সাপ্তাহিকী
|
তানভীর আরিফ
|
|
“সভ্যতার অভিশাপ ও লুকায়িত অর্থনৈতিক শক্তি”
13 Jul, 2013
আপনার ডিজিটাল ক্যামেরাটি অন করুন আর এদেশের রাস্তাঘাটের কিছু ছবি তুলে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দিন। অতঃপর একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিন দর্শকদের নিকট, তা হল এটি কোন দেশ? অবশ্যই আপনার পরিচয় গোপন করবেন। আমার বিশ্বাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তর হবে হয়ত পাকিস্থান বা আফঘানিস্তান অথবা প্যালেস্টাইন। কিন্তু কেন এমনটি হবে? স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এদেশ কি পুনরায় সংঘাত, হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে কিংবা এদেশ প্রতিনিয়তঃ বোমায় আক্রান্ত হচ্ছে? না, ব্যাপারটি অন্য কোথাও। আজ সে বিষয়ে আলোকপাত করব।
একটু খেয়াল করলেই দেখবেন এদেশে এক মাসের কাজ কয়েক বছরেও শেষ হয় না, বিশেষ করে রাস্তা-ঘাঠ মেরামতের কাজ। রাস্তার মাঝখানের গর্ত, দুপাশের নর্দমার বিশ্রী অবস্থান, যত্রতত্র ফেলে রাখা ময়লা, দুপাশের স্থাপনাগুলোর বিদ্ধস্ত চেহারা আর আমাদের কুৎসিত মানসিকতা এর জন্য দায়ী। আকাশে থুতু ফেললে নিজের গাঁয়ে পড়ে, এটি জানার পরও সবসময় আমরা এই কাজটি করছি। কিংবা নিজের বাসার ময়লাগুলো অন্যের বাসার আশেপাশে ফেলছি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শঃই তাদের বর্জ্য রাস্থার দুপাশে এমনভাবে ফেলে রাখে যা দেখতে দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত কোন দেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাস্থার দুপাশে বিদ্যুতের খুঁটি ও তাতে জড়িয়ে থাকা তারের অবস্থা দেখলে মনে হয় আকাশে মাছ পাওয়া যায় যা ধরতে জাল পাতা হয়েছে। এহেন সব পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের দেশটিকে কি বানিয়ে রাখছি হয়তঃ অনেকে বুঝতে পারলেও কিছু করতে পারছি না।
এবার আসি লুকায়িত অর্থনৈতিক শক্তি প্রসঙ্গে। উন্নত দেশ যেমন আমেরিকা কিংবা ইউরোপের কোন দেশে স্বামী বা স্ত্রীর কোন একজন কর্মহীন হলে একজনের আয়ে বড়জোর ছয় মাস সংসারের খরছ চলবে, ক্ষেত্র-বিশেষে তা অপেক্ষা কম। এমনকি, উপরোক্ত কারণে সংসারও ভেঙ্গে যেতে পারে। এসব উন্নত দেশে যখন প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হয় তা একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব, যেমন বছরে ডিমের উৎপাদন যা বলা হবে তা দেশের মোট খামারের সংখ্যা, খামারে মুরগীর সংখ্যা এবং সেই হিসাবের আলোকে ডিমের সংখ্যা হিসাব করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশ একেবারেই ব্যতিক্রমী একটা দেশ যেখানে একজনের আয়ে অনায়াসে পাঁচজনের সংসার চলে যায় বছরের পর বছর। সংসারের কেউ একজন কর্মহীন হলে সে জন্য সংসার ভাঙ্গার প্রয়োজন পড়ে না। আবার প্রবৃদ্ধিতে মোট উৎপাদন যা দেখানো হয় লুকায়িত উৎপাদন তা অপেক্ষা অনেক বেশী। পূর্বের মত ডিমের উৎপাদনে ফিরে আসি। এই দেশে সরকার ডিমের উৎপাদন যা উল্লেখ করবে প্রকৃত উৎপাদন তা অপেক্ষা অনেক বেশী, কারণ গ্রামের ঘরে-ঘরে পালিত মোরগ-মুরগীর প্রকৃত হিসাব এখানে প্রদর্শন সম্ভব হয়ে উঠে না। অথবা দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্রামীণ খামারের প্রকৃত সংখ্যা কখনো প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে প্রকৃত উৎপাদন পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশী বৈ কম নয়। আর এই ধরণের কিছু কারণে বিশ্ব মন্দার মধ্যেও আমাদের অর্থনীতি ভালোভাবেই এগুচ্ছে। আরো বিষয় আমরা চিন্তা করতে পারি, যেমন ইউরোপ বা আমেরিকার ঠান্ডাপ্রবন কোন অঞ্চলে বীজ হতে চারা উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরীতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়, তার শতভাগের এক ভাগ খরচও আমাদের দেশে করতে হয় না। আম খান, এরপর আঁটিটি সব্জোরে আকাশে ছুড়ে মারুন, আমি নিশ্চিত চারা গজাবেই। মাটির নিচে তেল, গ্যাস আবার উপরের অংশে ধান, পাট সবই উৎপাদিত হয় এমন দেশ পৃথিবীতে কয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে? বিশাল সমুদ্রসীমা, ৩২ কোটি হাত, টাকার উঁচু ক্রয়ক্ষমতা, সোনার মত উর্বর জমি, খনিজ সম্পদে ভরপুর এই দেশ। তবুও আমরা দরিদ্র, কিন্তু কেন?
উত্তর একটিই। হয়তঃ আমরা অভিশপ্ত, নতুবা সভ্যতা আমাদেরকে সভ্য হতে শেখায় নি। আমি নিশ্চিত আমরা দরিদ্র নয়, আজকে রাস্থার দুপাশ গুছিয়ে রাখা হোক, কালকেই পৃথিবীর কেউ আমাদেরকে দরিদ্র বলবে না। তবে কি আমাদের দারিদ্রতা অনেকাংশে আমাদের তৈরী? এই প্রসঙ্গে অন্য একদিন আলোচনা করব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন