সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
রানা প্লাযা ট্রাজেডিঃ যে গল্পের শেষ নাই
05 Aug, 2013
পঞ্চাশোর্ধ বিল্লাল মিঞা তার মেয়েকে হারিয়েছেন রানা প্লাযা দুর্ঘটনায়। মেয়ের লাশের খোজও পাননি, ডিএনএ টেস্ট করিয়ে এখন অপেক্ষার পালা।সরকারী টাকা নিতে দুইবার গিয়েছেন ঢাকায়, এখনও সে টাকা পাননি। যে মেয়েটি মারা গিয়েছে সেই ধরে রেখেছিল সংসারের হাল, সংসারে আরেকটি মেয়ে আছে তার যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি এবং স্বামী পরিত্যাক্তা। সেই প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে এই বুড়ো বয়সে আবার সংসারের হাল ধরতে যেয়ে এখন হাবুডুবু খাচ্ছেন। কোন ছেলে সন্তান নাই, আরো তিন মেয়ে, তারা নিজ সংসারে স্থায়ী, স্বামীরা কেউ রিক্সা চালায় কেউ বা হকার, এরকম নিম্ন আয়ের পেশায় জড়িত।
এখন কি করবেন জানতে চাইলে চোখেমুখে হতাশা প্রকাশ করলেন। অনেক আগে তিনি কাঠ মিস্ত্রীর কাজ করতেন কিন্ত সে পেশার ফিরবার মতো শারীরিক অবস্থা নেই। একটা দুধের গাভী পেলে হয়ত সংসারে দুটো ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হতো।
এবার বলি বুলবুলের কথা। পচিশ বছরের টগবগে যুবক আজ ক্রাচে ভর দিয়ে হাটেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় উদ্ধার হন তিনি, তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের একটা ক্লিনিকে। কোমর-পায়ের হাড়ে অনেকগুলি হাড়ে ফাটল। পরদিন আত্মীয়রা তাকে নিজেদের দ্বায়িত্বে বংগবন্ধু মেডিকেলে নিয়ে যান। সেখানে বেশ কিছু দিন চিকিতসা নিয়ে ফিরে আসেন বাসায়। অন্তত ছয়মাস রেস্টে থাকতে হবে, এরপরো ভারী কাজ করতে পারবেন না কোন দিন। ঘটনার মাসের বেতন পেয়েছিলেন আর বিকাশ করে তার একাউন্টে ১৫ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে (এটা সম্ভবত বিজিএমইএ র দেয়া সাহায্য, আহাত রা দেখলা সবাই এটা পেয়েছেন)। সাহায্য বলতে এতটুকুই। উনি বংগবন্ধু মেডিকেলে চিকিতসাধীন থাকায় বেসরকারী উদ্যোগে যে সব সাহায্য আহতদের দেয়া হয়েছিল (সিআরপি, পংগু হাসপাতাল কিম্বা এনাম মেডিকেলে) তা উনার কাছে পৌছেনি। এখন চাকরি নেই, বেতন নেই, সংসার কিভাবে চলছে খোজ নেবার কেউ নাই। বিবাহিত বুলবুল এখানে নিজ সংসার চালিয়ে বাগেরহাটে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়মিত সাহায্য করতেন।
কি করবেন জানতে চাইলে বলেন আমি তো কোন ভারী কাজ করতে পারব না। একটা মুদী দোকান দিতে পারলে, হয়ত জীবন টা চালিয়ে নিতে পারতাম!
জেসমিনের গল্পটা শুনুন এবার। রানা প্লাযার নিউ ওয়েব গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। বাবা হকারি করে ফুচকা বিক্রি করে। ছোট দুটি বোন স্কুলে পড়ে একজন ক্লাস এইটে, অন্যজন ক্লাস ফোরে। বাবা আর তার আয় মিলে চলত সংসার। ঘটনার পর দুপুরের দিকে নিজের চেষ্টাতেই বের হয়ে আসেন তিনি, কোমরে ব্যথা পাওয়ায় চিকিতসা নেন এনাম হাসপাতাল সহ একাধিক জায়গায়। এখন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। সব মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকার মত সাহায্য পেয়েছিলেন। এখন চাকরি নাই। একটা এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন দুর্ঘটনার কয়েকমাস আগে, পারিবারিক প্রয়োজনে, মাসে ৫ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়, বছরের অর্ধেকের বেশী কিস্তি এখনও বাকী। প্রতিদিনের সংসার কিভাবে চলবে তারই নাই ঠিক সাথে মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে আছে কিস্তি দেবার চাপ।
বোনটার জেএসসি দেয়া হয়ে গেলে দেশের বাড়ি (ধামরাই) চলে যাবেন। আর একটা সেলাই মেশিন কিনে বাসায় কাজ করেই সংসার চালাবেন। গার্মেন্টস মানেই তার কাছে এখন আতংক, আর ও পথ মাড়াতে চান না। বোনদের পড়াশুনা হোক সেটাও আবার মনে প্রাণে চান। কিন্তু কিভাবে দাঁড়াবেন নিজের পায়ে যদি কারো সাহায্য না পান? সে প্রশ্নের অবশ্য কোন উত্তর তার এখনো জানা নেই।
সাবিনার মা আয়ার চাকরি করে সিআরপি তে, আর তিনি কাজ নিয়ে নিয়েছিলেন রানা প্লাযার কোন এক গার্মেন্টসে। বড় ভাই আলাদা হয়ে গিয়েছে, রিক্সা চালায়। বাবাও রিক্সা চালায়। ছোট একটা ভাই আছে যে ক্লাস ফোরে পড়ে। রানা প্লাযা ধসে আহত হন তিনি, বর্তমানে সেরে উঠেছেন। সিআরপি তে প্রশিক্ষন নিচ্ছেন টেইলারিং এর উপর। প্রশিক্ষন শেষে একটি টেইলারিং দোকান দিতে চান। আর চাকরি নয়, এবার নিজেই উদ্যোক্তা হতে চান তিনি। অবশ্য জানেন না প্রয়োজনীয় পুজি জোগাড় করতে পারবেন কিনা।
রহিমার গল্প এদের সবার চেয়েই করুণ! উদ্ধার হয়েছেন ঘটনার দিন রাতে, পুরো ভারী একটা দেয়াল চাপা দিয়ে রেখেছিল শরীরের একপাশ। মাথা-কোমর আর পায়ে এখনো ব্যাথা, এখনো কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না। সিআরপি ভর্তি ছিলেন, এখন বাসায় থাকেন আর নিয়ম মত এসে থেরাপী নিচ্ছেন। ভালো হতে আরো কয়েক মাস লেগে যেতে পারে, তবুও পুরোপুরি ভালো হবেন তার নিশ্চয়তা নাই। চিকিতসার পাশাপাশি সিআরপিতে মুদি দোকান চালানোর প্রশিক্ষন নিচ্ছেন।
রাহিমার আর্ত চোখের চাহনি হয়ত আপনার মন কে নাড়া না দিয়ে পারবে না। কত বছর হবে বয়স? ১৫-১৬? হয়ত তার বয়সী আমার-আপনার মেয়ে/বোনটি তারুণ্যের উচ্ছলতায় মাতিয়ে রেখেছেন তার চারপাশ। কিন্তু বাবাকে হারিয়ে বড় মেয়ে হবার সুবাদে এই বয়সেই তিনি ধরেছিলেন সংসারের হাল। দশ ও পাচ বছর বয়সী দুই ছোট ভাই, মা নিজেও খুব একটা সুস্থ নয়। এখন এক মামা দেখা শোনা করে কিন্তু রিক্সা চালানো যার পেশা, সে মামার সামর্থ্যই বা কতটুকু? তবুও ভাল তিনি এই দুর্দিনে তাদের দূরে ঠেলে দেন নি। অভাবের তাড়নায় ছোট ভাইটিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন নানীর কাছে, গ্রামের বাড়িতে।
সিআরপিতে তাকে চিকিতসার খরচ দিতে হয় না। এবং চিকিতসা শেষে সিআরপি যাদের পুনর্বাসণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সেই তালিকায় আছেন রহিমা। হয়ত কাজের উপযোগী হলে সিআরপি তার পুজি যোগান দিবে। কিন্তু বিপদ যে পিছু ছাড়ছে না। আগামী দুই-তিন মাস কিম্বা তার চেয়েও বেশী যদি লাগে তার দোকান শুরু করতে, সে পর্যন্ত পরিবারের ভরণ-পোষনের কি হবে? তার উপর মা অসুস্থ, ডাক্তার বলেছে অপারেশন করাতে হবে দ্রুত, চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হবে। সব মিলিয়ে চোখে আন্ধার দেখছেন রহিমা।
এই গল্পের কোণ শেষ নেই। এট বড় মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেছে, আর ভিক্টিম সবাই হতদরিদ্র, মেডিয়ার ফলো আপ প্রায় শেষ। আমরাও ক্রমে ভুলে যাচ্ছি এদের কথা। এই লিখার কোন উপসংহার লাগার কথা নয়। তবুও দুটো কথা।
রানা প্লাযা দুর্ঘটনায় কয়েকজন আহতদের পুনর্বাসন করার জন্য ছোট্ট একটা ফান্ড তোলা হয় বন্ধুদের মাঝ থেকে। সে কাজটি শেষ করতে গিয়ে, স্থানীয় একটি ভলান্টিয়ার গ্রুপের সাহায্য নিয়ে এদের সাথে যোগাযোগ। রানা প্লাযা ভিক্টিমদের সাহায্যার্থে প্রচুর ফান্ড উঠেছে সরকারী এবং বেসরকারী ভাবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা এই ফান্ডের কতটুকু কিভাবে পাচ্ছে তার কোন হিসাব আছে কিনা জানিনা। অনেকেই সাহায্য পেয়েছেন সেটা যেমন সত্য, তেমনি সত্যি যে অনেকেই তেমন উল্লেখযোগ্য সাহায্য পান নি। বিশেষভাবে যারা অল্প কিছুদিন চিকিতসা নিয়ে বাসায় বিশ্রামে থাকতে হচ্ছে তাদের অবস্থা সবচে করুণ। এখন চাকরি নাই, বেতন নাই, কবে চাকরিতে যেতে পারবেন তার ঠিক নাই। অনেকেই হয়ত গার্মেন্টসে চাকরি করবার মত শারীরিক সামর্থ থাকবেনা/নাই, অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তারা আর গার্মেন্টসে ফিরতে পারবেন না। নিজে অন্য কিছু করবার মত পুজির যোগাড় হয়ত অনেকেই করতে পারছেন না।
সরকারী কোষাগারে এখনো নাকি প্রচুর ফান্ড আছে। এক অসমর্থিত সুত্রে জানলাম ১২০ কোটি টাকার বেশী জমা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে, আর বিতরন হয়েছে মাত্র ১৭ কোটি টাকা। এখনো যারা সাহায্য পাননি, বিজিএমইএ এবং সরকার যৌথভাবে আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার কে পুনর্বাসন করা সম্ভব। আশাকরি এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পর যারা আজ বিপর্যস্ত জীবন যাপন করছে, তারা যেন বঞ্চিত না হয়। যারা কাজ করছেন তারা দ্রুত ও স্বচ্ছতার সাথে কাজ শেষ করবেন, এটাই প্রত্যাশা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন