সাপ্তাহিকী
|
মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন
|
|
প্রাবন্ধিক হুমায়ূন আহমেদ ও আজকের প্রয়োজনে তাঁর অভাব
13 Jul, 2013
হুমায়ূন আহমেদ ও ড. মুহাম্মদ ইউনুস বিতর্কের উর্ধ্বে থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন আপন মহিমায়। কখনো কখনো তাদের বিতর্কিত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে বা হচ্ছে, কিন্তু কলঙ্কিত হয়নি তাঁরা। কারণ প্রতিহিংসার আগুনে স্থাবর সম্পত্তি পুড়িয়ে দেয়া যায়, কিন্তু মানুষের ভালবাসাকে ছাই করা যায় না। ট্রয় নগরীর ধ্বংস এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে? ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু বার্ষিকী। তাই শুরু হয়ে গেছে নানা আয়োজন। তাঁকে ঘিরে জীবদ্ধশায় কতজন কতভাবে ব্যবসা করেছে এর কোন হিসাব নেই। এমনকি এখনো অনেকেই ব্যবসা করে যাচ্ছে। হয়তো আগামী দিনেও করে যাবে। কারণ, হুমায়ূন মানুষের হৃদয়ে উজ্জল নক্ষত্র। আমাদের মনে রাখা ভাল ধান্ধাবাজরা কেবল ব্যবসা করতে পারে, কাউকে শ্রদ্ধা করতে জানেনা। এত কিছুর পরও স্পষ্ট করে বলতে হয় হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যকে এক নতুন ধারায় নিয়ে গেছেন এবং পাঠক তৈরীতে ভারতীয় উপমহাদেশে সবার গুরু হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ফলে কেউ কেউ দাবী তুলছেন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র যুগ, নজরুল যুগের মত হুমায়ূন যুগ নির্ধারণ করতে। তবে বিষয়টি বা দাবীটি অমূলক নয়, কারণ সাহিত্য ও পাঠক প্রিয়তায় স্বাধীন বাংলাদেশে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ।
কিন্তু হুমায়ূন আহদকে মূল্যাযন করতে গিয়ে প্রথমা প্রকাশনার ’বসন্ত বিলাপ’ বইয়ের ভুমিকায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন,”হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশের পর নিমেষে তাই বিক্রি হয়ে যেত হাজার হাজার কপি। তাঁর রসবোধ ছিল সেরা লেখকদের মতো উচুঁমানের। আর ছিল নিজস্ব মতামত। নিজের মতামত তিনি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতেন।” দূর্ভাগ্য জাতির কারণ মতিউর রহমান কেন হুমায়ূন আমেদকে ’সেরা লেখক’ বা ’উচুঁ মানের’ লেখক বলতে পারেননি? কেন তিনি হুমায়ূন আহমেদকে ’সেরাদের মত’ কেবল বললেন? সত্যিকার অর্থেই লজ্জাজনক এমন মূল্যায়ন। হুমায়ূন আহমেদ কতউঁচুমাপের লেখক তা সাহিত্যের মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করে ’নন্দিত নরক ও চিরঞ্জীব হূমায়ূন আহমেদ” প্রবন্ধে দেখিয়েছি। তবে এখানে কেবল লেখকের কিছ’ প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করার দৃষ্টতা দেখাবো কারণ প্রাবন্ধিক হুমায়ূনের মূল্যায়নও হওয়া প্রযোজন।
১ ডিসেম্বর ২০০৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ’আমরা কোথায় চলেছি?’ নামক প্রবন্ধের আবেদন বহু এবং গভীর। যারা হুমায়ূন আহমেদকে কেবল কল্পনাবিলাসী ও ভাবাগের সাহিত্যিক হিসাবে চিহ্নিত করার প্রয়াস চালান , তারা অন্তত এই প্রবন্ধের ধরণ ও বিষয় বস্তর কারনে লজ্জা পাবেন বা পেয়েছেন একথা নিশ্চিন্তেই বলা যায়। ২০০৫ সালে দেশব্যাপী একই দিনে পাঁচশ স্থানের বেশি জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গীরা তাদের উত্থান ও শক্তির মাত্রা জানান দিয়েছিল সবাইকে। ফলে সবার বিবেক যেমন নাড়া দিয়েছিলো তাৎক্ষণিকভাবে, তেমনি আতঙ্ক ও আশঙ্কা গ্রাস করে নিচ্ছিলো সবাইকে। বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ বিশেষ মূহুর্তে বার বার জেগে উঠে এবং অপশক্তির তৎপরতা রোধ করে। ফলে জঙ্গীরা খুব বেশি এগুতে পারেনি।
তবে প্রতিটি দেশেই সাহিত্যিক ও যে সমস্ত মানুষ নিজেদের বুদ্ধি, বিবেক ও কর্মতৎপরতায় সবার হৃদয়ে স্থান করে নেয়, তাঁরা একট্রা হয়ে সব অপশক্তি প্রতিরোধে জন সচেতনতা গড়ে তুলবেন এটাই নিয়ম্ । আর তাঁদের ঐক্যবদ্ধতার কারণে সব দানবেরা পালিয়ে যায় ব্যপক নাশকতার আগে। কিন্তু আমাদের দেশে সাহিত্যিক ও বুদ্ধীজীবীরা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। ফলে সঠিক কোন প্রদক্ষেপ তাঁরা নিতে পারেন না। কিন্তু সেদিন লক্ষ কোটি প্রাণের আবেগ হুমায়ূন আহমেদ বুঝতে পেরেছিলেন্ বলেই অল্প কথায় সবাইকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। এই প্রবন্ধের শুরুতে তিনি বলেছেন, ” আমাদের অতিপ্রিয় শান্তিময় ছোট্র সবুজ দেশটা কোথায় যাচ্ছে? একদল মানুষ শরীরে বোমা বেঁধে কী প্রমান করতে চাচ্ছে? বেহেশতের জন্য অপেক্ষা? নিরীহ মানুষের রক্ত মেখে কি বেহেশতে যাওয়া যায়?” অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তাঁর ক্ষোভ , শ্লেষ বুঝিয়ে দিলেন পথহারা পথিকদের। তেমনিভাবে ধর্মের মর্মকথাও সঠিকভাবে বুঝার পথও দেখে নেয়ার আহবান এখানে রয়েছে।
একটু পরেই তিনি পথ বাতলে দিলেন সবার কী করা উচিৎ। তিনি নবীজী (সা: ) এর উক্তি তথা হাদীসকে উদ্ধৃতি দিয়ে জিজ্ঞাস করেছেন, ”যারা জিহাদের নামে শরীরে বোমা বাঁধছে তারা কি নিজের সঙ্গে জিহাদ শেষ করে এসেছে?” কী অপূর্ব! কাউকে কোথাও দোষারোপ না করে কেবল মূল সমস্যাকেই আলোকপাত করেছেন।
অদূরে হুমায়ূন আহমেদের পরবর্তী বাক্য দু’টি অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ও বাস্তবতায় ঠাসা। এমন উপলব্দি সবার থাকলে হয়তো সমাজে অনাচার, হত্যা, হানাহানি ও কুৎসা বন্ধ হয়ে যেত। তিনি বলেন ,”আমাদের হত দরিদ্র এই দেশে একজন উপার্জনক্ষম মানুষ একা মারা যান না। তাঁর ওপর নির্ভরশীল সবারই মৃত্যু ঘটে।”
এই উপলব্দি সাধারণ জনগণের মাঝে ক্ষেত্র বিশেষে ঘটেনা। কিন্তু রাজনীতিবিদের কখনো উপলদ্ধি হয়েছে কিনা জানা নেই। হুমাযূন আহমেদও হয়তো জানতেন না বলেই লিখেছেন, ”দেশের আজ চরম দু:সময়। এই দু;সময়েও দেখেছি, রাজনৈতিক প্রধান দু’টি দল একে অন্যকে দুষছে,। হায় রে রাজনীতি! রাজনীতিবিদের কি এখনো মনে হচ্ছেনা, আর দেরি করা যাবেনা? সবাইকে একসঙ্গে বসতে হবে! দেশের বর্তমান ভয়াবহ সমস্যার সমাধান করতে হবে। ” এই অংশের শেষ দু’টি বাক্যের পর যে দু’টি আশ্চার্যবোধক চিহ্ন (!) আছে তা বোঝার ক্ষমতা তৈরী করতে পারেনি আমাদের রাজনীতি। তাই হুমায়ূনের এই আহবানের পর প্রায় একদশক পেরিয়ে গেলেও অবস্থার অবনতি ছাড়া কিছুই হয়নি। এমনকি গত কয়েক বছরে দেশ যে ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতেও কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। এই প্রবন্ধের সবশেষ যে আহ্বান ছিল রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি তা তারা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই দয়া করতে পারেনি জনগণকে, করেছে অশান্ত ও দিয়ে যাচ্ছে দুঃখ-কষ্ট।
হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মত। তাঁর শিল্পবোধ সবার জানা। শিল্প সৃষ্টিতে তিনি অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর লেখায়, চিত্রে ও উপস্থাপনায়। পাশাপাশি এও বলতে হয় তিনি অসাধারণ এক মানব। তাই মানবতার দোষ-ত্রুটি, আবেগ-অনুভূতি এবং হাসি-কান্না-বেদনা তাঁকে স্পর্শ করতো প্রবলভাবে। তাই তিনি আবেগকে সবসময়ই সংবরণ করতে পেরেছেন একথা দাবী করা যায় না। অন্তত আমার দৃষ্টিকোন থেকে।
২৭ অক্টোবর ২০০৮ সালে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত তাঁর ’বাউল ভাস্কর্য এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব?’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বেশ আবেগ প্রবন ছিলেন। আবেগ প্রবন হওয়ার কারণও আছে। ইতিহাস, ঐতিহ্যকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের ভাস্কর্য ভাংচুর ও ধ্বংস করে কী চাইছে এক পক্ষ তার হিসাব তিনি মিলাতে পারেন নি।
তিনি যথানিয়মে প্রবন্ধ লেখার সময় প্রকৃত উৎস ও বাস্তবতার নিরিখে উদাহরণ ও উক্তি দেয়ার চেষ্টা করেন। যে সুন্দরের প্রেমে মহানবী (সা: ) ছিলেন অনন্য ও অতুলনীয়, তাই কাবা শরীফের সব মূর্তি ও ছবি বা ফ্রেসকো নষ্ট করে দেয়ার কথা বললেও ’বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি অপূর্ব ছবি’ তিনি নষ্ট করতে দেননি। এমন বেশ কয়েকটি তথ্য ও উদাহরণ দিয়ে তিনি প্রমান করতে চেয়েছেন ভাস্কযৃ ও মূর্তি প্রকৃত অর্থেই এক নয়। আর যারা এমন নিকৃষ্ট কাজে জড়িত তাদের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট ছিল বলেই তাদের নিয়ে কিছু বলার সময় নষ্ট করতে চাননি। প্রকৃত অর্থে এ অংশ সমর্থন যোগ্য। কিন্তু ’সরকার দেরি করছে কেন?’- এই উক্তিটির প্রতি আমার মনোভাব ভিন্ন। কারণ, এটি উস্কানি ছাড়া কিছুই নয় । কারণ তিনি জানতেন বাংলাদেশে প্রধান দু’দল ভোটের রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যপক ব্যবহার করে। তাছাড়া সরকারগুলো কখনো সামগ্রিকভাবে সব জনগণের হতে পারেনি বলে অন্ধকার ও অজ্ঞতায় থাকা মানুষকে আলোর পথে জ্ঞানের আলো দিয়ে আলোকিত করার প্রচেষ্টা চালাতে পারেনি, বরং দমন-পীড়ন চালিয়ে তাদের আরো উগ্র বানানোর চেষ্টা করেছে। হুমায়ূন আহমেদ যদি এই পরামর্শ দিতেন তবেই বিষয়টি ভবিষ্যৎ কল্যাণে অনেক প্রভাব বিস্তার করতে পারতো।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে লজ্জা জনক ঘটনা হল পিলখানা হত্যাকা-। আর এই হত্যাকা-ের পর ২ মার্চ ২০০৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ’ মানব এবং দানব’ প্রবন্ধটি বেশ চমৎকার । এই প্রবন্ধে তিনি জাতির আগামী নিয়ে কত হতাশ তা বেশ স্পষ্ট। তিনি হতাশ ছিলেন বলেই ঘটনাচক্রের সাথে জড়িতদের বিচার চাননি। তিনি এক্ষেত্রে সরকারের যে ব্যর্থতা ছিল তা প্রকাশ করেননি, বরং সরকারের প্রশংসা করেছেণ। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যেখানে এবিষয়ে আজও জনমনে অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে সেগুলির সঠিক কোন উত্তর কারো জানা নেই। অনেকাংশে কেবল দোষারোপের রাজনীতি চলেছে এবং চলছে, সেক্ষেত্রে কেবল সরকারের প্রশংসা করা কতটুকু যৌক্তিকতা তা হুমায়ূন আহমেদের ভেবে দেখার দরকার ছির।
সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্রঋণ এই দু’টির পথিকৃৎ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুষ । তাঁর ব্যবসা পদ্ধতি নিয়ে দু’একজন বহুকাল ধরে সন্দেহ পোষণ করছেন। তাঁদের মধ্যে হায়দার আকবর খান রনো অন্যতম। কিন্তু তাঁদের সমালোচনা ড. ইউনুসকে কখনো প্রভাবিত করতে পারেননি। তাই তিনি দিনের পর দিন বহু নারীকে এই ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন এবং করে চলেছেন। আমার মতে বেগম রোকেয়া ও নবাব ফয়জুন্নেছারা যেভাবে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন , ঠিক তেমনি ড. মুহাম্মদ ইউনুস নারীদের পথ দেখিয়েছেন আলোর দিকে এসে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলার। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি পেয়েছেন কিনা এমন বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু নারীদের পড়াশোনা করতে আগ্রহী করে তুলতে তাঁর অবদান অনশ্বীকার্যে প্রশংসনীয়। নির্দ্বিধায় একথা বলা যায় স্বাবলম্বী হয়ে দেশ গড়ার কাজে আর কেউ পারেননি এমন বৃহৎ আকারে সামনে এগিয়ে আসতে । আর ড. ইউনুসকে বর্তমান সরকার যখন ঠাকুর ঘরের চোর বানানোর চেষ্টা করছেন বা একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ করার চেষ্টা করছেন তখনি জেগে উঠেন হুমায়ূন আহমেদ। স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে ড. ইউনুসের জন্য বেশ সমাদৃত। তাই তিনি ড. ইউনুসের সম্মান রক্ষার্থে এগিয়ে এলেন। লিখলেন ’ড. ইউনুস ’ নামক প্রবন্ধ কারণ তিনি বিশ্বাস করেছেন এই সম্মানহানি ড. ইউনুসের নয়, এটি দেশের। ত্রিশ লাখ শহীদের। ’ আর হুমায়ূন আহমেদ ড. ইউনুসের ব্যবসার প্রতি খোঁজ খবর রাখতেন বলে তাঁর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকার পরও তাঁকে নিজে লেখা একটি বই উৎসর্গ করে ড. ইউনুসকে সম্মান ও সমর্থ জানিয়েছেন। সত্যি এমন বিরল কাজ হুমায়ূনের মত সচেতন মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব।
হুমায়ূন আহমেদ সমসাময়িক বিষয়ের উপর গভীর মনোযোগ রাখতেন, তা তাঁর অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করা শব্দগুলোর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বারবার। তিনি মানবতার কথা কত গভীরভাবে উপলব্দি করতে পারতেন তার কথা নতুন করে আর বলতে হবেনা বা বলার প্রয়োজনও নেই। তবে রাষ্ট্রপতি জনাব (প্রয়াত) জিল্লুর রহমান কর্তৃক ক্ষমাú্রাপ্ত ফাঁসির আসামি মন্টুর প্রতি যে অবিচার করেছেন তা স্পষ্ট করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। কারণ তার প্রাপ্য একমাত্র মৃত্যুদ-, যা ক্ষমার অযোগ্য। আর এখানেই রাষ্ট্রপতি ব্যর্থ। তাই নিহত ব্যাক্তির স্ত্রী যে দু’টি প্রশ্ন রাষ্ট্রের কাছে রেখেছেন সে প্রশ্নগুলোর সাথে হুমায়ূন আহমেদ ঐক্যমত হয়ে সবার উদ্দেশ্যে তাঁর নিবন্ধনে উল্লেখ করেছেন। সে দু’টি প্রশ্ন হলো:
১. প্রধান মন্ত্রী (শেখ হাসিনা) যদি তাঁর পিতার হত্যার বিচার চাইতে পারেন, আমার (নিহত ব্যক্তির স্ত্রী) পিতৃহারা সন্তানেরা কেন বিচার চাইতে পারবেনা?
২. রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভী রহমানের হত্যাকারীদের যদি ফাঁসির আদেশ হয়, তিনি কি তাদের ক্ষমা করবেন?
এখানে যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক তাহল- বর্তমান সরকারের মেয়াদের শুরুর দিকে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং বর্তমানে মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সর্বদাই বিরাজ করেন। ইতিবাচক ইতিহাস তারা তৈরী করতে পারেননি এক মূহুর্তের জন্যও। ২০১১ সালে চলচিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মনিরসহ পাঁচজন এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর সারা দেশ উত্তাল হয়ে পড়েছিল তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল সারাদেশের রাস্তাঘাট খানাখন্দে ভরে গেছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়েগিয়েছিল সে সময়ে তার উপর দূর্ঘটনার পর মন্ত্রীর সহানুভূতির পরিবর্তে উপহাস জুটতো স্বজনহারাদের কপালে। সে উত্তালে হুমায়ূন আহমেদও উসকে দিয়েছিলেন জনগণের বিবেককে একটি সুন্দর আগামীর আশায়।
পাঠকরা আনিসুল হকের রম্য প্রবন্ধ পড়েছিলো এবং পড়ছে এখনো ; এছাড়া আতা সরকারের ভিন্নধর্মী রম্য ও ব্যঙ্গাত্মক লেখা মানুষকে সচল রাখতো বিবেকের প্রশ্নে আপোস না করতে। তাঁদের পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ যোগাযোগ মন্ত্রীর কর্মকা-ের উপহার হিসাবে লিখেন রম্য প্রবন্ধ ’যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগ’। এটি তাঁর স্বভাব সূলভ লেখার ব্যতিক্রম নয়। তাঁর এই লেখাটিকে অনেকাংশে আহমদ ছফার ’মরণ বিলাস’ উপন্যাসের উপস্থাপনার সাথে তুলনা করা যায়। দুটি লেখার বিষয় বস্তু ও চরিত্র ভিন্ন হলেও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যবধান সামান্য। তাঁর লেখায় তিনি স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছেন আমাদের দেশের মন্ত্রীরা কত নির্দয় ও নির্মম এবং তারা মানুষের জীবন নিয়ে কতটা হাস্য রস করেন তা বুঝা যায় হুমায়ূন আহমেদের এই লেখা না পড়লে সত্যি সবাই ঠকবেন জীবনবোধের অর্থ বুঝতে। এমন কী মন্ত্রীর পদ আছে কী নেই সরকারের অনেকে ক্ষেত্রবিশেষে এবং তাদের পিএস ও এপিএসদের ভ-ামী জনগণের জীবনকে সংহার করে তাও এই প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে।
অবশেষে একথা স্পষ্ট করে বলতে চাই হুমায়ূন আহমেদ শারিরিকভাবে একবছর ( ১৯ জুলাই ২০১২ থেকে ১৯ জুলাই ২০১৩) অবহেলিত মানুষের পাশে নেই, কিন্তু কী সাহিত্য , কী প্রবন্ধ , কী চলচিত্র এবং এমন কী হতভাগ্য মানুষের কপালে আজ রানা প্লাজা ধ্বংসের পর যে তামাশা জুটেছে স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্তীর বচনে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নতুন করে লেখার অভাববোধের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে আছেন। চেয়ার বিহীন মন্ত্রীর নিত্য নৈমত্তিক ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার ভঙ্গিকে প্রতিবাদ করার সাহসী মানুষটি আজ নেই। এই বিশাল শুন্য ও হাহাকারের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ ধরা দেয় মানুষের হৃদয়ে। তাই হুমায়ূন অদৃশ্য নয়। তিনি সবার অন্তরে আসন করে নিয়েছেন স্থায়ীভাবে। অতএব হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে তাঁর প্রয়োজন অপরিসীম।
লেখকঃ প্রভাষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ও সেক্রেটারি, চারুতা ফাউন্ডেশন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন