সাপ্তাহিকী
|
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
|
|
গোলাম আযমের রায় ও কিছু প্রশ্ন
28 Jul, 2013
দীর্ঘ অপেক্ষার পর রক্তাক্ত ইতিহাসের খলনায়কের রায় আসল । এই রায় ছিল অপ্রত্যাশিত, তাই সবাই বিস্ময় ভরা চাহনি নিয়ে দেখছে, কেন এমনটা হল ! খলনায়কের রায়ে আমরা কলংকমুক্ত হলাম নাকি কলংকিত রায় উপহার দিলাম জাতির শ্রেষ্ট সন্তানদের । প্রথাগত চলচ্চিত্রের খলনায়করা শেষ দৃশ্যে পরাজয়ের মাধ্যমে সব চিন্তার অবসান ঘটান । কিন্তু আমাদের ইতিহাসের খলনায়ক শেষ দৃশ্যের পরিণতি চিন্তার অবসান না ঘটিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করল । এই খলনায়ক আমাদের মুক্তির সংগ্রামে ষড়যন্ত্র করেছিল ভীনদেশীদের স্বার্থে, আর আমরা এই ঘৃণ্য পাপীষ্ট খলনায়কের বিচারে বয়স বিবেচনা আনলাম কিসের স্বার্থে । এটি কি আমাদের স্বাধীনচেতা উদারতা নাকি রাজনীতির কুটিল খেলা ।
পালের গোদা রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে তার প্রত্যেকটা প্রমাণিত হয়েছে । সম্মানিত বিচারকরা পরিষ্কার করে বলেছেন- সর্বোচ্চ শাস্তিটিই তার প্রাপ্য ছিল, শুধু মাত্র বয়সের কারণে তাকে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে নব্বই বছরের জেল দেয়া হয়েছে । গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৯০ বছরের কারাদন্ডের রায় শুনে সরকারী দল ছাড়া অন্যরা কমবেশী অবাক ও বিস্মিত হয়েছেন । সরকারী দল রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে, প্রধান বিরোধী দল মন্তব্য দানে বিরত থেকে জোট ও ভোটের রাজনীতি করছে, শহীদ পরিবারের সদস্যরা, বাম প্রগতিশীল দল সমূহ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাম ধারার সুশীল সমাজ ও গণজাগরণ মঞ্চ এ রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে । ক্ষুব্ধ গণজাগরণ মঞ্চ হরতাল ডেকেছে এবং রায় পুনঃমূল্যায়নের জন্য আপিল করার ঘোষনা দিয়েছে । কমবেশী সবাই মনে করেন যুদ্ধাপরাধের শিরোমণির এই রায় গুরুপাপে লঘুদন্ড । জামাত এতে খুশী হওয়ারই কথা, কিন্তু জামাত উল্টো রায় প্রত্যাখান করে হরতাল ডেকেছে, অনেকে জামাতের এই হরতালকে বাড়াবাড়ি বা আহল্লাদি আচরন বলে মনে করছেন । আর বিএনপির নীরবতা সকল মুক্তিযোদ্ধা ও বিবেকবান নাগরিকদের আহত করেছে । বড় দুইটি দল অন্ততঃপক্ষে জাতীয় বিষয়াবলীতে এক ও অভীন্ন অবস্থানে থাকবেন, এটা জাতির প্রত্যাশা ।
রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযমের রায়টি হাজারো প্রশ্নের ডালপালা ছড়িয়েছে । সাঈদী ও গোলাম আযমের রায়ের মধ্যে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থান পরিস্কার ধরা পড়েছে । আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ে বলা হয়েছে আমরা বর্তমান আল্লামা সাইদীর বিচার করছি না । বিচার করছি বিয়াল্লিশ বছর আগের রাজাকার দেলোয়ার হোসেন শিকদারের । অথচ গোলাম আযমের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- শুধু মাত্র বয়সের কারণে তাকে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে নব্বই বছরের জেল দেয়া হয়েছে । এ বিস্ময়কর কনট্রাডিকশন থেকে জনমনে প্রশ্ন ওঠেছে সরকারের সাথে কোন প্রকার বোঝাপড়া হয়েছে কি জামাতের ! না হয় এমনটি ঘটল কেন ! এ যাবত পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে শাস্তি প্রাপ্ত কেউই বয়স বিবেচনা পাননি, সাঁতাশি বছরের আইসম্যানকে ইসরাইল ও নব্বই-উর্ধ বয়সের দেমিয়ানিউক ও মার্শাল পেতাঁকে ফরাসী ফাঁসী দিয়েছে । অথচ আমরা যুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের থিংক ট্যাংক, বর্বর ও লোমহর্ষক অপরাধের খলনায়ককে মানবতা দেখালাম, ইতিহাসের এই ঘৃণ্য পাপীষ্ট নরাধম গোলাম আযমের কর্মকান্ডে শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ কি রেহাই পেয়েছিলেন ! অথচ যুদ্ধ জয়ী হিসেবে আমরা পরাজিত বৃদ্ধ খলনায়কে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে ঔদার্য্য বা মহানুভবতা দেখিয়েছি । ট্রাইব্যুনালের এই ঔদার্য্যতায় আমার সন্মান শ্রদ্ধা অটুট রেখেই বলছি, সরকারের উচিত আপীল বিভাগে মৃত্যুদন্ডের দাবী করা । কারন আমার আশংকা বা ভয়টা অন্য জায়গায়, আমরা অল্পতেই ভুলে যাই কিন্তু হিংস্র হায়েনা তুল্য ঘৃণ্য পরপশুরা শোধরায় না । যুদ্ধোত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধু ওদের মধ্যে যারা ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ছিল না তাদের জন্য সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন । কিন্তু ঐ রাজাকার গোষ্টী বদলায়নি, তা কমবেশী আমরা সবাই জানি, যার জন্য দেশ-জাতিকে চরমমূল্য দিতে হচ্ছে এখনও । এই নরপশুরা এখন পর্যন্ত বলেনি ৭১ এ ভুল করেছে, এর জন্য ক্ষমা চাই । উপরন্ত রাজাকার শিরোমনি গার্দ্দার গোলাম আযম এ্যারেষ্ট পূর্ববর্তী সময় টিভি সাংবাদিকদের বলেছে ৭১ এ ওদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল ।
প্রশ্ন ওঠেছে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ঘৃণ্য অপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযম হাসপাতালের প্রিজন সেলে আয়েসী জীবন যাপন করছেন, প্রকৃত কারাভোগ করছেন না । অথচ স্বাধীনতার পক্ষের সাজা প্রাপ্ত সাধারন নাগরিকরা কষ্টকর কারাভোগ করছেন । তাই দাবী করছি- এই ঘৃণ্য নরপশুদেরকে জামাই আদরে নয়, সাধারন কয়েদী অপেক্ষা নিন্মমানের সেলে রাখা উচিত । ভাবতে অবাক লাগে, দেশ বিরোধী এই অপশক্তির সুঁতোর টান কতটা মজবুত, আমাদের দেশীয় ট্রাইব্যুনালের রায়কে তীর্যক সমালোচনা ও বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে গোলাম আযমের মুক্তির জন্য পাকিস্থানের করাচীতে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছে জামাতে ইসলামী পাকিস্থান ।
গোলাম আযমের রায়টি সরকারকে রীতিমত সন্দেহে ফেলে দিয়েছিল । কিন্তু জামাতের বর্তমান সেক্রেটারী, বিএনপি জামাত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী, একাত্তরে আল বদর বাহিনীর প্রধান মুজাহিদের ফাঁসীর রায় সরকারকে আপাত সন্দেহ মুক্ত করেছে । গোলাম আযমের রায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংক্ষুব্ধ নাগরিকরা কিছুটা হলেও স্বস্থিতে ফিরে এসেছে মুজাহিদের ফাঁসীর রায়টি শুনে ।
আমরা আমাদের রাষ্ট্র জন্মের বিরুদ্ধাচারনকারীদের যুদ্ধকালিন সময়ে সংগঠিত অপরাধের বিচার করেনি । উপরন্ত ঘাতক-দালালদের দিয়েছি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব, ওদের গাড়ীতে দিয়েছি শহীদের রক্ত রঞ্জিত লাল সবুজের পতাকা । এতে শহীদ পরিবার সদস্য ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ ও অপমানবোধকে ভ্রুক্ষেপ করিনি আমরা । শহীদের রক্তার্জিত পতাকার সাথে এ ধরনের উপহাস ইতিহাসে অন্য কোন দেশ-জাতি করেছে কিনা আমার জানা নেই ।
নাগরিত্ব বাতিল হওয়া গোলাম আযমকে জামাতের সভাপতি ঘোষনার দম্ভ আস্ফালনও জামাতে ইসলামী দেখিয়েছিল । জামাতের এ আস্ফালনে ক্ষুব্ধ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম রাজাকারদের বিচারের দাবীতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেন । পরবর্তীতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গনআদালতের মাধ্যমে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের প্রতীকী রায় মৃত্যুদন্ড দান করেন এবং মৃত্যুদন্ডটি কার্যকর করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন । কিন্তু সেদিনকার বিএনপি-জামাত সরকার উল্টো রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শহীদ জননীকে রাষ্ট্রীয় আদালতের মুখোমুখি করান । কি নির্মম বাস্তবতার শিকার হতে হলো শহীদ জননীকে, তাঁর সন্তানের জীবন দিয়ে অর্জিত রাষ্ট্রে, তাঁকেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো সন্তান হত্যাকারী রাজাকার, আল বদর ও আল শামসদের শাস্তি দাবী করায় । আজকের ট্রাইব্যুনালের রায় প্রমান করল আমরা সর্বশ্রদ্ধেয়া শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাথে রাষ্ট্রীয় ভাবে অন্যায়-অবিচার করেছি । রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা নিয়েই শহীদ জননীকে মৃত্যুবরণ করতে হল । আজকে ট্রাইব্যুনালের রায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গনআদালতের রায়ের যৌক্তিকতা ও পূর্ণতা দান করল । পরপার থেকে শহীদ জননীর আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে, আমরা তাঁর স্নেহের রুমীর ঘাতকদের বিচার করছি । মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য যারা সুদীর্ঘ ৪২ বৎসর অপেক্ষা করেও তাঁদের স্বজন হত্যাকারী রাজাকারদের বিচারিক রায় দেখে যেতে পারেননি, তাঁদের কাছে বাংলাদেশ লজ্জিত ।
লেখকঃ প্রবাসী, জাপান ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন