সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
দারিদ্র বিমোচনঃ কি হয়েছে তাতে সন্তোষ্ট না হয়ে কি হয়নি তার হিসাব করা প্রয়োজন
13 Jul, 2013
রাবেয়া বেগম শুয়ে আছে তার জীর্ণ কুটিরে। বয়স হবে বড় জোর চল্লিশ। আজ কদিন ধরে বুকে ব্যথা আর শ্বাস কষ্ট। ব্যাথায় মা চিল্লায়, লিকলিকে শরীরের সন্তানেরা পাশে বসা। বড় মেয়েটি বাবাকে বলে মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও। বাবা হতাশ চোখে তাকায়, বলে নিয়ে যাবার জন্য ভ্যান ভাড়াও নেই মা, ডাক্তারের ফিস, ঔষধ...কিভাবে হবে? দিনে কাজে না গেলে করলে রাতের খাবার জুটবে না। মেজছেলেকে তিনি পাঠিয়ে দেন হুজুরের কাছে পানি পড়া আনতে, তিনি কাজে চলে যান। ছোটটি আরো অবুঝ, অসুস্থ মায়ের মায়ের কাছেই তার বায়না, ক্ষুধা লেগেছে, খাবার কি কিছু জুটবে না?
গল্পটি নিশ্চয় নতুন নয় আপনার জন্য, যদি আপনার বাস হয় এই দেশে, যদি আপনার একটু দেখবার মানসিকতা থাকে।
সোনাবরুর ঘটনা তো খবরের কাগজেও এসেছিল। স্কুল পড়ুয়া চঞ্চল মেয়েটি স্কুল শেষ করে এসে ভাত চেয়েছিল, মা দিতে পারেনি। ছোট মেয়েটি অভিমানে দুঃখে আত্মহত্যা করে।
আপনার গ্রামে যাওয়ার সময় না হলে শহরেই এদের খুজে পাবেন। ময়লার ভাগাড়ের পাশ দিয়ে যখন নাক চেপে চলে যাচ্ছেন দ্রুত, একটু খেয়াল করে দেখুন এই ময়লা-আবর্জনার ঢিবির মধ্যের ভাঙ্গারী জিনিষ খুজছে কিছু কালি-ঝুলি মাখা শিশু, যাদের দেখে হয়ত আপনার মনে মায়া তৈরী হয় না। কিন্তু তাদের গায়ে একটি ধোয়া কাপড় পরিয়ে স্কুলে পাঠালে তখন কিন্তু আমার সন্তানের সাথে তার কোন পার্থক্য থাকবে না। হয়ত অনেক বড়লোক বাবার সন্তানের চেয়ে সে ভালো রেজাল্ট করতে পারত। হয়ত আমার ঘরেই যে মেয়ে-শিশুটি উদায়স্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে তার দিকেও কখন মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকানোর সময় আমাদের হয় না। তার শিশু-বয়স ছাপিয়ে বড় হয়ে তার ছোট ছোট ভুল গুলি। শৈশব-আনন্দ এবং ভবিষ্যত সম্ভবনা বঞ্চিত এই শিশুরা আদর এবং ক্ষমার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত পায় চড়-থাপ্পর কিম্বা গরম খুন্তির ছ্যাকা!
এই প্রতিনিয়ত চিত্রের মাঝেও আছে কিছু আশাবাদী হবার মত অগ্রগতি। দারিদ্র কবলিত এই দেশ থেকে দারিদ্র কমছে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (MDG) অনুযায়ী ২০১৫ সাল নাগাদ দারিদ্র বিমোচনের যে লক্ষ্যমাত্রা তা দুই বছর আগেই অর্থাৎ ২০১৩ সালেই আমরা অর্জন করতে যাচ্ছি। দারিদ্র কমে ২৫% শতাংশে নেমে আসবে। এটা নিঃসন্দেহে খুশী হবার মত একটি খবর।
কিন্তু এটা নিয়ে সন্তোষ্টির কোন অবকাশ নাই। আরো অনেকটা পথ এখনো বাকী।
প্রথমতঃ এখনও ২৫% শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে, যার বড় অংশ অতি-দরিদ্র। মাথার হিসাবে (headcount) এই সংখ্যা চার কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে দুই কোটি অতি দরিদ্র। এই বিশাল সংখ্যার মানুষকে দারিদ্রের নীচে রেখে আমরা টেকসই উন্নয়ন আশা করতে পারিনা।
দ্বীতিয়তঃ বিগত দশ বছরে বছরে গড়ে ১ -১.৫ শতাংশ হারে দারিদ্র কমেছে বাংলাদেশ। এটা নিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা গর্ব করতে পারেন কিম্বা তারা দারিদ্র বিমোচনের ক্রেডিট নেবার চেষ্টা করতেই পারেন। কারন রাজনৈতিক ব্যবসার জন্য এটা তাদের বড় ধরনের পুজি! কিন্তু সাধারন মানুষ কি মনে করেন? বিশ্বব্যাংকের বিশ্বব্যাপী করা এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে দরিদ্র লোকজন মনে করেন তাদের দারিদ্রের পিছনের সরকারের ব্যর্থতা মুলত দায়ী। তারা বেচে থাকবার জন্য যে মৌলিক প্রয়োজন আশা করেন সরকারের কাছ থেকে তার প্রায় কিছুই পান না মুলত সরকারের যথাযথ নীতির অভাবে কিম্বা নীতি থাকলেও তাতে ব্যপক দুর্ণীতি এবং অদক্ষতার জন্য।
আমরা দারিদ্র থেকে বের হচ্ছি ধীরে ধীরে। অর্থনীতি যখন এগুচ্ছে তখন অসংখ্য ঘটনা পিছনে থেকে অর্থনীতির চাকা কে টেনে ধরছে। দুর্ণীতির ঘটনা ঘটেছে, বাস্তবায়নের সক্ষমতার কারনের প্রতিবছর এডিপি কাটছাট করতে হয়েছে কিম্বা প্রসেস এর অদক্ষতার কারনে কাংখিত ফলাফল আসেনি, প্রকল্প সময় মত শেষ করা যায়নি কিম্বা খরচ বাড়াতে হয়েছে। সুশাসন এবং দক্ষতার সমন্বয় হলে হয়ত দারিদ্র বিমোচনের হার দ্বিগুন হয়ে যেতে পারত!
ব্যবসা-বানিজ্য চাঁদাবাজি মুক্ত হলে, সড়ক দুর্ঘটনা কমলে, ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম কম হলে, খাবারে ভেজাল না থাকলে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আরো ভাল হলে, বিদেশে অদক্ষ্য শ্রমিক কমিয়ে দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারলে, হরতাল চিরতরে বন্ধ করতে পারলে, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে অরাজকতা ও ধবংসাত্মক কার্যক্রম ঠেকানো গেলে, স্থানীয় প্রশাসন কে ক্ষমতায়ন ও দুর্ণীতিমুক্ত করে উন্নয়ন কাজে জনগনের অংশগ্রহন বাড়াতে পারলে, আরো বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আনতে পারলে এবং এরকম অসংখ্য জায়গা আছে যেসব জায়গায় উন্নতির মাধ্যমে অর্থনীতির চাকার গতি আরো বহুগুনে বাড়ানো যেত এবং তাতে নিঃসন্দেহে উতপাদনশীলতা বাড়ত, কর্ম সংস্থান বাড়ত, দারিদ্র কমত।
অর্থাৎ আমাদের সুযোগ ছিল দারিদ্র বিমোচনের বর্তমান হারকে আরো বেশী করবার। আজ যেখানে ২৫% দারিদ্রের হার দেখে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি আসলে সেটা আরো কমে ১০-১২ শতাংশে নেমে আসতে পারত। এই না-পারা জায়গাটা আমাদের দেখতে হবে, আমাদের দ্বায়িত্ব নিতে হবে। যারা উন্নয়ন গবেষনার সাথে যুক্ত তারা যদি গবেষনা করে এই সম্ভাব্য হার (probable rate of poverty reduction) টা বের করতেন, তাহলে আমরা ব্যার্থতার পরিমাপ করতে পারতাম।
যেটুকু অর্জন আমাদের তার জন্য খুশি হতে পারি, যারা বিভিন্ন ভাবে অবদান রেখেছেন তাদের প্রাপ্য সম্মান আমরা দিতে পারি। একই সাথে যেটা হতে পারত কিন্তু বিভিন্ন ব্যর্থতায় হয়নি তার দায়ভারও নীতি নির্ধারকদের নিতে হবে। সেই জায়গা গুলো চিহ্নিত করে আর দ্রুতগতিতে দারিদ্র কমিয়ে মধ্য আয়ের দেশ হতে আমরা এগিয়ে যাব, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এক দারিদ্র-বৈষম্য-মুক্ত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভীতের ইপর দাঁড়ানো বাংলাদেস রেখে যেতে পারব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন