সাপ্তাহিকী
|
ড. মঈনুল আহসান
|
|
সিয়ামের সাধনা ও হাট-বাজার সমাচার
13 Jul, 2013
বছর ঘুরে রমজানের রোজা ও ঈদ আবার সমাগত। তাই এরই মধ্যে গরম হওয়া শুরু করেছে দেশের সব হাট, বাজার। সাথে তাল মিলিয়ে গরম হচ্ছে মানুষের মেজাজ, মর্জি, চাহিদাও। অতি বিস্মিত হতে হয় আমাদের এই ‘খাওয়া সর্বস্ব’ রমজানের কথা চিন্তা করলে। ভেবে পাই না বিচিত্র সব খাওয়া-খাদ্য নির্ভর এই রমজান আমরা পেলাম কোথায়? সাক্ষ্য-প্রমাণ বলে আমাদের প্রিয় নবীজী (সা:) এবং তাঁর সাহাবিরা (রা:) সেহেরী-ইফতার সারতেন দু’একটা খেজুর, খোরমা, একটু দুধ অথবা শুধুই পানি দিয়ে। পুরো রমজান তাঁরা ব্যস্ত থাকতেন আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নৈকট্য লাভের একনিষ্ঠ চেষ্টায়। সেখানে খাওয়া-দাওয়ার সময় কোথায়।
প্রিয় রসুল (সা:) বলেছেন, পৃথিবীর বুকে মসজিদ হলো সর্বোত্তম আর বাজার হলো নিকৃষ্টতম স্থান। আবার অন্য দিকে বছরের মাসগুলোর মধ্যে রমজানকে করা হয়েছে মহা মহিমান্বিত এক মাস যে মাসে রয়েছে হাজার মাসের চাইতেও উত্তম এক রজনী যে রাতে নাযিল হয়েছে মানব জাতির মুক্তি সনদ পবিত্র আল-কোরআন। তাই উচিত মতে পবিত্র এই মাসে আমাদের অবস্থান হওয়া প্রয়োজন পবিত্র স্থান মসজিদে। সম্ভব হলে বাসা বাড়ীর পরিবেশও এমন করে নেয়া যেতে পারে যাতে সেটা হয়ে উঠবে একটা পারিবারিক মসজিদের মত। তাহলেই প্রকৃত মর্যাদা পাবে রমজানের পবিত্র সময়, আর আমরাও হতে পারবো সর্বত উপকৃত। অথচ এই মাসেই আমাদেরকে সবচেয়ে বেশী সময় ব্যয় করতে হয় হাটে, বাজারে অথবা বাজারের পথে রাস্তার ট্রাফিক জ্যামে। অর্থাৎ মহাপবিত্র সময় আমরা কাটিয়ে দেই অবলীলায় নিকৃষ্ট স্থানে, নিকৃষ্ট ভাবে। এ যেন ভরা জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য উপভোগ করবো না বলে নিজেকে অন্ধকার ঘরে আটকে রাখার মত অবস্থা।
কিন্তু ঠিক রোজার সময়টাতেই কেন হচ্ছি আমরা বাজারমুখো? জবাব অতি সহজ। সেহেরী-ইফতারে খেতে হবে প্রচুর। পুষিয়ে নিতে হবে সারা দিনের ক্ষুৎ-পিপাসার ক্ষতি। আর ইফতারে কাউকে দাওয়াত করে থাকলে তো কথাই নেই। মেহমানের তৃপ্তির নাম করে আমরা নেমে পরি অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। ইফতারে সেরা হওয়ার ইচ্ছায় যেন পুরো বাজারটাকেই তুলে আনতে চাই ঘরে। অথচ আল্লাহর নবী (সা:) বলেছেন, মেহমানকে পানি দিয়ে ইফতার করালেও মেজবান পাবে তার পুরো সওয়াব।
বছরের মাসগুলোর মধ্যে রমজান মাসের গুরুত্বের মত প্রতিটা দিনের মধ্যেও বিভিন্ন মোবারক সময় রয়েছে যা দোয়া করার জন্য এবং দোয়া কবুল হওয়ার জন্য বিশেষ ভাবে নির্বাচিত ও নির্ধারিত। এর মধ্যে ভোররাতে ফজরের নামাজের আগে-পরের সময় এবং বিকেলে আছরের নামাজের পরবর্তী সময় দু’টো উল্লেখযোগ্য। এই সময় দুটোকে সাধারণত: দোয়া কবুলের সর্বোত্তম সময় হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমানে দুনিয়া সর্বস্ব চিন্তায় মগ্ন আমাদের জন্য একমাত্র রমজানের মাসটাতেই অপূর্ব সুযোগ সৃষ্ট হয় এই সময় দু’টো কাজে লাগানোর। সেহেরীর জন্যে একটু আগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে এবং আছরের পর থেকে ইফতার পর্যন্ত সময়টা দোয়া-দরূদ ও কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যে কাটিয়ে খুব সহজেই এই দু’টো সময়ের মূল্যমান আমরা যোগ করতে পারি আমাদের জীবনে পবিত্র এই রমজান মাসে। কিন্তু সেহেরী আর ইফতারের আধিক্য এবং সেসবের প্রস্তুতির অযথা ব্যস্ততায় আমরা খুবই দুঃখজনক ভাবে বঞ্চিত হই এই সময়গুলোর যথাযথ ব্যবহার ও উপকারিতা থেকে।
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে, যাদের জন্য অধ্যয়নই তপস্যা, তাদের সেই তপস্যাতেও কিন্তু ভোর আর সাঁঝের মূল্য অপরিসীম। ঐ সময় দু’টোতেই সাধারণত: অধ্যয়নের তপস্যা একনিষ্ঠ ভাবে করা সম্ভব হয়ে থাকে। আরও লক্ষণীয় যে লেখাপড়ার ঐ একান্ত তপস্যার সময়েও কেউ কিন্তু ভরা পেটে বা পেট পুরে খেয়ে বসে না। কারণ ভরা পেটে ঘুম পায়। পড়া হয় না। বোধকরি সেই একই কারণে আল্লাহকে পাওয়ার তপস্যাতেও ভোর আর সন্ধ্যাকে একই ভাবে করা হয়েছে গুরুত্ববহ। রমজানের পুরো একটি মাস সেহেরী আর ইফতারের একনিষ্ঠ অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষকে মূলত: বাধ্য করা হয়েছে ঐ গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোর সদ্ব্যবহারে। পাঠাভ্যাসের মত আল্লাহর জন্যে নিবেদিত ঐ একান্ত তপস্যাও ব্যর্থ হতে বাধ্য যদি ভরা পেটে তা করার চেষ্টা করা হয়। সেহেরী ও ইফতারের ভূরিভোজনের পর নামাজে দাঁড়িয়ে ঝিমাতে থাকাটা মূলত: আমাদের সেই ব্যর্থতাকেই নির্দেশ করে অতি দুঃখজনক ভাবে।
পবিত্র এই মাসে আমরা ভোগ-বিলাসের সমস্ত সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে যাই ঈদের ঠিক আগে রমজানের শেষ দিনগুলোতে। তখন আমাদের দিন কাটে রাস্তায়। ইফতার হয় বাজারে। আর নামাজের সময় ফুরিয়ে যায় অন্তহীন কেনা-কাটায়। অথচ ঐ সময়ের একটা মাত্র রাতের ইবাদতই ঘুরিয়ে দিতে পারে আমদের সমস্ত জীবনের মোড়। অমিত মর্যাদা পূর্ণ ঐ রাতটাকে খুঁজে নিতে বলা হয়েছে রমজানের শেষ দশটি রাতের মধ্য থেকে। তাই সত্যিকার অর্থেই আমারা যদি হয়ে থাকি শক্ত ঈমানের অধিকারী, মনে যদি সত্যিই থেকে থাকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের কঠিন শাস্তির ভয় এবং যদি তাঁর অফুরান করুণার প্রতি থাকে সত্যিকারের আগ্রহ ও আকর্ষণ তাহলে রোজার শেষ দিনগুলোতে অন্তত আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় হাট-বাজারগুলোকে গুলজার করে সেখানে বেহুঁশ পড়ে থাকা।
প্রকৃত মুসলিম সমাজের হাট-বাজারগুলো ঐ সময়টাতে শূন্য পড়ে থাকার কথা। ক্রেতাহীন বাজারে জিনিস-পত্রের দাম তখন পড়ে যাওয়ার কথা হু হু করে। এ সব তত্ত্ব ও তথ্য আমরা সবাই জানি। আরও জানি যে হাট-বাজারের ফাঁকে ফাঁকে তথা দৌড়ের উপরে থেকে কোন রকমে কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে কখনই সম্ভব নয় রোজার রহমত, বরকত ও মাগফিরাতকে আয়ত্ত করা। অথচ বাস্তবতা কি মর্মান্তিক ভাবেই না উল্টো। প্রকৃত সত্যের ব্যাপারে কি নিদারুণ ভাবেই না নির্মোহ আমরা সবাই। বস্তুতপক্ষে প্রতিটি রমজানে প্রতিটি মুসলমানের অন্তরের সমস্ত মোহ কেন্দ্রীভূত থাকা উচিত মহা মহিমান্বিত কদরের রাতের প্রতি, মাসব্যাপী বিরাজমান আল্লাহ পাকের অপার করুণার প্রতি এবং পুরোপুরি নির্মোহ হওয়া উচিত বাজারের প্রতি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কে কাকে কিভাবে বুঝাবে যে মুক্তি কোথায় আর কেনইবা ছাড়তে হবে বাজারের নেশা।
সিয়ামের নিরবচ্ছিন্ন তপস্যা শেষে আসে অতি প্রতীক্ষিত উৎসবের দিন- ঈদ। এই ঈদকে ঘিরে শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের প্রতিটি বড়-ছোট হাট-বাজারের পড়ে যায় সাজ সাজ রব। অথচ এই ঈদটা হলো ‘রোজাদারদের’ জন্যে আল্লাহ পাকের বিশেষ উপহার। এটাও ইবাদত। বস্তুতপক্ষে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও বিশেষ এক ইবাদত। ঈদের রাতকে করা হয়েছে অন্যান্য পবিত্র রাতের মতই মহিমান্বিত ও বরকতময়। প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে অগণিত পাপীকে ক্ষমা করার। শুধু ক্ষমা প্রার্থনার অপেক্ষা মাত্র।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকে, রুচিসম্মত আহারে এবং পবিত্র ভাবাবেগের সাথে উৎসব মুখর হতে বলা হয়েছে এই দিনে। বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে কঠোর ভাবে। নতুন কাপড়ের জন্য অথবা আরেকটা খাওয়া সর্বস্ব দিনের জন্য মানুষকে বাজারমুখো হতে বলা হয়নি কোন ভাবেই। বরং বলা হয়েছে দরিদ্র আত্মীয়, পরিজন ও পাড়া-পড়শিদের মনে করতে। সেজন্যেই ঈদের নামাজের আগেই বিলিয়ে দিতে বলা হয়েছে ফেতরার অর্থ যাতে সমাজের হত-দরিদ্র জনগোষ্ঠীও ঈদের আনন্দে সামিল হতে পারে সমান ভাবে।
অতএব সারা বছর আর যা-ই করি অন্তত রমজান মাসে আমাদের চেষ্টা হওয়া উচিত বাজার ও খাওয়া-খাদ্যের বিষয়টিকে মুখ্য না করে আল্লাহ পাকের একান্ত ইবাদতে সর্বোচ্চ মনোনিবেশ করা। এটা সম্ভব হবে তখনই যখন আমরা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবো রোজা আর ঈদের মূল দর্শন যা নবী-রসুলগণ থেকে শুরু করে সাধক, দরবেশ ও ঈমানদার ব্যক্তিরা নিজেদের জীবনে চর্চা করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যুগে যুগে। শুধুমাত্র তাহলেই রমজানে আর কখনো বাড়বে না বাজার দর, চড়বে না মানুষের মেজাজ এবং ঘুষ-দুর্নীতিও হতে পারবে না লাগামহীন। তাই সমাগত এই রমজানসহ আগামী প্রতিটি রোজায় আমাদের প্রার্থনা হোক, অল্প নিদ্রা ও পরিমিত আহারে, অন্তর থাকবে পূর্ণ আল্লাহর স্মরণে। রোজা হবে রোজার মত। ঈদ হবে ঈদের মত। যা আমাদেরকে পৌঁছে দেবে বে-হিসাব জান্নাতে।
**হাদিস ভিত্তিক বর্ণনাগুলো অতীব জনপ্রিয় ও বিখ্যাত তাই যে কোন সহি হাদিস গ্রন্থেই সহজলভ্য- লেখক।**
লস এঞ্জেলস, ইউএসএ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন