোকে সামরিক ও অর্থনৈতীক ভাবে পঙ্গু করা ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। মিশরে আজ সে প্রক্রিয়াই জোরে শোরে শুরু হয়েছে। সম্প্রতি তেমন একটি স্ট্রাটেজীর পক্ষে সাফাই পেশ করেছেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও। তিনি আরব দেশগুলোকে পুণরায় বিভিন্ন গোত্রভিত্তিক বিভক্তির পরামর্শ দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য সেটিকে জরুরীও বলেছেন। তার সে স্ট্রাটেজীতে যেমন ইরাককে বিভক্ত করার পরামর্শ রয়েছে,তেমনি পরামর্শ রয়েছে সিরিয়া ও মিশরকে বিভক্ত করার। মিশরের খৃষ্টানগণ দেশের দক্ষিণাংশে তেমন একটি খৃষ্টান রাষ্ট্রের দাবীও করে আসছে। বিশ্বের অনেক দেশের সে বিভক্ত টুকরোগুলি স্বাধীন দেশরূপে গ্রহণযোগ্যতাও পাবে। কারণ সেগুলির আয়তন নিশ্চয়ই কাতার,কুয়েত,আবুধাবি,দুবাই বা বাহরাইনের চেয়ে ক্ষুদ্রতর হবে না।
এমন বিভক্তকরণ প্রক্রিয়ায় ইসলামের শত্রুপক্ষ অতীতে যেমন মক্কার শরীফ হোসেন,নজদের সউদ পরিবার এবং কুয়েত-কাতার-আবুধাবি-দুবাই-ওমান-বাহরাইনের একপাল সামন্ত শেখদের সহযোগীতা পেয়েছিল,এখনও পাবে। সমর্থণ দিবে ইসলামে অঙ্গিকারশূন্য বিপুল সংখ্যক সেক্যুলারিস্ট, লিবারালিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, ট্রাইবালিস্ট ও সোসালিস্টগণও। নিজেদের প্রকল্প বাস্তবায়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রগণ এখন শুধু সামন্ত শেখদেরই প্রতিপালন করে না,বিপুল পরিচর্যা দেয় মহম্মদ বারাদাইয়ের ন্যায় অসংখ্য সেক্যুলারিস্ট,লিবারালিস্ট, ন্যাশনালিস্ট ও ট্রাইবালিস্টদেরও। প্রয়োজনে তাদেরকে নবেল পুরস্কার দিয়ে আন্তর্জাতিক গ্রহনযোগ্যতা বাড়ায়। সে সাথে প্রতিপালন করে এবং প্রশিক্ষণ দেয় বিপুল সংখ্যক সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদেরও। তাছাড়া প্রতিটি মুসলিম দেশের অভ্যন্তরে নামিয়েছে হাজার হাজার এনজিও কর্মি। এরা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ট্রোজেন হর্স। ইরাক ও আফিগানিস্তান ধ্বংসে তো তাদের সাথে নিয়েই যুদ্ধে নেমেছিল। এখন সে অভিন্ন স্ট্রাটেজী নিয়ে নেমেছে মিশর ধ্বংসে।মিশরের বর্তমান রাজনৈতীক অস্থিরতা বুঝতে হলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এ গ্রান্ড স্ট্রাটেজীকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
লক্ষ্য কেন মিশর ধবংস?
সমগ্র আরব জাহানে মিশর হলো সবচেয়ে জনবহুল। দেশটির হাতে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সর্ববৃহৎ সামরিক বাহিনী।রয়েছে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের সর্ববৃহৎ ইসলামপন্থি জনশক্তি। তাছাড়া অন্যান্য আরব দেশগুলির উপর দেশটির রাজনৈতীক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও গভীর।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল পাশ্চাত্য দেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল বিষয়টি হলো ইসরাইলের নিরাপত্তা। ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্টসহ সকল পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলোর মূল স্ট্রাটেজীটি হলো মুসলিম দেশগুলোকে শক্তিহীন রাখা। সেটিই হলো আববভূমিকে ২২টি দেশে বিভক্ত রাখার মূল কারণ। সে জন্য তারা নিজ হাতে গড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এক কৃত্রিম মানচিত্র যা ইতিহাসে কোন কালেই ছিল না। ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও তেল সম্পদের উপর দখলদারি বজায় রাখার স্বার্থেই প্রয়োজন পড়েছিল ইরাক ধ্বংসের। এবার ইসলামের চলমান জোয়ার রুখতে তারা হাত বাড়িয়েছে মিশর ধ্বংসে। তারা জানে আরবদের শক্তির মূল উৎস তেল বা গ্যাস নয়। সেটি ইসলাম। ইসলামের বলেই আরবগণ অতীতে অপ্রতিদ্বন্দী বিশ্বশক্তির জন্ম দিয়েছিল। বিজয়ীর বেশে ইসলাম পৌঁছে গিয়েছিল ইউরোপেও। তাছাড়া সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান ও গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচনে সর্বত্র ইসলামপন্থিদের বিজয়ের সমগ্র আরব বিশ্বজুড়ে ঐক্যের পক্ষে যে বিপুল জাগরণ এসেছে তাতে ইসলামের সে শক্তিকেও তারা দেখেছে। দেখেছে মুসলমানদের মাঝে জেগে উঠা নতুন আত্মবিশ্বাস। এ জাগরণকে দেখছে মধ্যপ্রাচ্যের কৃত্রিম মানচিত্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ রূপে। এবং হুমকি মনে করছে ইসরাইলের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে। ফলে যে কোন মূল্যে ইসলামের এ জাগরণ তারা রুখতে চায়।ফলে মিশরের ন্যায় তিউনিসিয়া ও লিবিয়াতেও শুরু হয়েছে প্রতিবিপ্লবের ষড়যন্ত্র।
আনোয়ার সা’দাতের আমল থেকেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী চক্রের লক্ষ্য ছিল মিশরকে বশে রাখে এবং নিজ স্বার্থে লাঠিয়াল রূপে ব্যবহার করা। সে নীতি হুসনী মোবারক ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত বহাল ছিল। মিশরের রাজনীতির উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাতকে দিয়ে ১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিটি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। সে চুক্তির স্বাক্ষরে ঘুষস্বরূপ সামরিক বাহিনীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর দেয় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপুল অর্থের ঘুষ দেয় ইউরোপীয় দেশগুলোও। ১৯৭৮ সালে মিশরের সামরিক বাজেট ছিল ১.৮ বিলিয়ন ডলার। সামিরিক বাজেট এখন বিপুল বাড়ে বেড়েছে। কিন্তু সমুদয় সামরিক বাজেটের শতকরা ৩৩% ভাগই আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে।–(সুত্রঃ আল জাজিরা টিভি)।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরাইলের পরই মিশরকে দেয়া হয় সবচেয়ে বড় রকমের অর্থ।
হুসনী মোবারক ছিল মার্কিনীদের অতি বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। গাজার উপর ইসরাইলী হামলার সময় সে ফিলিস্তিনীদের দমনে ইসরাইলীদের পক্ষ নেয়।লাগাতর বোমা বর্ষণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা ফিলিস্তিনীদের যেমন মিশরে ঢুকতে দেয়নি,তেমনি গাজায় ত্রাণসামগ্রীও পৌঁছতে দেয়নি। বিগত গণঅভ্যুত্থানের হুসনী মোবারকের অপসারণ এবং নির্বাচনে ইসলামপন্থি ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিপুল বিজয়ের পর সাম্রাজ্যবাদীরা বুঝতে পেরেছে,এখন আর আরব বিশ্বকে পূর্বের ন্যায় বশে রাখা সম্ভব নয়। ফলে পাল্টে গেছে তাদের স্ট্রাটেজীও। এখন বশে রাখার লক্ষ্যে তাদের নতুন স্ট্রটেজীটি হলো মিশরের রাজনৈতীক, অর্থনৈতীক ও সামরিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া।সে কাজে তারা কোয়ালিশন গড়েছে ইসলামে অঙ্গিকারহীন সেক্যুলারিস্ট,লিবারেলিস্ট,ন্যাশনালিস্ট, ট্রাইবালিস্ট ও সোসালিস্টদের সাথে। ইসলামের প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমানদের শক্তি ও গৌরববৃদ্ধি নিয়ে অমুসলিম সাম্রাজ্যবাদীদের ন্যায় এসব মুসলিম নামধারি সেক্যুলারিস্ট,লিবারেলিস্ট,ন্যাশনালিস্ট, ট্রাইবালিস্ট ও সোসালিস্টদেরও কোন আগ্রহ নেই। বরং তারাও সাম্রাজ্যবাদীদের ন্যায় ইসলামের জাগরণকে নিজেদের জন্য পরাজয় মনে করে। এবং এ চিত্রটি শুধু মিশরের নয়,বাংলাদেশসহ প্রতিটি মুসলিম দেশের। সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে গড়ে উঠেছে তাদের গভীর সখ্যতা ও কোয়ালিশন। তাদের সাথে শামিল হয়েছে মিশরের খৃষ্টানগণও। সংখ্যায় তারা জনসংখ্যার প্রায় ১০%। মিশর ধ্বংসের সে স্ট্রাটেজীর অংশ রূপেই তারা আর্মিকে খাড়া করেছে জনগণের বিরুদ্ধে। এতে রাজপথে যেমন জনগণের লাশ পড়ছে, তেমনি আর্মিও জনগণের শত্রু রূপে চিত্রিত হচ্ছে। ফলে এভাবে বিভাজন ও সংঘাত এনেছে দেশে। একটি দেশের মেরুদন্ড ধ্বংসে এর চেয়ে বেশী কিছুর প্রয়োজন পড়ে কি?
স্বৈরাচারের সংস্কৃতি সেনাবাহিনীতে
মিশরের সামরিক বাহিনী নিছক একটি সামরিক বাহিনী নয়,এটি দীর্ঘকালের এক শাসকবাহিনী। বিগত ৬০ বছর ধরে তারাই দেশের একচ্ছত্র শাসক।ফলে সামরিক বাহিনীর সংস্কৃতিটাই ভিন্ন। দেশের সীমান্ত পাহারার চেয়ে তারা বেশী গুরুত্ব দিয়েছে মিশরের রাজনীতিতে। লক্ষ্য,যারা ইসলামপন্থি ও ইসরাইল বিরোধী তাদেরকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে নির্মূল করা। একাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের থেকে প্রচুর সাহায্য ও বাহবাও পাচ্ছে। সে নীতিটির কঠোর প্রয়োগ হয়েছে ইসলামি দল রূপে পরিচিত ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে বিগত ৬০ বছর ধরে। নাসেরের আমলে দলটির বড় বড় নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে,হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বছরের পর বছর জেলে রাখা হয়েছে এবং নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাদের রাজনীতিকে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রগণ সামরিক বাহিনীর এরূপ স্বৈরাচারি নীতিকে কোন দিনই নিন্দা করেনি। বরং অবিরাম সামরিক সাহায্য দিয়ে সামরিক সরকারকে পুরস্কৃতই করেছে।
মিশরের সমগ্র ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় ২০১২ সালে। আর সে নির্বাচনে বিপুল ভাবে বিজয়ী হয় ইখওয়ানুল মুসলিমীন।আর সে বিজয়ই তাদের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনে। তাদের সে বিজয়কে মেনে নেয়াটি সামরিক বাহিনীর জন্য যেমন কঠিন ছিল,তেমনি কঠিন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্যও। বস্তুত নির্বাচনি সে বিজয়কে প্রত্যাখান করেই সামরিক বাহিনী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসীকে হটিয়ে ক্ষমতা নিজ হাতে নিয়ে নিল। বাহনা হিসাবে পেশ করেছে ড. মুরসীর বিরুদ্ধে রাজপথের মিছিল। কিন্তু এরূপ মিছিল কোন দেশে হয় না? কিন্তু তাতে কি সামরিক অভ্যুত্থান হয়? এখন প্রমাণ মিলছে,ড.মুরসীর বিরুদ্ধে জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে রাজনীতির ময়দানে কৃত্রীম বাস্তবতা সৃষ্টির লক্ষ্যে। এ লক্ষে সৌদি আরব, কুয়েত,আরব আমিরাত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগও করেছে। সে বিনিয়োগের ফলেই প্রেসিডেন্ট ড.মুহাম্মদ মুরসীর বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। এবং অর্থদাতাদের উস্কানীতেই তারা রাতারাতি আপোষহীন হয়ে উঠে। ড. মুরসীর পদ্ত্যাগ ছাড়া কোন কিছুতেই তারা রাজি হয় না। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেই চাপ দেয়া হচ্ছিল পদত্যাগের সে দাবী মেনে নিতে। অবশেষে সে মিছিলগুলোর দোহাই দিয়েই সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ সিসি ড. মুরসীকে সামরিক শক্তির জোরে অপসারণ করে ও তাঁকে কারা রুদ্ধ করে। এমন একটি সুস্পষ্ট সামরিক অভ্যুত্থানকে ইখওয়ান বিরোধীরা বলছে জনগণের বিপ্লব এবং অভ্যুত্থানের নায়ক সেনা প্রধান জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ সিসিকে চিত্রিত করছে রাজপথের নেতা রূপে। মিশরের অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল হুসনি মোবারকের সমর্থক ও ইখওয়ান বিরোধী। হুসনী মোবারকের পতনের পর তাদের মাঝে আরেকজন স্বৈরাচারের প্রয়োজন ছিল। জেনারেল সিসি তাদের সে আকাঙ্খাটি পূর্ণ করেছে। ফলে তার প্রশংসায় মিশরের সেক্যুলার মিডিয়া প্রচন্ড সোচ্চার। তারা প্রচার করছে,জেনারেল সিসি সেনা-অভ্যুত্থান করেছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষে। মিথ্যাচার আর কাকে বলে?
সম্প্রতি জেনারেল সিসি টিভিতে এসে জনগণের প্রতি আবেদন রাখে,তারা যেন রাজপথে নেমে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর যুদ্ধকে সমর্থণ করে। সে আহবানে ও সরকারি সহযোগীতায় সামরিক অভ্যুত্থানের পক্ষে কায়রোর রাজপথে বিশাল মিছিলও হয়েছে। কিন্তু মিছিল যতটা বড় হয়েছে তার চেয়ে বেশী হয়েছে সে মিছিল নিয়ে মিথ্যাচার। সামরিক সরকার বলছে,৭০ লাখ মানুষ তাদের পক্ষে মিছিল করে সমর্থণ জানিয়েছে। এ মিছিলকে জাহির করছে সামরিক বাহিনীর পক্ষে ম্যান্ডেট রূপে। যুক্তি দেখাচ্ছে,এটি জনগণের বিপ্লব,অভ্যুত্থান নয়। তবে মিশরের ইতিহাসে সামরিক জান্তাদের এমন কৌশল নতুন নয়। পূর্বেও ঘটেছে। সাবেক সামরিক জান্তা জামাল আব্দুন নাসের ১৯৫২ সালে যখন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করে,তখনও এরূপ বড় বড় মিটিং-মিছিল করে জনপ্রিয়তা জাহির করতো। কিন্তু কখনোই নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে দেয়নি। কৃত্রিম মিছিল-মিটিংয়ের বাইরে দেশের গ্রামগঞ্জে যে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ রয়ে গেছে তাদের মতামতকে সেদিনও কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক দেশে ম্যান্ডেট যাচায়ে তো নির্বাচন হয়। মিছিল তো নির্বাচনের বিকল্প নয়। সামরিক বাহিনী সে পুরোন খেলাই নতুন ভাবে শুরু করেছে। কিন্তু সামরিক শাসকদের ৭০ লাখের মিথ্যাটি ফাঁস করে দিয়েছে গুগোল ম্যাপ। গুগোল ম্যাপের হাতে নিখুঁত হিসাব নিকাশ কায়রোর রাস্তা ও ময়দানগুলির ধারণক্ষমতা নিয়ে। হজে মাত্র তিরিশ লাখ মানুষের সমাবেশ করতে লাগে আরাফাতের ন্যায় বিশাল ময়দান।কিন্তু সমস্যা হলো কায়রোর সর্ববৃহৎ ময়দানটি আরাফাতের ময়দানের দশ ভাগের এক ভাগও নয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ৭০ লাখ লোক কোথায় কিভাবে জমা হলো তা নিয়ে? তাছাড়া কায়রোর বাইরে গ্রামাঞ্চলে তো ইসলামপন্থিদেরই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। মিছিল তো হয়েছে শহরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামবাসীর মতামতের সে হিসাবটি কোথায়?
জালিয়াতি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রগণ আফগানিস্তান ও ইরাকে গণহত্যা ও দেশধ্বংসের যুদ্ধকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামে প্রচার করেছিল। সে মার্কিন কৌশলটি এখন গণহত্যার সকল নায়কদের মুখে মুখে ফিরছে। অধিকৃত গাজা’র নিরস্ত্র নারী-পুরুষের মাথার উপর ইসরাইলের সামরিক বাহিনী শত শত টন বোমা ও মিজাইল নিক্ষেপ করে যেভাবে হাজার মানুষকে নিহত ও আহত করেছিল সেটিকেও তারা প্রচার করছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ রূপে। বাংলাদেশে যারা শাপলা চত্ত্বরে গণহত্যা ঘটালো তারাও সেজেছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যোদ্ধা রূপে। সত্য এভাবেই প্রকৃত সন্ত্রাসীদের হাতে বার বার হাইজ্যাক হয়েছে। তারা শুধু মানুষই খুন করে না, সত্যকেও খুন করে।
সন্ত্রাসের অর্থ হলো নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে ত্রাস সৃষ্টি করা। আফগানিস্তান,ইরাক বা ফিলিস্তিনীনে তো সন্ত্রাস করেছে মার্কিন হানাদাররা, সেসব দেশের নিরস্ত্র মানুষেরা নয়। এখন একই রূপ নগ্ন জালিয়াতি ও সত্য-নাশি ভূমিকায় নেমেছে মিশরের সামরিক বাহিনী ও তার মিত্ররা। জেনারেল সিসি ঘোষণা দিয়েছেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের।কিন্তু কারা সে সন্ত্রাসী এবং কারা সে সন্ত্রাসে আহত বা নিহত -সে তথ্যটি তিনি দেননি। বরং কায়রোর রাজপথে শত শত লাশ পড়ছে তো সেনাবাহিনীর হাতে। তারাই শহরের রাজপথে অস্ত্র হাতে ও ট্যাংক নিয়ে ঘুরছে। জনগণের হাত তো খালি। তাদের মুখে শুধু স্লোগান। স্লোগান দিয়ে কি সন্ত্রাস হয়? তাছাড়া সেনাবাহিনীর যুদ্ধটি কাদের বিরুদ্ধে সেটি তো আজ আর গোপন বিষয় নয়। তারা যুদ্ধ শুরু করেছে দেশের নির্বাচিত নিরস্ত্র প্রেসিডেন্ট ড. মুরসীর বিরুদ্ধে। অস্ত্রের প্রয়োগ হচ্ছে ইখওয়ানূল মুসলিমীনির নিরস্ত্র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এরপরও কি বুঝতে বাঁকি থাকে কারা প্রকৃত সন্ত্রাসী? রাজপথে ধর্না দেয়া কি সন্ত্রাস? রাজপথের নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে কি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলা যায়? মিশরের সেনাবাহিনী,সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী ও সরকার সমর্থক মিডিয়ার কর্মকর্তাগণ যে কতটা বিবেকবর্জিত ও তাদের নীতি যে কতটা ডবল স্টান্ডার্ডে পরিপূর্ণ সেটিও কি কোন গোপন বিষয়? ইখওয়ানুল মুসলিমীন মাত্র একমাস হলো রাস্তায় ধর্না দেয়া শুরু করেছে। অথচ সেটিকে আজ রাস্তায় যানবাহন চলাচল ও জনস্বার্থের বিরুদ্ধে বিশাল সংকট রূপে চিত্রিত করেছে। অথচ বিগত এক বছর ধরে ইখওয়ান-বিরোধীরা ড. মুরসির বিরুদ্ধে তাহরির ময়দানে লাগাতর ধর্না দিয়ে আসছে। দীর্ঘ এক বছর যাবত তারা সেখানে কোনরূপ যানবাহন চলাচল হতে দেয়নি। কিন্তু সেক্যুলার মিডিয়া ও সামরিক জেনারেলগণ সে ধর্নার বিরুদ্ধে কিছুই বলেনি।বরং তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে সেটিকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে। কিন্তু এখন মুখ খুলেছে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের রাজপথের সমাবেশের বিরুদ্ধে।
স্ট্রাটেজী সেনাবাহিনী বিনাশে
সেনাবাহিনী তো তখনই শক্তিহীন হয় যখন জনগণের সামনে সেটি শত্রু রুপে চিহ্নিত হয়। একমাত্র শত্রুদের কাছেই সেটি কাম্য হতে পারে। মিশরের এবং সে সাথে ইসলামের শত্রুগণ তো সেটিই করছে। সেরূপ একটি লক্ষ্য নিয়েই মিশরের সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে খাড়া করা হয়েছে। সেটি সেনা-প্রধান জেনারেল আব্দুল ফাতাহ সিসি’র মাধ্যেমে।এর আগে ইরাকের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে দেশটিকে দখলে নেয়ার পর মার্কিনীরা সমগ্র সেনাবাহিনীকেই বিলুপ্ত করেছিল।অথচ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে সেটিই ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী।গণতন্ত্র ও জনগণের শত্রু রূপে সেনাবাহিনীর বর্তমান অবস্থান শুধু সেনাবাহিনীকে নয় মিশরকেও দুর্বল করবে। ইসরাইল ও ইসরাইলের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো সেটিই চায়।মার্কিন বেতনভোগী মিশরীয় জেনারেলগণ মূলতঃ তেমন একটি আত্মঘাতি কাজে লিপ্ত। সেনাবাহিনীর পিছনে মার্কিনীদের বাৎসরীক ১৩০০ মিলিয়ন ডলারের যে বিনিয়োগ সেটি মিশরীয় সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য ছিল না,বরং ছিল জেনারেল সিসির ন্যায় আত্মঘাতি দাস প্রতিপালনে -সেটিই এখন প্রকাশ পাচ্ছে।
তবে মাকির্নীযুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বর্তমান বিনিয়োগটি শুধু সামরিক বাহিনীর উপর নয়। শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর বাইেরও।বিভিন্ন রাজনৈতীক দল,মিডিয়া প্রতিষ্ঠান,এনজিও,শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং সিভিল সোসাইটির লক্ষ লক্ষ কর্মী এখন সরাসরি বেতন পেয়ে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে। বহু লক্ষ মানুষ এখন সাম্রাজ্যবাদীদের বেতনভোগী কর্মাচারির তালিকায়। ফলে মার্কিনীদের ইশারায় সামরিক বাহিনী নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্যু করলে সে ক্যু’র সমর্থণে শুধু সামরিক বাহিনী ও তার বিদেশী বেতনদাতারাই নয়,বিপুল সমর্থণ নিয়ে এগিয়ে আসছে মার্কিন অর্থপুষ্ট এরূপ অসংখ্য সংগঠনের বেতনভোগী নেতাকর্মীগণও। তাই মুরসীর বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষকে কায়রোর রাজপথে জমা করতে সাম্রাজ্যবাদী কোয়ালিশনকে কোন বেগ পেতে হয়নি। তাদের অন্যকোন চাকুরি-বাকুরি,ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থ-উপার্জনের চিন্তা করতে হয়নি।
সাম্রাজ্যবাদী মহল ও তাদের মিত্ররা বুঝতে পেরেছে ব্যালটের রাজনীতিতে তাদের বিজয় আদৌ সম্ভব নয়। তাই অন্য কৌশল ধরেছে।তারা গুরুত্ব দিচ্ছে রাজপথ,সেনাবাহিনী,বিচারব্যবস্থা, মিডিয়া ও প্রশাসনের উপর দখলদারি বজায় রাখার। জনগণের অর্থে প্রতিপালিত এসব প্রতিষ্ঠানকে তারা এখন জনগণের বিরুদ্ধে লাঠিয়াল রূপে খাড়া করেছে।নিজেদের দাপট টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অনুগত পাইক-পেয়াদা ও চাকর-পালার বিকল্প নেই। সেটি মার্কিনীরা জানে,ফলে মার্কিন অর্থনীতি প্রচন্ড ধ্বস নেমে এলেও পাইক-পেয়াদা ও চাকর-বাকর পালার কাজটি তাদের কাছে আদৌ গুরুত্ব হারায়নি।মিশরের সামরিক বাহিনীকে অর্থদানও তাই বন্ধ হয়নি।এসব চাকর-বাকরগণ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড.মুরসীকে একটি দিনও শান্তির সাথে দেশ পরিচালনার সুযোগ দেয়নি।
স্ট্রাটেজীঃ কইয়ের তেলে কই ভাজা
আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রজেক্ট ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর তারা এখন নতুন স্ট্রাটেজী নিয়েছে। সেটি হলো,“কইয়ের তেলে কই ভাজা”র।কোন মুসলিম জনপদে নিজেদের সৈন্য নামিয়ে তারা তাদের প্রাণনাশ ঘটাতে চায় না। ইতিমধ্যেই নিজেদের প্রচুর প্রাণনাশ হয়েছে ভিয়েতনাম,ইরাক ও আফগানিস্তানে। এখন কৌশল হলো,তাদের পক্ষে যুদ্ধ লড়বার জন্য মুসলিম দেশের অভ্যন্তরে বেতনভোগী তাঁবেদার সেনাবাহিনী,রাজনৈতীক দল,মিডিয়া ও এনজিও বাহিনী গড়ে তোলা।তাদের সে স্ট্রাটেজী কাজও দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে তারা গড়ে তুলেছে নিবীড় পার্টনারশিপ। এসব নতুন ফসলেরা মার্কিনীদের চেয়েও মার্কিনী।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাজ হলো দূর থেকে তাদের আর্থীক,রাজনৈতীক,মিডিয়া ময়দানে সাহায্য দেয়া ও কলকাঠি নাড়ানো। মিশরে ড. মুরসীকে হটানো মধ্য দিয়ে যা ঘটলো তাই হলো এখন তাদের নতুন কৌশলের বাস্তব চিত্র। বাংলাদেশের ন্যায় অন্যান্য দেশেও তারা সে অভিন্ন মডেল নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসনের শুরুতে সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলো তৃতীয় দেশের অভ্যান্তরে নিজেদের আবাদী বা কলোনী স্থাপন করতো। সেখান থেকে সেদেশের অভ্যন্তরে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতো,প্রয়োজনে সামরিক হামলাও করতো। হামলা শেষে নিজেদের সুরক্ষিত দুর্গে তারা ফিরে যেত। দেশের মধ্যে এগুলো ছিল তাদের সার্বভৌম দ্বীপ। তেমনি একটি উদ্দেশ্যেই ইংরেজগণ কলকাতার সন্নিকটে কয়েকটি গ্রাম কিনে সুরক্ষিত কলোনি স্থাপন করেছিল। আর সেখান থেকে সমগ্র বাংলা এবং পরে সমগ্র ভারতে তারা নিজ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এখন সে কৌশলই অভিন্ন রূপে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অভ্যন্তরে বিশেষ করে অধিকাংশ মুসলিম দেশে তারা নিজ ধ্যান-ধারণা ও নিজ সংস্কৃতির প্রটেকটেড কলোনী গড়ে তুলেছে। সেগুলো শুধু তাদের বিশাল বিশাল দূতাবাসগুলি নয়,বরং সেগুলো হলো এনজিও পল্লি,পতিতাপল্লি,সূদী ব্যাংক,নাট্যপাড়া,সেক্যুলার বিচারালয়,সেক্যুলার মিডিয়া ও সেনাবাহিনী। এসব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে জীবন ও জগত নিয়ে তাদের ধ্যানধারণা,বিচারবোধ ও সংস্কৃতি যতটা পাশ্চাত্যবাসীদের কাছাকাছি ততটাই দেশের ইসলামি জনগণ থেকে দূরে।তাদের প্রধান কাজ হলো,জনগণকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কাছাকাছি নেয়া।মিশরের সাধারণ জনগণের নির্বাচনি রায় থেকে সেনাবাহিনীর রায় এজন্যই এতটা ভিন্ন। ইসলামি চেতনাসমৃদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায় মেনে নেয়াটি এজন্যই তাদের কাছে অসম্ভব।সেটি যেমন মিশরে,তেমনি তুরস্ক ও পাকিস্তানসহ বহু মুসলিম দেশে।এসব দেশের কোন ক্যান্টমেন্ট,এনজিও পল্লি বা আদালত পাড়ায় কি ইসলামের কোন মহান মনিষীর পক্ষেও নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব? স্বয়ৎ নবীজী (সাঃ) আবার আবির্ভুত হলেও সেখানে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে কি জিততে পারতেন? তাদের সকল বিরোধীতা তো নবীজী (সাঃ)র শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে।
প্রতিটি মুসলিম দেশ এভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে ইসলামের পক্ষের শক্তি, অপর দিকে বিপক্ষ শক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের এজেন্ডা হলো এ বিভক্তিকে আরো গভীরতর করা এবং সে বিভক্তি থেকে রক্তাত্ব এক অবিরাম যুদ্ধের দিকে ধাবিত করা। পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া,ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে তেমন যুদ্ধ অবিরাম শুরুও হয়ে গেছে। অনেক দেশে এসব সেক্যুলারিস্টদের ঘাড়ে বন্দুক রেখেই তারা এখন মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামের উত্থান রুখতে চায়। এটিকেই তারা বলছে প্রফেসর হান্টিংটনের ভাষায় সিভিলাইজেশনাল ওয়ার তথা সভ্যতার বিরুদ্ধে সভ্যতার যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কোন ভৌগলিক সীমান্ত নেই। তাই ভারতীয় সেনা যেমন বাংলাদেশে এবং মার্কিন,ইংরেজ ও জার্মান সৈনিক যেমন ইরাক ও আফগানিস্তানে গিয়ে লড়ছে তেমনি শ্বেতাঙ্গ মুসলিম নরনারীরা পৌছ যাচ্ছে সিরিয়া, ইয়েমেনসহ মুসলিম দেশে। নবীজী(সাঃ) র সময়ও তো এমনটিই ঘটেছিল। তখন আরব মোজাহিদদের সাথে লড়েছিল ইরানী সালমান (রাঃ) রোমান শোয়ায়েব (রাঃ) এবং আফ্রিকান বেলাল (রাঃ)। প্রতিদেশে এ যুদ্ধের স্ট্রাটেজীও অভিন্ন। তাই বাংলাদেশের শাপলা চত্ত্বরের সেনা বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে হেফাজতে ইসলামের শত শত কর্মীকে নিহত ও আহত করলো,মিশরের সেনা সদস্যরা সেটিই করছে কায়রো,আলেকজান্দ্রা, গিজা ও পোর্ট সাঈদের রাজপথে। একই রূপ আক্রোশ নিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী গুড়িয়ে দিয়েছে ইসলামাবাদের লাল মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসা। এবং নিহত ও আহত করেছে সে মাদ্রাসার শত শত মহিলা ছাত্রীদের।একই মিশন নিয়ে বাংলাদেশ র্যাবের সেনা-সদস্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে ইসলামবিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করছে এবং বন্ধ করছে কোরআনের তাফসির ও গ্রেফতার করছে ইসলামপন্থিদের। এ যুদ্ধে বাংলাদেশের ন্যায় প্রায় মুসলিম দেশে সেক্যুলার মিডিয়া ও সেক্যুলার আদালতও বশে নাই। সেক্যুলার মিডিয়ার কাজ হয়েছে ইসলামপন্থি নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও চরিত্রহনন। আর আদালতের কাজ হয়েছে তাদের ফাঁসীতে ঝুলানো।ম্যাকডোনাল্ড ফাস্টফুডের স্বাদ বিশ্বের সর্বত্র এক ও অভিন্ন।কারণ সেগুলির উপাদান সব দেশেই এক। তেমনি অভিন্ন হলো ইসলামের শত্রুগণও। বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্ট,সোসালিস্ট, ন্যাশনালিস্ট,লিবারাস্টিদের তাই ভারতীয়,মার্কিন বা ইউরোপীদের সাথে মিশে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামায় কোন বিরোধ হয় না।সেটি যেমন একাত্তরে হয়নি,ভবিষ্যতেও হবে না। তেমনি হচ্ছে না মিশরেও। জেনারেল সিসি বা ড.বারাদীরা তাই মার্কিনীদের কাজে গণ্য হয় তাদের আপন বাহিনীর বিশ্বস্থ লোক রূপে।
গণতন্ত্র নিয়ে মিথ্যাচার
গণতন্ত্র নিয়ে সেক্যুলারিস্টদের ধাপ্পাবাজীটা কতটা প্রকট সেটিও এখন প্রকাশ পাচেছ। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তাদের আগ্রহীটি একমাত্র তখনই যখন তাদের বিজয়টি সুনিশ্চিত। নইলে এটিকে তারা আপদ মনে করে। সেটি দেখা গেছে আলজিরিয়া,ইরান, তুরস্ক,ফিলিস্তিন ও সম্প্রতি মিশরে ইসলামপন্থিদের বিজয়ে। মনের খেদে তারা বলতে শুরু করেছে,গণতন্ত্রের অর্থ নির্বাচন নয়।তাদের মতে গণতন্ত্র হলো সকল মতের গ্রহণযোগ্যতা। এবং সকল মতের মধ্যে প্রাধান্য পেতে হবে সেক্যুলার এবং লেবারেল মতটি। সেখানে শরিয়তের কোন স্থান দেয়া যাবে না,যদিও সেটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায় হয়। একেই তারা বলছে প্রকৃত গণতন্ত্র।ড. মহম্মদ মুরসী জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট।মিশরের শাসনতন্ত্রও জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত এবং জনগণের রেফারেন্ডামে বিপুল ভোটে অনুমোদিত। কিন্তু মুরসীর গায়ে এবং নতুন শাসনতন্ত্রে ইসলামের গন্ধ থাকায় তারা সেটিকে মেনে নিতে রাজী হয়নি। সেটিকে তারা বলছে গণতন্ত্র বিরোধী।ড.মুরসীকে বলছে স্বৈরাচারি। এভাবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই তারা পাল্টে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো,গণতন্ত্রের এমন সংজ্ঞা কি পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে? নির্বাচনোর মাধ্যমে শুধু সরকার পরিবর্তনই হয় না,আদর্শেরও পরিবর্তন হয়।পূর্ব জার্মানী,রাশিয়া,পোলান্ড,রোমানিয়া,বুলগেরিয়ার ন্যায় পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো তো বিপ্লব এবং বিপ্লবপরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু সমাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারকেই দাফন করেনি,নিজেদের পছন্দমত রাজনীতিকেও গ্রহণ করেছে। তেমনি মুসলিম দেশে ইসলামপন্থিগণ নির্বাচিত হলে তো সংবিধানে ইসলামের প্রতিফলন হওয়াই স্বাভাবিক। সেটিই তোন গণতন্ত্র। সেটি না মানাই তো স্বৈরাচার। অথচ সেক্যুলারিষ্টগণ সেটি মানতে রাজী নয়।
যে দস্যুতা জনগণের বিরুদ্ধে
সেনা বাহিনী সুস্পষ্ট পক্ষ নিয়েছে সেক্যুলারিজমের রক্ষায়। এবং বন্দক তাক করেছে ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে। যে কোন সভ্য দেশে সামরিক বাহিনীর প্রধানের মূল দায়িত্বটি হলো দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের প্রতি আপোষহীন আনুগত্য। সামরিক বাহিনী তো এভাবে সম্মান দেখায় তাদের বেতনাদাতা জনগণের প্রতি। পোষা কুকুর মনিবের গায়ে কামড় দেয় নয়,বরং প্রাণ দিয়ে প্রতিরক্ষা দেয়। নইলে গাদ্দারি হয়।অথচ সে গাদ্দারিটা করলো সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দুল ফাতাহ সিসি,এবং সেটি নিজের বন্দুকটি প্রেসিডেন্টের দিকে তাক করে ও তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপরারিত করে। যে কোন দেশের আইনে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটিতো দস্যুতা। এবং সে দস্যুতাটি শুধু মুরসীর বিরুদ্ধে নয়,বরং জনগণের বিরুদ্ধে। দস্যুতার শিকার হলো জনগণের বহু বছরের প্রতিক্ষিত গণরায় ও সদ্য প্রণীত শাসনতন্ত্র। কোন বিবেকমান মানুষ কি এমন দস্যুতাকে সমর্থণ করতে পারে? মিশরের রাজপথে আজ যে লাগাতর মিছিল সেটি তো সে দস্যুতার প্রতিবাদ জানাতে।অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের সকল সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থণ সেনাবাহিনীর এ বর্বর দস্যুতার প্রতি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নিজেদের গণতন্ত্রের পালনকর্তা রূপে জাহির করে। কিন্তু এই কি গণতান্ত্রিক রীতি? অথচ গণতন্ত্রের মূল কথাটি হলো,শাসন ক্ষমতায় আসতে হলে সেটি হতে হবে জনগণের ভোটের মাধ্যমে। এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সরানো যাবে একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই। খেলার মাঠেও একটি রুল থাকে। ফুট বল খেলাটি পা দিয়ে খেলতে হয়। সেখানে হাতের ব্যবহার যেমন নিষিদ্ধ,তেমনি নিষিদ্ধ হলো শক্তির প্রয়োগ। তাই বলের গায়ে হাত লাগালে পেনাল্টি হয়।দৈহীক বল প্রয়োগ করলে লাল কার্ড দেখানো হয়। তেমনি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলো একটি নির্বাচিত সরকারকে নির্বাচন ছাড়াই অপসারণ। সে অপরাধই করলো দেশের সামরিক বাহিনী।চোর-ডাকাতদের চুরি-ডাকাতিতে দেশের যে ক্ষতি হয়,এ ক্ষতিটা তার চেয়ে অনেক বড়।কারণ এতে লুন্ঠিত হয় গণরায় এবং দেশ অধিকৃত হয় সেনা হাইজাকারদের হাতে। কোন দেশে এর চেয়ে বড় দস্যূতা আর আছে কি? অথচ মিশরের দেশের আদালতে এ গুরুতর অপরাধটির কোন বিচার হচ্ছে না। ক’দিন আগে সামরিক বাহিনী কায়রোর রাজপথে ১২০ জন ইখওয়ান কর্মীদের যেভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করলো বিচার হচ্ছে না সে হত্যারও। নানা দেশী-বিদেশী মহলের দাবী সত্ত্বেও কোন পুলিশী বা বিচারবিভাগী তদন্ত এখনো শুরু হয়নি। বাংলাদেশে শাপলা চত্ত্বরের বিশাল গণহত্যা যেমন পুলিশের খাতায় অপরাধ রূপে গণ্য হয়নি,তেমনি অপরাধ গণ্য হয়নি ১২০ জন ইখওয়ান কর্মীদের হত্যাকান্ডটিও। কিন্তু গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আদালতে তোলা হচ্ছে ড. মুরসীসহ ইখওয়ানুল মুসলিমীনের তিন শতের বেশী নেতাকর্মীকে।
রাষ্টবিপ্লব কীরূপে?
সামরিক অভ্যুত্থানে দেশ যখন অধিকৃত হয় তখন সেদেশে নির্বাচনে স্বাধীনতা মেলে না।তেমন একটি অবাধ নির্বাচন হুসনি মোবারক ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। তেমনি রাজ-বাদশাহদের হাতে অধিকৃত দেশেও ভোটের মাধ্যমে সে স্বৈরাচারি রাজা-বাদশাহকে সরানো যায় না। ইরানের শাহ সে সুযোগ দেয়নি। রাশিয়ার জারও দেয়নি। তেমনি সৌদি আরবের,কাতার ও কুয়েতের বাদশাহরাও দিবে না। অতীতে ফরাসী বিপ্লব,সোভিয়েত বিপ্লব এবং ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ন্যায় রাজপথের বিপ্লব অনিবার্য হয়েছিল তো সে কারণেই। অথচ গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিবর্তের পথটি ভিন্নতর। সে রাষ্ট্রে রাজপথে মিছিল বা সমাবেশের অধিকার থাকে। অধিকার থাকে হরতালেরও। কিন্তু রাষ্ট-ক্ষমতায় বসার নিয়মটি হলো,সেখানে বসতে হলে নির্বাচন বিজয়ী হয়ে আসতে হয়। সেখান থেকে কাউকে সরাতে হলেও নির্বাচনে পরাজিত করেই সরাতে হয়। ড. মুরসী নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই সেখানে বসেছিলেন। কিন্তু ড. মুরসীকে যেভাবে সরানো হলো সেটি শুধু অবৈধই নয়,ভয়ানক অপরাধও। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেমনি একটি অপরাধকেই সমর্থণ করলো। ড. মুরসী তো নির্বাচনের পথটি তো বন্ধ করেননি। ফলে রাজপথে বিক্ষোভের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে বৈধতা কোথায়? সেনাঅভ্যুত্থানে তো গণরায়ের সুরক্ষা হয় না।তাছাড়া রাজপথের বিক্ষোভ তো সামরিক বাহিনীর পক্ষে রায় নয়।
দোহাই পবিত্র জাতীয় স্বার্থের
মিশরে যা ঘটলো সে এক সুস্পষ্ট সামরিক অভ্যুত্থান। সেটি বুঝার জন্য কি বেশী বিদ্যাবু্দ্ধি লাগে? মিশরের বর্তমান সরকারটি কি ভাবে এবং কাদের ভোটে ক্ষমতায় এলো সেটি কি মার্কিনীরা কি জানে না? কিন্তু মার্কিন প্রশাসন এটিকে সামরিক অভ্যুত্থান বলতে রাজী নয়। সামিরিক বাহিনী শুধু যে প্রেসিডেন্ট মুরসীকে অপসারিত করেছে তা নয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রচিত এবং জনগণের রিফারেন্ডামে বিপুল ভোটে গৃহীত শাসনতন্ত্রকে বাতিল করেছে। ভেঙ্গে দিয়েছে নির্বাচিত পার্লামেন্টকে। এখন শাসনন্ত্র প্রণোয়নের কাজ তারা নিজ হাতে নিয়েছে। কথা হলো,যে সরকারকে জনগণ একটি ভোটও দেয়নি সে সরকারকে সমর্থণই বা করবে কেন? অনির্বাচিত একটি সরকারকে সমর্থণ করলে কি গণতন্ত্র বাঁচে? অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র হত্যার এমন অপরাধকে শুধু সমর্থণই করেনি,বরং ইখওয়ানুল মুসলিমীনের উপর চাপ দিচ্ছে তারাও যেন গণতন্ত্র হত্যার এ কাজকে স
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন