সাপ্তাহিকী
|
এ, কে, এম, মহীউদ্দীন
|
|
আমাদের মুসলিম রাজনীতিবিদদের কাছে কিছু প্রশ্ন
25 Aug, 2013
আমাদের মুসলিম রাজনীতিবিদের কাছে আমার কিছু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। একজন মুসলিম হিসেবে প্রশ্নগুলি জাগে মনে। এদেশের প্রায় নব্বুই ভাগ মানুষই মুসলিম এবং বলতে গেলে নিরানব্বুই ভাগ রাজনীতিবিদই মুসলিম। এসব রাজনীতিবিদদের তো দেখা যায় হজ্জ করতে, ঘনঘন উমরাহ্ করতে, বিভিন্ন ইসলামি দিবস উপলক্ষে বাণী দিতে, ঈদের মাঠে সাধারণ মানুষকে নসিহত করতে এবং মাঝেমাঝে এমনকি ফতোয়াও দিতে। এদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে তাদের প্রভাবই তো প্রায় নিরঙ্কুশ। তাই আমার প্রশ্নগুলিও তাদেরকে ঘিরে। একজন মুসলিম হিসেবে তাদের কাছে কিছু প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই কোন অসঙ্গত বা গর্হিত কাজ নয়।
এক, সত্যই হচ্ছে ইসলামের ভিত্তি। এর সাথে সরাসরি সম্পর্ক আমাদের ইমানের। আল্লাহতা’আলার একটা নামই ‘হক’। দ্বীন ইসলামকেও কুর’আন মাজীদে বলা হছে ‘আল-হক’। মুসলিম হচ্ছে সত্যের সাথী বা অনুগত। ইমানের বিপরিত হচ্ছে ‘কুফর’। ‘কুফর’ হচ্ছে মিথ্যা। মিথ্যাবাদীই ‘কাফির’। কারন সে সত্যকে স্বীকার না করে ও এর প্রতি অনুগত না হয়ে বরং মিথ্যাকেই গ্রহন করে। সত্য বা মিথ্যা এর কোনটির সাথে কার কি সম্পর্ক তার উপরই নির্ভর করে কার ইমান আছে আর কার নেই। অথচ আমাদের মুসলিম রাজনীতিবিদরা দিনরাত কি করে চলেছেন? সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে যাচ্ছেন। মুখ দিয়ে অনর্গল মিথ্যা উদ্গীরন করে চলেছেন। এভাবে তাদের ইমানের কি করুণ হালত হচ্ছে সে ব্যপারে কি তাদের হুশ থাকে? না কি তাদের ইমানের কি দশা হোল না হোল তার কোন পরোয়া করেন না তারা? এর চেয়ে কি ভাল নয় যে পরিস্কার ঘোষণা দিয়ে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে একেবারে মুক্ত হয়ে যা খুশি তাই করা?
দুই, আল্লাহতা’আলা ও তাঁর প্রিয় রসূল মুহাম্মাদ (সঃ) মুসলিমদের বলেছেন মিলেমিশে একত্রিত হয়ে থাকতে, দলে দলে বিভক্ত না হতে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা যে তাদের কথাবার্তা ও কাজকর্ম দিয়ে এদেশের মুসলিম জনগণকে বিভক্ত, পরস্পরের বিরোধী ও সংঘর্ষে লিপ্ত করে দেন তা কি তারা মুসলিম হিসেবে করতে পারেন?
তিন, মুসলিমদের আরও বলা হয়েছে একে অপরের কল্যাণকামী ও সহযোগী হতে। কোন রাজনৈতিক দল কি অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কল্যাণকামী ও সহযোগী হতে পারে? তারা তো একে অপরের প্রতিপক্ষ এবং প্রতিপক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যুদ্ধে লিপ্ত। প্রতিপক্ষের ক্ষতিই তো তাদের কাম্য। প্রতিপক্ষের ক্ষতি হলেই তো লাভ এবং সে জন্য যতো রকম ধোকা, প্রতারনা, অন্যায়, অত্যাচার, হামলা, মামলা করা যায় তা করতেই তো তারা ব্যস্ত। বিভিন্ন দলের মধ্যে যখন কৌশলগত সমঝোতা বা জোট হয় তার মূলেও কাজ করে স্বার্থ, পরস্পরের আন্তরিক কল্যাণকামীতা নয়। মুসলিম হিসেবে এ ব্যাপারে তারা কি ভাবেন?
চার, গীবত করা, অপবাদ দেওয়া, কুৎসা রটনা, ঝগড়াঝাঁটি করা, অমার্জিত ও অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করা ইসলামে জঘন্য অপরাধ। পরকালে এসবের শাস্তি অকল্পনীয়ভাবে ভয়াবহ। মুসলিমদের তো বলা হয়েছে এক ভাই যেন আরেক ভাইয়ের দোষ গোপন করে। আমাদের রাজনীতিবিদরা কি ইসলামের এসব কথা জানেন না? জানলেও তারা বাস্তবে কি করেন? ইসলামের এসব নির্দেশকে তারা কি নির্দ্বিধায় প্রতিমুহূর্তে পায়ে মাড়িয়ে চলেন না? এসব জঘন্য জিনিস কিভাবে তাদের কাছে এতো মহামূল্যবান রাজনৈতিক পুঁজি হয়ে উঠল? মুসলিম হিসেবে তাদের কি একবারও ভয়ে বুক কাপে না?
পাচ, একজন মুসলিম অপর যেকোন মুসলিমের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষাকারী। ইমানদারের জন্য এটা একটা আমানত। যত্নের সাথে তা সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। কোন মুসলিম কারো ন্যায়সঙ্গত স্বাধীনতা ও অধিকার হরণকারী হতে পারেনা। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন ও আন্দোলন করার নামে যখন মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করা হয়, মানুষের জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করা হয়, মানুষের উপর বলাৎকার করা হয়, মানুষকে পেরেশান করা হয় ও মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হয়, তখন এই অতি গুরুত্বপূর্ণ আমানতদারীর কি হয়?
ছয়, খুন, জখম, গুম, অপহরণ, জ্বালাও, পোড়াও, ভাংচুর, মানুষের জানমাল, ইজ্জত ও আব্রুর উপর হামলা এসব ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামে এসবের শাস্তি এই দুনিয়াতেও যেমন কঠিন, আখিরাতেও তেমনি ভয়াবহ। কিন্তু আমদের মুসলিম রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে এসবের কোন জিনিষটি প্রতিদিনই ঘটছে না? সরাসরি নিজের হাতে না করলেও অনুসারীদের মাধ্যমে হচ্ছে। তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের এসব গর্হিত কাজের ফায়দা নেওয়া হচ্ছে। অতএব নেতা ও কর্মী কেউই দায় থেকে মুক্ত নন। বরং নেতারাই নটের গুরু হিসেবে বেশি দায়ী। মুসলিম হিসেবে কিভাবে তারা এসবকে তাদের জন্য হালাল করে নিতে পারলেন?
সাত, আল্লাহতা’আলা একজন মুসলিমকে সর্বাবস্থায় সুবিচারকারি হতে বলেছেন। কুর’আন মাজীদে এ ব্যপারে অনেক নির্দেশ ও সতর্কবাণী আছে। রসুলুল্লাহ (সঃ )-এর হাদিসে তো আরো বেশি কথা আছে। সুরা আল-নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে বিচার করতে গিয়ে তা যদি নিজের, পিতামাতার, আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জন, ধনী বা প্রভাবশালীর বিরুদ্ধেও যায় তাও সুবিচার থেকে একচুল নড়চড় করা যাবেনা, সাক্ষ্য গোপন করা যাবে না, ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলে বক্তব্যকে বিকৃত বা ঘোলাটে করে ফেলা যাবে না। বিচার মানে তো শুধু আইন ও আদালতের বিচার নয়। সমস্ত জীবনের সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে বিচারের পরিব্যাপ্তি। এবং কথা একটাই। সব ব্যাপারেই সুবিচার ইসলামের অন্যতম দাবি। এই আলোকে দেখলে আমাদের রাজনীতিবিদদের চেহারাটা কেমন দেখা যায়? সুবিচার যদি উত্তর মেরুতে থাকে তারা থাকেন দক্ষিণ মেরুতে। তাদের কাছে তো একমাত্র নিজের বা দলের সুবিধাটাই সুবিচার। তাহলে আল্লাহতা’আলা ও প্রিয় রসুল (সঃ) যে সুবিচার সম্মন্ধে এতো কথা বলেছেন সেসবের কি দশা হোল?
আট, নিজের সুকীর্তির কথা প্রচার করে বেড়ানো যে কোন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে একান্ত লজ্জাজনক ও আল্লাহতা’আলার কাছে অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ। আত্মবন্দনা তো একধরনের আত্মপুজা। আর আত্মপুজা শিরকেরই খুবই কাছাকাছি। কি ভয়ংকর ব্যপার! অথচ আমাদের মুসলিম রাজনিতিবিদরা তো দিনরাত গলা ফাটিয়ে আল্লাহতা’আলার দৃষ্টিতে এই জঘন্য কাজটিই প্রতিযোগিতা করে করেই চলেছেন। তারা কি ভাবেন আল্লাহতা’আলা কিছু দেখছেনও না, শুনছেনও না বা তাঁর কাছেও তা মধুর লাগছে?
নয়, ‘হায়া’ (লজ্জাশরম বোধ ) ইমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রসুলুল্লাহ (সঃ ) বলেছেন, ‘তোমার যদি লজ্জা না থাকে, তুমি যা ইচ্ছা করতে পার’। অর্থাৎ বেহেয়ার অন্যায়, অপকর্ম ও অধঃপতনের কোন বাধবাধন থাকেনা। আমাদের রাজনীতিবিদদের লজ্জাশরমের অবস্থাটা কি? তাদের তো দেখা যায় দিনরাত অন্যায় ও অপকর্ম করেও তারা বুক ফুলিয়ে চলছেন এবং মোটা গলায় কথা বলছেন। নানা অজুহাত ও যুক্তি খাড়া করে নিজের কুকীর্তির সমর্থনে কথা বলছে। হাতেনাতে ধরা পড়েও তারা লজ্জিত হওয়া দূরের কথা সামান্য বিব্রতও হন না। লজ্জাশরম কি জিনিষ তা যেন তারা জানেইনা। রসুলুল্লাহ (সঃ ) কথা অনুযায়ী তাদের অবস্থা তাহলে কি?
দশ, ‘তাওবা’ মুসলিমের জীবনের সাথী। তার বড়ো গুণ হচ্ছে সে উত্তম তাওবাকারি। দিনরাত সে তাওবা করতে থাকে তার জানা ও অজানা ভুলত্রুটি, অন্যায় ও অপরাধের জন্য। সে কখনও দাবী করেনা যে তার সবকিছুই ঠিক হচ্ছে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবটা হোল তারা কখনও ভুল করেন না, অন্যায় বা অপরাধ করেন না। হাতেনাতে ধরা পড়লেও কতো রকম উদ্ভট ও হাস্যস্কর কথা বলে সাফাই গাইতে থাকেন। একটাই কথা এদের প্রত্যেকের যে তিনি যাবতীয় ভুলত্রুটি, অন্যায় ও অপরাধের ঊর্ধ্বে। অথচ আমরা জানি নবী ও রসুল (সঃ )-দেরও অনিচ্ছাকৃত ছোটখাট ভুলত্রুটি হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই রাজনীতিবিদরা যেন জ্ঞানে ও পবিত্রতায় আল্লাহতা’লার সেই সব অতি প্রিয় বান্দাদেরও ছাড়িয়ে গেছেন (নাউজুবিল্লাহ )। ভুল স্বীকার করার ও অনুতপ্ত হবার বদলে দম্ভের সাথে ভুলকে শুদ্ধ বলে দেখাবার মনোবৃত্তি এভাবে যাদের অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায় তারা কি মৃত্যুর আগে তাওবা করার সুযোগ আশা করতে পারে? না কি তাওবা করে মরবার কোন প্রয়োজন তাদের নেই? রাজনীতিবিদ হিসেবে আল্লাহতা’আলার সাথে তারা কি আগে থেকেই সবরকম দায়মুক্তির কোন বিশেষ বন্দোবস্ত করে রেখেছেন?
প্রশ্ন আরো অনেক করা যায়। কিন্তু এগুলিও একেবারে কম নয়।
এসব প্রশ্নের জবাব আমাদের কোন রাজনীতিবিদ যে দয়া করে দেবেন এমন দুরাশা আমার নেই। তাদের কেউ যে এ লেখা পড়ে দেখবেন এমন ভরসাও আমার তেমন একটা নেই। দু’একজন পাঠক হয়তো কষ্ট করে পড়ে দেখতে পারেন এতটুকুই কেবল আমি আশা করতে পারি। এদের মধ্য হতে কেউ কেউ হয়তো এসব বিষয় নিয়ে একটু ভাবতেও শুরু করতে পারেন এটাই আমার ভরসা। আল্লাহু আলীম ( আল্লাহই ভাল জানেন। )।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন