সৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ ও বিশ্বকে জানার জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণের পিপাসা মানুষের চিরন্তন শখ। এই শখ বা নেশাকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। দেখা গেছে, পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনীতির নাড়ির স্পন্দনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটনকে কেন্দ্র করে। এমন উদাহরণ হাতের কাছেই আছে। বলা যেতে পারে মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, ভারত ও সিঙ্গাপুরের কথা। অনুসন্ধানে জানা গেছেÑ মালয়েশিয়ায় পর্যটন খাতের বার্ষিক অবদান প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার। বিশ্ব পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকায় মালয়েশিয়া নবম স্থানে। মালয়েশিয়া তাদের সৃষ্ট বিভিন্ন পর্যটন স্পট তৈরি করে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরও তাদের পর্যটন শিল্পকে সাজিয়েছে আকর্ষণীয়ভাবে।
বাংলাদেশের পর্যটন স্পটের মাঝে বৈচিত্র্য রয়েছে। কিন্তু সংরক্ষণ, পরিচর্যা আর প্রচারণার অভাবে এর অনেক কিছ্ইু পর্যটকদের রয়ে গেছে অজানা। নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের একটি প্রধান শিল্প হিসেবে পর্যটন দ্রুত বিকশিত হয়েছে। নেপালের মোট জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশ আসে পর্যটন শিল্প থেকে। নেপালের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হচ্ছে হিমালয়। ভারতে আছে প্রচুর ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান। আমাদের বাংলাদেশেও এ শিল্পের সম্ভাবনা অফুরন্ত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। এ দেশের নদ-নদী, সবুজ-শ্যামল মাঠ, ফসলের ক্ষেত, ছায়াঢাকা গ্রাম, শান বাঁধানো পুকুর, গ্রামবাংলার মানুষের সহজ-সরল জীবনÑ বিশ্বের যে কোনো মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করে। তাই অভিজ্ঞ পর্যটকদের অভিমত, যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে শুধু পর্যটন শিল্প থেকেই বছরে হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে বাংলাদেশ।
বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটি লাভজনক এবং অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং বহুমুখী কর্মসংস্থান সহায়ক বড় শিল্প খাত। আমরা জানি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত হওয়ার পেছনে রয়েছে পর্যটন শিল্পের প্রসার। ইউরোপের অনেক দেশ পর্যটনের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পরোক্ষভাবে এই খাতে প্রায় ৮০ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। জানা গেছে, ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা প্রতি বছর থাকা, খাওয়া, ভ্রমণ, দর্শন এবং কেনাকাটা বাবদ খরচ করেন প্রায় ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তথ্য অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৮৩ ভাগ দেশের সবচেয়ে জাতীয় আয় আহরণকারী প্রথম পাঁচটি খাতের মধ্যে একটি বিশেষ খাত পর্যটন। বিশ্বের প্রতি ১১ জন কর্মজীবীর মধ্যে একজন সরাসরি পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বিশ্বট্যুরিস্ট অথরিটির তথ্যমতে, ১৯৫০ সালে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ। প্রায় ৫৫ বছর পর ২০০৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ কোটি ৮০ লাখে। প্রতিবছর এ খাতে বিশ্বে প্রায় ৬৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পর্যটকরা এখন পুরাকীর্তি, বাংলো, বাগান, পাহাড়, সাগর, ঝর্ণার পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছে। প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের বিচিত্র জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিও পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ছে।
বিশ্বের বেশ কিছু দেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন খাত। বাংলাদেশেও এ শিল্পের সম্ভাবনা অফুরন্ত। অনেক দেশের মতো বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান খাত পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে বাংলাদেশও কাজে লাগাতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের মতো ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাদের আছে মনোরম পাহাড়, আছে নদী, আছে দিগন্ত বিস্তৃত ভাটি-বাংলার হাওর, সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ তো আছেই। আছে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ময়নামতি বিহার, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের চা বাগান আর আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনধারা। এছাড়াও আছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, মাধবকু-ের জলপ্রপাত, ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প, রেশম শিল্প, খাদি শিল্প, জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁত, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান, বাংলার বিচিত্র পেশা, ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ভাস্কর্য ও স্থাপনা, চিরসুন্দর গ্রামীণ জনপদ, হাটবাজার, মেলা-কৃষ্টি-কালচার, কৃষক-কৃষাণির সংগ্রামী জীবন, ঋতুবরণ ঐতিহ্য, বাংলা নববর্ষের উৎসবÑ এসব কিছুই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের হাকালুকি হাওর এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি হিসেবে স্বীকৃত। এই হাওর পরিবেশবান্ধব পর্যটনের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এছাড়াও আছেÑ টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর, ডিঙ্গাপুতা হাওরসহ দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের সমাহার। এসব হাওরে শীতকালের প্রকৃতির নীরবতার নিরুপম সৌন্দর্য খুবই মন টানে। শীতে অতিথি ও দেশীয় পাখিদের কলরব এক অপার সৌন্দর্যের দৃশ্যপট দেখলে মন হারিয়ে যাবে। বর্ষায় জল থই থই আর উচ্ছল ঢেউয়ের অশান্ত মাতামাতি ভ্রমণপিপাসুদের হৃদয় মাতিয়ে তোলে। বর্ষার জলে টইটম্বুর হাওরে চাঁদনি রাতের অপরূপ দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও মিলবে না। সেই তিলোত্তমা, অপরূপা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ কেন হবে না! আর ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানেরও তো অভাব নেই বাংলাদেশে। তাই পর্যটন বিশ্লেষকদের মতে, আমাদের দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঠিকমতো ও পরিকল্পিতভাবে করতে পারলে সুইজারল্যান্ড, পাতোয়া, ব্যাংককের মতো ট্যুরিজম এখানেও গড়ে উঠতে পারে।
দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রচারণা ও উদ্যোগ। সেই সঙ্গে পর্যটনকে একটি বিশেষ শিল্প খাত হিসেবে গুরুত্বারোপ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে তিন লক্ষাধিক পর্যটক সুন্দরবন, কক্সবাজারসহ পর্যটন স্পটগুলোতে ভ্রমণ করে। বাংলাদেশের সুন্দরবন, কক্সবাজার, কুয়াকাটার পাশাপাশি প্রকৃতির অসাধারণ উপহারগুলোর যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে খুলে যাবে সম্ভাবনার দ্বার। বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আরও আছেÑ তিন পার্বত্য জেলা, নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া, সোনাদিয়া, পতেঙ্গা, মৌলভীবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের ফয়’স লেক, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ইতিহাস-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ অনেক স্থান, যেমন পাহাড়পুর বিহার, শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, রানী ভবানীর কীর্তি, বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গির্জা। আরও আছে ময়নামতি, রামসাগর, সোনারগাঁ, নাটোর, রাজবাড়ি, দীঘাপতিয়া জমিদার বাড়ি, তাজহাট জমিদার বাড়ি, কক্সবাজারের বৌদ্ধ মন্দির, ঢাকার লালবাগ দুর্গ, আহসান মঞ্জিল, গৌড় লক্ষণাবতী শহর, বাগেরহাটের অযোধ্যা মঠ ইত্যাদি। এসব স্থান ভ্রমণপিপাসু বিশ্ববাসীর কাছে আকর্ষণীয় এবং তাদের অবকাশ কাটানোর উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে।
জেনেভাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০০৭ সালের জন্য ভ্রমণ ও পর্যটন সূচকে ১২৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। নীতি, নিয়ম, নিরাপত্তা, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি ধরনের ১৩টি মানদ-ের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় এই সূচক। পর্যটনে বাংলাদেশের অবস্থা আন্তর্জাতিক বিচারে নিম্নমানের, এ কথা সত্য। তবে এও সত্য যে, প্রাকৃতিক সম্পদ, কর সুবিধা, এ শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ, ভ্রমণ খরচ, জ্বালানি তেলের দাম এসব বিবেচনায় বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশ এগিয়ে আছে। তারপরও রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, পরিবহন ধর্মঘট ইত্যাদি দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত।
২০০৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল হওয়ায় পশ্চিমা ভ্রমণবিলাসীদের কাছে ইন্দোনেশিয়ার অবকাশ কেন্দ্র বালি অথবা থাইল্যান্ডের চমৎকার বিকল্প হতে পারে বাংলাদেশ। পর্যটন শিল্প সম্পর্কে অভিজ্ঞদের মতে, আধুনিক ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে কক্সবাজারকে গড়ে তোলা হলে পর্যটকের সংখ্যা, বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অন্তত বাড়বে দশগুণ। ফলে রাজস্ব আয় দাঁড়াবে ন্যূনতম ২০ হাজার কোটি টাকা। দেশের সম্ভ¢াবনাময় পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ করতে চায় মালয়েশিয়া ও জাপান। বিনিয়োগের জন্য তারা বেছে নিয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে। কক্সবাজারের বিভিন্ন লোকেশনে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে মালয়েশিয়া ও জাপানের ব্যবসায়ীরা। কক্সবাজারে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে বিশ্বমানের ফাইভ স্টার হোটেল সি প্যালেস। একই ধারায় গড়ে ওঠে হোটেল সি গাল, প্রাসাদ প্যারাডাইস, প্রবাল, উপল, শৈবাল প্রভৃতি নামধারী আধুনিক হোটেল। সি বিচকে আরও আধুনিক নিরাপত্তায় বেষ্টিত করে পর্যটকদের ভ্রমণ সুবিধা বাড়িয়ে, সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালে কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পাল্টে দিতে পারে পর্যটন শিল্পের চেহারা। সিলেটের খাদিম নগর রিসোর্ট বিশ্ব ট্যুরিজম স্পট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এগুলো আমাদের সাফল্য ও সম্ভাবনার নমুনামাত্র।
পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সরকারেরও আছে নতুন পরিকল্পনা। সরকার এরই মধ্যে সারা দেশে ৮ হাজার পর্যটন স্পট নির্ধারণ করেছে। আগামী ১০ বছরে তিন ধাপে স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর, পার্বত্য জেলাসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের সমন্বয়ে পর্যটন স্পটগুলোকে আধুনিক ও আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হবে। টার্গেট বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ২০১৪ সাল নাগাদ পর্যটন শিল্প থেকে আয় হতে পারে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা টেকনাফ নিয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার। টেকনাফে পর্যটকদের জন্য অপার সৌন্দর্যের সমুদ্র সৈকত ছাড়াও রয়েছে নাফ নদীর পাড় দিয়ে পাহাড়ের অপরূপ রূপ দেখার সুযোগ। টেকনাফকে নিয়ে নতুন যে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রিপারেশন অব ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান অব কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি বিচ আপ টু টেকনাফ।’ যারা কক্সবাজারে বিনিয়োগ করছেন হোটেল-মোটেলসহ নানা প্রতিষ্ঠানে, তারা সরকারের সহযোগিতা পেলে টেকনাফেও গড়ে তুলতে পারেন অত্যাধুনিক মানের হোটেল-মোটেল। পরিকল্পিত উপায়ে সেখানে হোটেল-মোটেল জোন গড়ে তোলা সম্ভব হলে এ খাতে আয়ও বাড়বে। সেই সঙ্গে তারা টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনেও যেতে পারবেন। তখন সেন্টমার্টিনেও আরও পর্যটক বাড়বে।
বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো দেশের রাজধানী থেকে অনেক দূরে হওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রেল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। রেলে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হলে কম খরচ ও সময় সাশ্রয় হবে। দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটারের রেললাইন খুলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির স্বর্ণদ্বার। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়ালে পাল্টে যাবে অর্থনীতির চেহারা।
পর্যটনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের সঙ্গে অসংখ্য মানুষ জড়িত। এটি দারিদ্র্য বিমোচনেরও একটি বড় খাত। পর্যটন একটি বহুমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টির শিল্প খাত। বিদেশি পর্যটকরা এখানে এসে যেমন কেনাকাটা করেন, তেমনি থাকা-খাওয়া এবং যাতায়াতের জন্যও তাদের ব্যয় করতে হয়। ফলে নানা পেশার মানুষ পর্যটকদের সুবাদে আয় করার সুযোগ পায়। আমাদের দেশ উন্নয়নশীল দেশ। বেকারের আধিক্যও বেশি। সুতরাং পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে বেকারদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন সহায়ক হবে। পর্যটনকে বাণিজ্যিকভাবে গ্রহণ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা দিলে পর্যটকরা অধিক হারে আকৃষ্ট হতে পারে।
দেশের আনাচে-কানাচে অরক্ষিত, ঐতিহ্যম-িত, দর্শনীয় স্থানগুলো সুরক্ষিত করার উদ্যোগ নিলে স্থানীয়ভাবে বহু লোকের নতুন নতুন কর্মসংস্থান ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। শুধু বিদেশি পর্যটকদের নির্ভরতায় না থেকে ‘দেশকে চিনুন, দেশকে জানুন’; ‘ঘুরে দেখি বাংলাদেশ’Ñ এরকম দেশাত্মবোধক সেøাগানে দেশের মানুষকে দেশ দেখানোর লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার। প্রয়োজন স্কুল ক্যাম্পেইন এবং তরুণ প্রজন্মদের ভ্রমণে আগ্রহী করে তোলা। দরকার পর্যটন এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ট্যুরিস্ট পুলিশ ব্যবস্থা কার্যকর করা দরকার। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বছরে একবার শিক্ষা সফরের আয়োজন বাধ্যতামূলক করা দরকার। নৌ ভ্রমণ হতে পারে পর্যটনের আরেক পদক্ষেপ। নতুন প্রজন্ম দেশের নদীগুলো চিনবে এবং ইতিহাস জানবে। বর্ষা এবং শুকনো মৌসুমে দুই বিপরীত রূপের হাওর দর্শন হতে পারে পর্যটনের নতুন আকর্ষণ। শহরে জন্ম ও শহরে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে গ্রামের সঙ্গে পরিচিত করে তোলাটাও হতে পারে পর্যটনের নতুন ক্ষেত্র। এ প্রজন্মের অনেকে গাছ চেনে না, মাছ চেনে না। কালবোশেখি ঝড় কী জিনিস বোঝে না। ঝড়ে আম কুড়ানোর স্বাদ পায় না। সাঁতার জানে না। প্রকৃতি-পরিবেশ এবং গ্রামবাংলার সঙ্গে এই প্রজন্মের বিরাট ব্যবধান। কৃষি, কৃষক এবং গ্রামের মানুষের সরল জীবন দর্শন হতে পারে অভ্যন্তরীণ পর্যটনের উৎস।
পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দ্রুত বিকাশমান শিল্প। বিশ্বের কয়েকটি দেশ একমাত্র পর্যটনকে অবলম্ব^ন করেই সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল। তবে মনে রাখতে হবে, শুধু দর্শনীয় স্থানের ওপর ভিত্তি করেই পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠে না। পর্যটনের জন্য প্রয়োজন দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি অনুকূল সামাজিক পরিবেশ ও অবকাঠামোগত পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও শুধু প্রকৃতির দানের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে এর সুফল পাওয়া যাবে না। পরিকল্পনা মতো মানুষের সৃজনশীলতায় সৃষ্ট স্থাপনা ও অবকাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক পর্যটন অবকাঠামো আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে পৌঁছতে এখনও অনেক পথ বাকি। সুতরাং সরকারকে এ সম্ভাবনাময় শিল্প ব্যবস্থাপনার কথা গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অধিক সুবিধা দিয়ে এ শিল্পে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ দেশের প্রতিষ্ঠান বেশি হলে আমাদের লাভ বেশি হবে। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে এই পর্যটন শিল্পকে কাজে লাগাতে পারলে একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং বহুমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
এস এম মুকুল : কলাম লেখক ও উন্নয়ন গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন