উদ্বোধনের ছয় মাস পেরোতে না পেরোতেই নাগরিক অসন্তুষ্টির ভারে পর্যুদস্ত হাতিরঝিল প্রকল্প। নাগরিক জীবনে একটু প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দেয়ার কথা বলে হাতিরঝিল দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা ধরনের অভিযোগ। লেকের পানিতে দুর্গন্ধ। ভেঙে পড়েছে প্রকল্পের বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা। রাস্তায় কাদাপানি। বখাটেদের আড্ডাখানা। যতই দিন যাচ্ছে ততই এর সৌন্দর্যের অবনতি ঘটছে। প্রকল্প এলাকার সোনারগাঁও হোটেলের পাশের অংশে লেকের পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। ওই এলাকার আশপাশের বাসিন্দাদেরও পোহাতে হচ্ছে এ দুর্ভোগ।
বাদামের খোসা, ফল-ফলাদির খোসা, পলিথিন, সিগারেট ও বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো দেখতে পাওয়া যায় হাতিরঝিলের প্রায় সর্বত্র। এছাড়া গাছের ডালপালাসহ জমে আছে অনেক ধরনের আবর্জনা। নির্মাণ সামগ্রীও স্তূপ করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। অনেক জায়গায় লেখা আছে- ‘যত্রতত্র ময়লা ফেলিবেন না, ডাস্টবিন ব্যবহার করুন’। কিন্তু ডাস্টবিন খুঁজে পাওয়া দায়। হকারের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও বাদাম, আইসক্রিম, ফুচকা, ফল বিক্রেতাসহ অসংখ্য হকার দেখতে পাওয়া যায় প্রতিনিয়ত। রিকশা-ভ্যান চলাচল নিষেধ থাকলেও তা চলছে। ট্রাফিক আইন অমান্য করে বিপরীত দিকে যানচলাচল করতে দেখা যায় হরহামেশা। গাড়ি পার্কিং করতে দেখা যায় যেখানে সেখানে।
সবার একটাই প্রশ্ন। এত টাকা ব্যয় করা এই প্রকল্পটি এই কদিনেই কেন মুখ থুবড়ে পড়ল। হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণ ও এর ব্যবস্থাপনার কি কোনো পরিকল্পনা গোড়া থেকে ছিল না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাতিরঝিল তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলেছে। আর এজন্য দায়ী প্রকল্পের নানা ভাগে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা। সমন্বয় না থাকার ফলে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অধীনে হাতিরঝিল পরিচালনায় দেখা দিয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতাকেও এক্ষেত্রে দায়ী করছেন নগরবিদরা।
জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্পের বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজধানীর এক-তৃতীয়াংশ এলাকার বর্জ্য ও দূষিত পানি লেকে ছড়িয়ে পড়ছে। আর ভাসমান মলমূত্র এবং গৃহস্থ ও শিল্পবর্জ্য আশপাশ এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের পান্থপথ অংশ থেকে রামপুরার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে কোথাও স্বচ্ছ পানির দেখা মেলেনি। কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁও এলাকায় বেগুনবাড়ী খালের অংশের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। কোথাও কোথাও দেখা গেল, বর্জ্য থেকে উৎপন্ন গ্যাস বুদ্বুদের মতো উঠে পানিতে ফেনা তুলছে।
মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী, বর্জ্যযুক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ১২টি নিষ্কাশন-কাঠামো বা স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারসন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) তৈরি করা হয়। পরিকল্পনা ছিল নিষ্কাশন-কাঠামোতে কিছু বর্জ্য পরিশোধিত হয়ে তা বিশেষ নালায় এসে পড়বে। আর ওই নালার শেষ মাথায় স্থাপন করা হবে দৈনিক পাঁচ লাখ লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পানি পরিশোধন কেন্দ্র। কিন্তু ওই পরিশোধন কেন্দ্রের কাজ মাত্র শুরু হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরা থেকে হাতিরঝিল লেকে ঘুরতে আসা চাকরিজীবী আজমল হোসেন জানান, ‘এই লেক উদ্বোধনের পর যখন এখানে আসছিল তখন এখানকার অবস্থা দেখে খুব ভালো লেগেছিল। লেক উদ্বোধনের পর থেকে মাঝে মধ্যেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এখানে আসি। এখানে আসলে মনটা একটু ভালো লাগত কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। এখন যে অবস্থা দেখছি তাতে এই লেকের পাড়ে আর আসা যাবে না। কারণ এখানকার পানি দিয়ে যে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে তাতে অসুস্থ হয়ে যাব।’
বিপরীত দিকে যানচলাচল ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে সেখানকার কর্তব্যরত এক ট্রাফিক পুলিশ জানান, অনেক সময় রাস্তা ফাঁকা থাকলে গাড়ি টান দিয়ে ঢুকে যায় তখন আমাদের কিছু করার থাকে না। সার্জেন্ট ধরলে মামলা করেন, না হয় গাড়ি চলে যায়। তিনি জানান, ভেতরের সেতুগুলোতে কোনো ট্রাফিক থাকেন না। সাধারণত সার্জেন্ট বা কোনো ট্রাফিক পুলিশের সদস্য ভেতরে যান না বলে সে ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তবে থানার একটা গাড়ি থাকে যাতে ৪ জন পুলিশ মানুষের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক টহল দেন। তবে পুলিশের টহল তেমন দেখতে পান না বলে জানান স্থানীয় কয়েকজন দোকানি।
এদিকে দেখা গেছে, হাতিরঝিলের প্রতিটি ব্রিজের নিচে এবং আশপাশে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবকের আড্ডা। কোথাও দলবেঁধে রিকশা-ভ্যান চালকরাও বসে আড্ডা দিচ্ছেন, উচ্চৈঃস্বরে গান গাইছেন। কয়েকজন যুবককে দেখা গেল মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়াভাবে নানা ধরনের কসরত দেখাতে। এসব কারণে হাতিরঝিল দিয়ে চলাচলকারী ও বেড়াতে আসা নারী-শিশুরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন।
সপরিবারে বেড়াতে আসা পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী নিঝুম প্রামানিক বলেন, ‘পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা আরিফুল জানান, প্রথম দিকে যখন এখানে আসছিলাম তখন দেখতে এতো সুন্দর ছিল যে এখানে আসলে মনে হতো বাইরের কোনো দেশে এসেছি। লেকের পানিও ছিল অনেকটা স্বচ্ছ। তাই সুযোগ পেলেই আমাদের একমাত্র মেয়ে জয়িতাকে নিয়ে এখানে আসতাম। আমাদের মেয়ে লেকের পাড়ে আসলেই অনেক খুশি হতো আনন্দে খেলা করত। কিন্তু এখন পানির গন্ধ আর ফুটপাতে কাদা। চারপাশে এমন সব লোকজন আর তাদের কথা বলা ও তাকানো দেখে অনেকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেছি। মনে হচ্ছে পরিবার নিয়ে এসে ভুল করেছি।’
তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রকল্পটি ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে জনসচেতনতাও দরকার। প্রকল্প পরিচালক এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে জনগণকেও সচেতন হতে হবে। সবাই সচেতন হলে এ প্রকল্প এলাকাটি পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব। আমরা অনেক ডাস্টবিন দিয়েছিলাম সেগুলো চুরি হয়ে গেছে। এখন আবার নতুন করে ২৫০টি ডাস্টবিন বসানো হবে। সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেক গাছ লাগিয়েছি, আরো বহু ধরনের গাছের চারার ব্যবস্থা করা হয়েছেÑ সেগুলো লাগানো হবে। কাজ শেষ হলে প্রকল্প সব সমস্যা থেকে বেরিয়ে একটি নির্মল বিনোদনের স্থল হিসেবে খ্যাতি পাবে।’
সমস্যা সমন্বয়হীনতা
হাতিরঝিল প্রকল্পের দেখাশোনা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে মূল জটটা লেগেছে সমন্বয়ের অভাবেই। এই প্রকল্পে একইসঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। হাতিরঝিল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। খালের দুই পাশের সড়ক ও হাঁটার রাস্তা এবং সেতু নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি), কারিগরি পরামর্শ ও বিশদ পরিকল্পনায় বুয়েট, বৃষ্টির পানি ও পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ওয়াসা ও প্রধান সড়কসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ।
সমন্বিতভাবে পুরো প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাজউকের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও কাজ যেহেতু পুরোপুরি এখনো শেষ হয়নি তাই অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব থেকে যাচ্ছে। কেউ কারো কাছে জবাবদিহি না করা, একে অপরের পরিকল্পনার অধীনে না আসা, সর্বোপরি নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার ফলে সহজ একটি কাজেও জট লেগে যাচ্ছে বিরাট।
কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনী প্রকল্পের দেখভাল করার কথা আগে থাকলেও রাজউকের হাতে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সেনাবাহিনী প্রকল্পের নিরাপত্তা বিধানে অনেকটা গা-ছাড়াভাবে কাজ করছে। সেনাবাহিনী প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু এরকম একটি জনসম্পৃক্ত প্রকল্পে সেনাবাহিনীকে লম্বা মেয়াদে যুক্ত করার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখিয়েছে সরকার। গা-ছাড়াভাবে সেনাবাহিনীর এই উপস্থিতি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজেও প্রভাব ফেলছে। প্রকল্পের পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ওয়াসা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাজউক হয়ে সিটি কর্পোরেশনের করার কথা থাকলেও তারা ঠিকমতো কাজ এগুতে পারছেন না।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ওয়াসার একজন প্রকৌশলী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে পরিকল্পনা করেছি তা হুট করে সেনাবাহিনীর কাজের জন্য বাদ দিতে হয়েছে। পুরো প্রকল্প একসঙ্গে ধরে কাজ করলেও আমরা নির্দিষ্ট একটা অংশকে প্রাধান্য দিয়ে ওখানকার কাজটা শেষ করি। লেকের একটা অংশে আমরা স্যুয়ারেজের লাইন বন্ধ করে সেই লাইনটি অন্যদিকে ঘুরানোর যখন পরিকল্পনা নিলাম সেনাবাহিনী ঠিক সেখানেই রাস্তা উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত একটা কাজে হাত দিল। স্বাভাবিকভাবেই আমরা আর আমাদের কাজের অগ্রগতি বুঝতে পারলাম না। এরকম কিছু সমস্যা আছে। ইগো সমস্যা থেকে বের হতে পারলে আমরা সবাই মিলে জাতিকে ভালো একটা কিছু উপহার দিতে পারি।’
তবে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সাঈদ এম মাসুদ জানান, ‘এখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের আগমন দেখে মনে হয় হাতিরঝিলটি যদি আরও সুন্দর করা যেত তাহলে ভালো হতো। মানুষের কাছে স্থানটি আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যেত। আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। যখন নানা রকম বিনোদন অবকাঠামো তৈরি শেষ হবে তখন এটি মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে। এখন যে পরিমাণ মানুষ হাতিরঝিল দেখতে আসেন তখন আরও বেশি মানুষ এখানে বেড়াতে আসবেন। আমাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগটা একেবারে বেঠিক না। কিছু সমস্যা তো আছেই। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে যে কোনো কাজ করতে গেলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়। তবে এখন আর সমস্যা থাকবে না। প্রকল্প পরিচালনার জন্য যে পরামর্শক পরিষদ গঠন করা হয়েছে, তাদের সুপারিশ অনুযায়ী আগামীতে কাজ চলবে।’
অদক্ষতার দায়ও অনেক
হাতিরঝিলের মতো একটি প্রকল্প পরিচালনা ও এগিয়ে নেয়ার জন্য যে দক্ষতার দরকার এর সঙ্গে জড়িতদের তার অভাব রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। অদক্ষতার কারণে অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাই যেসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার বেশ খানিকটা ভেস্তে যেতে বসেছে। বলা হয়েছিল, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও বন্যা প্রতিরোধ, বর্জ্য পানি অপসারণ ও সমগ্র এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন, বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল এলাকাকে অবৈধ দখল থেকে রক্ষা, রাজধানীর মধ্যাঞ্চলের যানজট নিরসন ও নাগরিকদের অবকাশ যাপনের ক্ষেত্র তৈরি হবে এর মাধ্যমে। কিন্তু লেক দখলের হাত থেকে বাঁচলেও বাকি উদ্দেশ্যগুলোর কোনোটি সফল হয়নি।
হাতিরঝিলে ঢুকতে এবং বেরোতে দীর্ঘ যানজটে পড়তে হচ্ছে। এফডিসি পয়েন্ট দিয়েই বেশি গোলযোগ হচ্ছে। রামপুরা পয়েন্টে বখাটেদের আড্ডা বেশি। ওভারপাসগুলোতে গাড়ি পার্কিং হচ্ছে যত্রতত্র। সব স্থানে নির্দেশিকা দেয়া না থাকায় সার্ভিস রোড ও এক্সপ্রেস রোড ব্যবহার করতে ভোগান্তিতে পড়েছেন চালক ও পথচারীরা। প্রতিটি রাস্তা টুওয়ে পদ্ধতিতে করা হলেও রাস্তাগুলো ওয়ানওয়ে পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হয়। বলা হচ্ছে নির্দেশিকা ঠিক হলে আবার টুওয়ে পদ্ধতিতে যাওয়া হবে। দুর্গন্ধ বেশি হচ্ছে বাংলা মোটরের পার্শ্বস্থ ও আফতাব নগরের কাছের জায়গাটিতে।
এগুলো প্রথম থেকে আমলে নিলে এবং দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করলে আজ এত বড় হয়ে দেখা দিতে পারত না।
পানি-বর্জ্যে ভজঘট
পানি ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য নিষ্কাশনই এখন হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দক্ষ হাতে মোকাবেলা করলে বর্তমান লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েই এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। এ বিষয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের এলজিইডি বিভাগের টিম লিডার ও নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘প্রকল্পের শুরুতেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় কিছু ত্রুটি ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রতিনিধি দল যে ডিজাইন দিয়েছিল তাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বলা হয়েছিল এখানে শুধু বৃষ্টির পানির সঙ্গে বর্জ্য আসবে। কিন্তু তখন বৃহৎ পরিসরে পরিকল্পনা করা হয়নি। এ অংশ দিয়ে যে মারাত্মক বিপর্যয়কর সব সলিড বর্জ্য আসবে সেটাও ভাবা হয়নি।
তাছাড়া সোনারগাঁও অংশে বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে যে সলিড সুয়েল ডিসপোজাল সিস্টেম (এসএসডিএস) ব্যবস্থা আছে তার ধারণ ক্ষমতাও অনেক কম। এখন যে পরিমাণ ও ধরনের বর্জ্য আসছে তা এসএসডিএস’র ধারণক্ষমতার বাইরে। যে কারণে এখন আর কোনো বর্জ্য আটকানো যাচ্ছে না। সহসাই এটা নিরসন করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। তাৎক্ষণিকভাবে একটা উপায় আছে উৎসে বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ করা। অবশ্যই উচিত ছিল পরিকল্পনার শুরুতেই এই বিষয়টি সমাধান করা। তা হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে বুয়েট তাদের পূর্ববর্তী ডিজাইনের কিছু অংশ পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবারের বর্ষা মৌসুম পেরুলে এই সমস্যা আর হবে না বলে আমি আশাবাদী।’
লেকের পানিতে এত দুর্গন্ধ কেন জিজ্ঞেস করা হলে প্রকল্প পরিচালক এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বর্জ্য থাকায় একটু সমস্যা হচ্ছে। বর্ষা শেষ হলে এটা ঠিক হয়ে যাবে আশা করছি। অতিরিক্ত বর্জ্য হওয়ায় সোনারগাঁও হোটেল এলাকায় আমাদের যে এসডিএস-১ আছে সেটাও ঠিকমতো কাজ করছে না। যে কারণে ওই এলাকার লেকের পানিতে দুর্গন্ধ দেখা দিয়েছে।’
প্রজেক্ট অফিসার মেজর মোঃ খিজির খান বলেন, খালের পানিকে পূর্ণাঙ্গভাবে দূষণমুক্ত করতে সময় লাগবে। দাশেরকান্দি পানি শোধনাগার তৈরি না হলে খালের মধ্যে আসা দূষিত পানি পরিশোধন করা সম্ভব নয়। পানিকে দূষণ ও দুর্গন্ধমুক্ত করতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে আলোচনা চলছে। বর্জ্যযুক্ত দূষিত পানিকে আপাতত পাম্প করে রামপুরা খালের নিচে ফেলা হবে। কিন্তু ওই খালের দুই পাশে গড়ে উঠেছে আফতাবনগরসহ বেশ কয়েকটি আবাসন প্রকল্প। খালের দূষিত পানি সেখানে ফেললে ওই এলাকায় বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তাই প্রকল্পের সব কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরকম কিছু ভজঘটে অবস্থা লেগে থাকবেই।’
প্রকল্পের পরামর্শক সংস্থা বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের বর্জ্য পরিশোধন-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এই বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। খালের মধ্যে পড়া ওই বর্জ্যযুক্ত পানি সহনীয় পর্যায়ে আনতে আরও কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগবে। আর পানিকে ধানমণ্ডি খালের পর্যায়ে স্বচ্ছ এবং দুর্গন্ধমুক্ত করতে তিন বছর সময় লাগবে।
বুয়েটের সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতিদিন চার লাখ ৯০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্যযুক্ত পানি বেগুনবাড়ী খালে এসে পড়ে। রাজধানীর গৃহস্থ বর্জ্য এবং বৃষ্টির পানি একই নালা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খালের পানির সঙ্গে মিশছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্রায় ৩০০ শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত হওয়া বর্জ্য। এই বর্জ্য পরিশোধন ও নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো তৈরি হয়নি।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও প্রকল্পের প্রধান পরামর্শক মুজিবর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো আদর্শ পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছি না। ঢাকা ওয়াসার স্যুয়ারেজ ও বৃষ্টির পানির লাইন এক হয়ে আছে। সম্মিলিত পানিপ্রবাহের গতি বর্ষাকালে এসে তীব্র হয়ে গেছে। ফলে বর্জ্যপানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো কাজ করছে না। কাঠামো ও নালা টপকে পানি খালের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। প্রকল্পের ৩০০ একর এলাকায় ধেয়ে আসা বর্জ্য এতদিন একটি অস্থায়ী বিকল্প খালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হতো। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কম ছিল, ফলে ওই সময়টায় খাল খনন করে গভীরতা বাড়ানোসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়।
নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়ে এলে বিকল্প অস্থায়ী খালটি কেটে মূল খালের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। আর এতেই বাধে বিপত্তি। তেজগাঁও শিল্প এলাকা, সোনারগাঁও হোটেল ও মগবাজার এলাকায় দীর্ঘদিন জমে থাকা বর্জ্য একসঙ্গে খালের মধ্যে পড়ে। এখন আমরা আরেকটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি প্রকল্পের সব কাজ শেষ হলে নগরবাসী এখানে এসে আগের চেয়েও বেশি আনন্দ পাবেন।’
কাজ শেষ কবে
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, হাতিরঝিল উদ্বোধনের ছয় মাসের মধ্যেই এত বড় বিপর্যয়ে পড়ত না, যদি সব কাজ শেষে প্রকল্পটি উন্মুক্ত করা হতো। প্রকল্পের এখনো অনেক কাজ বাকি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানি নিষ্কাশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের বাইরেও আছে বিনোদনের নানা উপকরণ যোগ করার কাজ। নৌ-চলাচলের জন্য খননের কাজ চলছে পুরোদমে। চলছে অসম্পূর্ণ অন্য কাজগুলোও। এতে ছয় মাস আগে যে সৌন্দর্য নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল, লেকের সেই সৌন্দর্য এখন আর নেই। চারদিকে ইট-সুরকি, পাথর, বালু, মাটির স্তূপ বাড়তি ভোগান্তি এবং বিরক্তির আরেক সংযোজন। গাড়ি চলার সময় কিছু এলাকায় চোখ, মুখ বন্ধ করে হাঁটতে হয় দর্শনার্থীদের।
প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আর কত দিন লাগবে জানতে চাইলে প্রজেক্ট অফিসার মেজর মোঃ খিজির খান বলেন, ‘২০১৪ সালের ৩০ জুন সব কাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি কাজই শেষ করার পর তা আবার রিভিশন করতে হয়, তখন নতুন কিছু কাজ যুক্ত হয়। আমাদের কাজ শেষ হবার পর তারই রিভিশন চলছে। এখন দুটি ইউ-লুপের কাজ চলছে। যার একটি বিটিভি মোড় এবং অপরটি মেরুল বাড্ডা মোড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে মালিবাগের দিক থেকে আসা ও বাড্ডার দিক থেকে আসা যানবাহন সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে।’
এছাড়া প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় এলেও বর্তমান সমস্যাগুলো কেটে যাবে বলে আশাবাদ করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা বলেন, ‘প্রকল্পটির দেখভাল করার জন্য একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বা পরিষদের প্রস্তাব করা হয়েছিল সরকারের কাছে। সেই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে। সব সেবা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় করার কাজ শুরু করেছি আমরা। কমিটির শীঘ্রই সুপারিশ পেশ করার কথা আছে। সুপারিশ হাতে পাওয়ার পর আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারব।’ (সাপ্তাহিক, ১১/০৭/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন