গত ১৯ জুলাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। অন্য কোন সময় স্মরণ করি বা না করি খ্যাতিমান ব্যক্তিদের মৃত্যুর পর তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে আমরা স্মরণ করি এবং নিজেদের পান্ডিত্য জাহির করি। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু বার্ষিকীতেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। হুমায়ূন আহমেদের লক্ষ লক্ষ ভক্ত পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে ছিল প্রিয় হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নতুন কোন উপাদান যদি পেয়ে যান এবং আজকের দিনে হুমায়ূনকে কে কিভাবে মূল্যায়ন করে তা জানার জন্য। অনেকের বিশ্বাস এখনো অনেক অজানা কাহিনী আছে যা তারা জানেনা। পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানকে স্মরণ করে বিদেহী আত্মার মঙ্গল কামনাও আরেকটি কারণ ছিল।
সেদিন বহু লেখা পাঠকেরা বিভিন্ন পত্রিকায় পেয়েছেন। তার মাঝে তাঁর ছোট ভাই জাফর ইকবালের একটি লেখা প্রায় সবগুলো পত্রিকা (বিশেষত ইসলাম পন্থী ও কট্টর ডান ঘরানার পত্রিকা বাদে) বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। জাফর ইকবাল নিজে একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক এবং হুমায়ূনের ছোট ভাই, তাই তার আলাদা একটু কদর থাকবে এটা স্বাভাবিক। ফলে তার লেখায় সবার প্রত্যাশাও একটু বেশী থাকবে। আর কারো না হউক তাঁর লেখা ’আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ’কে ঘিরে আমার কৌতুহল ছিল ব্যাপক।
লেখাটিকে চমৎকার বলতে হবে, কারণ তিনি নিজের লেখার জালেই আটকা পড়েছেন বিভ্রান্তিকর অবস্থায়। মনযোগ সহকারে তাঁর লেখাটি পড়লে বুঝা যায় কী পরিমান বিভ্রান্তিকর তথ্য এই লেখাটিতে আছে। প্রথমত, তিনি দাবী করেন হুমায়ূন আহমেদ ব্যতিক্রম ছিলেন কারণ তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়কে বুঝেছেন, তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতিফলন তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন- এ নিয়ে কোন দ্বিধা নেই। যদি জাফর ইকবাল হুমায়ূন আহমদের জীবদ্দশার কথা উল্লেখ করতেন তবে সেটি সঠিক ছিল। কারণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ও জসীম উদ্দীন প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে চিত্রায়িত করেছেন তাঁদের লেখায় কারণ তাঁরা সে হৃদয়গুলোকে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। এমনকি উর্দু লেখক সা’দত হোসের মান্টোর লেখা পড়লেও বুঝা যায় তিনি কত গভীরে চলে যেতেন সব মানুষের। তাই এক্ষেত্রে জাফর ইকবালের এমন মন্তব্য বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর দৈনদশার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। না এটিকে তাঁর ইচ্ছাকৃত খামখেয়ালি ধরে নিব?
’হুমায়ূন আহমেদ কঠিন বুদ্ধিজীবীদেরও নিরাশ করেননি, সে কিভাবে অপ-সাহিত্য রচনা করে সাহিত্য জগতকে দূষিত করে দিয়েছে তাঁদের সেটা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দিয়েছে।’ এখানে তাঁর দাবী ’অপ-সাহিত্য’ শব্দটি হুমায়ূন আহমেদের সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে একথা মনে রাখতে হবে পৃথিবীর সব লেখক এমন অভিযোগে অভিযুক্ত কারণ একজন লেখকের সব লেখা সাহিত্য বিচারে ’সাহিত্য’ হয়না। সবচেয়ে বড় কথা হল লেখাটির শেষ দিকে জাফর ইকবাল দাবী করেছেন তিনি হুমায়ূন পড়েননি বা পড়ার ইচ্ছাও তাঁর মধ্যে খুব একটা নাই। এমতাবস্থায় তিনি কী করে হুমায়ূন আহমদের সব লেখাকে ’অপ-সাহিত্য’ বলে ফেললেন? এমন মন্তব্য করতে গেলে অবশ্যই সে বিষয় নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও জাফর ইকবালের একটি ’অপ-কর্মের’ কথা আমি দীর্ঘদিন ধরেই জানার ইচ্ছা পোষণ করছি। তিনি ব্যক্তি হিসাবে চিন্তার ক্ষেত্রে কতটুকু সৎ এবং মানব হিতৈষী ও স্বার্থপরতা তথা আহমদ ছফা এবং ফরহাদ মজহারের ভাষায় তিনি কতটুকু শ্রেণী স্বার্থের উর্ধ্বে নিজেকে রাখতে পেরেছেন? তিনি নিজেকে উচ্চশ্রেণীর মানুষ ভাবেন বলেই কী সবাইকে একইভাবে মূল্যায়ন করেন? তাঁর সম্পর্কে আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হল তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তাঁর মত পন্ডিত ও বহুপরিচিত ব্যক্তি শিক্ষক হওয়ায় তাঁর কাছে সেখানকার সকল শিক্ষক ও ছাত্রের প্রত্যাশা অনেক বেশী। কিন্তু তিনি বছরের অধিকাংশ সময় সিলেটের বাহিরে থাকেন। তাহলে তিনি কি সেখানকার ছাত্র ও শিক্ষকদের ঠকাচ্ছেন না? তারা কি বঞ্চিত হচ্ছেনা? এটি কি প্রতারণার সামিল নয়?
তিনি হয়তো হুমায়ূন আহমদকে কখনো ঔপন্যাসিক হিসাবে মানতে পারেননি বা তাঁর যোগ্যতা নিয়ে জাফর ইকবালের সংশয় রয়েছে বলেই তিনি দাবী করলেন, পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে লিখলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস হত। কেন হুমায়ূনের উপন্যাস কি সুনীলের চেয়ে খারাপ? কেন তিনি বলতে পারলেন না আমার ভাইয়ের এটি একটি ব্যতিক্রম ও কালজয়ী উপন্যাস হয়ে উঠতো?
জাফর ইকবালকে দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মবিদ্বেষী হিসাবেই চিনে। কিন্তু আমার বারবার মনে হয়েছে তিনি ধর্মকে বিশ্বাস করেন। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করেন। তবে বাহ্যিক যে মনোভাব দেখান তা সহজেই তাঁকে জন পরিচিত করবে বলেই তিনি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। কিন্তু ১৯ জুলাই ২০১২ সালে হুমায়ূনের মৃত্যুর সময় তিনি পাশে ছিলেন। হুমায়ূনের মৃত্যুর সময় যা ঘটেছে তা তিনি হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং সৃষ্টিকর্তার যে অস্তিত্ব আছে তা টের পেয়েছেন। তিনি দাবী করেন আইসিউতে মৃত্যুর পথযাত্রী হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর দৃশ্য দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে” বিজ্ঞানের ছাত্র তথ্য কেমন করে পাঠাবেন সম্ভব তার সকল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আমি (জাফর ইকবাল) জানি। কিন্তু পৃথিবীর অপর পৃষ্ঠ থেকে একজন মা কেমন করে তার সন্তানের মৃত্যুক্ষণ নিজে থেকে বুঝে ফেলতে পারে আমার কাছে ব্যাখ্যা নেই।” সত্যি বলতে কি তাঁর কাছে ব্যাখ্যা থাকার কথাও নয়। কারণ তিনি ইচ্ছা করেই বুঝার চেষ্টা করেননি এর আসল রহস্য কোথায়। তিনি জানেন এমনটি কেবল সম্ভব মহান আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার কল্যাণেই। আর এটাই প্রমাণ করে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব। এখানে তাঁর বিজ্ঞান সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
হুমায়ূন আহমেদের নিশ্চিত মৃত্যু হতে যাচ্ছে জেনেও তিনি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, ’যদি কোন জাদুমন্ত্র বলে হঠাৎ সে (হুমায়ূন আহমদ) জ্ঞান ফিরে পায়, হঠাৎ সে বেঁচে ওঠে তাহলে কী সে আমার (জাফর ইকবালের) হুমায়ূন আহমেদ হয়ে বেঁচে থাকবে? ” ----” ব্লাড প্রেসার যখন আরও কমে এসেছে আমি তখন তরুণ ডাক্তারকে জিজ্ঞাস করলাম , ’এখন?’ ’এখন যদি হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে ওঠে তাহলে কী হবে?’ ডাক্তার মাথা নেড়ে বলল, ”যদি এখন অলৌকিকভাবে তোমার ভাই জেগে ওঠে সে আর আগের মানুষটি থাকবে না। তার মস্তিস্কের মাঝে অনেক নিউরণ সেল মারা গেছে।” ডাক্তার ও জাফর ইকবালের এই কথোপকথনটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তিনি সৃষ্টিকর্তার চেয়ে জাদুমন্ত্রের উপর আস্থাশীল, অন্যদিকে ডাক্তার অলৌকিক ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রেখেছেন। জাদুমন্ত্র মূলত ধর্মহীনতা ও কুসংস্কারকে প্রতিষ্ঠিত করে; অন্যদিকে ’অলৌকিক’ ক্ষমতা মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের কথাকে স্মরণ করিয়ে দেন।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে যেখানে বিজ্ঞানের সকল উৎকর্ষতার জয়গান গাওয়া হয় সেখানে বিজ্ঞান ব্যর্থ কিন্তু জাদুমন্ত্র ও অলৌকিক ক্ষমতার উপর জাফর ইকবালকে বিশ্বাস রাখতে বা নির্ভর করতে হচ্ছে। এই উদগ্রীবতাকে তিনি কিভাবে ব্যাখ্যা দিবেন?
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করব তাঁর লেখার মধ্য থেকে। তিনি বললেন হুমায়ূন আহমেদের জীবনী শক্তি থেমে যাবার সাথে সাথে যে মেশিনটি এতদিন হুমায়ূনের স্পন্দন রেখা বক্রাকারে দেখাত সেটি ঝাঁকুনি চিরতরে থেমে গেল এবং রেখাটিও সরল রেখায় পরিণত হল। চমৎকার উপলব্ধি, কারণ এটিই হচ্ছে যেকোন ধর্মের শিক্ষা।
সবশেষে যে কথাটুকু বলব তা হচ্ছে, তিনি হুমায়ূন আহমেদকে যেমন শ্রদ্ধা করতে পারেননি তেমন পারেননি হুমায়ূন আহমেদের পাঠকদের। তেমনিভাবে তাঁর লেখার শেষাংশে যে সব প্রকাশকের সমালোচনা করেছেন তাও যথার্থ হয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ তা যদি হত তিনি হুমায়ূনের ভিতরের জেদকে শ্রদ্ধা করতেন।
হুমায়ূন আহমেদের জীবন আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই আহমদ ছফাকে বাদ দিয়ে করা যাবে না। কারণ এই আহমদ ছফা হুমায়ূনের জীবনে এক বিশাল বটবৃক্ষ। সবাই যাঁকে জাফর ইকবাল স্যার বলে ডাকেন, আমি সেই স্যারকে বলছি, দয়া করে হুমায়ূন স্যারের মত সাধারণ মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষ মতকে পরিহার করে বিভ্রান্তির অবসান ঘটাবেন, তাতে দেশ এগিয়ে যাবে এবং আপনিও হয়ে উঠবেন কিংবদন্তী।
লেখকঃ প্রভাষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন