সাপ্তাহিকী
|
সাইফ বরকতুল্লাহ
|
|
বাংলাদেশে মিডিয়ার রাজনীতি (পর্ব-০৪)
29 Jun, 2013
এক.
আমি একটি বেসরকারী টেলিভিশনে কাজ করি। কয়েকমাস আগে আরেকটি নতুন বেসরকারী টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিই। ভাইভা বোর্ডে আমার সিভি দেখে পরীক্ষক (সাংবাদিক বড় ভাই) আমাকে, বলল, আপনি...ওই মিডিয়ায় কাজ করেন, আপনাকে আমরা নিবনা। বলে রাখি, এখানে দুই মিডিয়ার মালিক পক্ষ দুই রাজনৈতিক ( আওয়ামীলীগ ও বিএনপি ) ঘরনার সমর্থক। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আজকের গণমাধ্যমে যারা নিয়োগ পরিচালনা করেন, তারা কোননা কোন পক্ষকে সাপোর্ট করেন। কিন্তু এটা কতখানি যুক্তিযুক্ত? আমরা যারা নতুন প্রজন্মের গণমাধ্যমকর্মী, আমরা তো কোন রাজনৈতিক পক্ষকে সাপোর্ট করতে পারিনা। তাহলে কেন আমাদের অনাকাঙ্খিত এসব ব্যাপার পোহাতে হয়?
দুই.
গত জানুয়ারীতে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের এর নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমিও নতুন সদস্য হবার জন্য আবেদন করি। সাব এডিটর কাউন্সিলের সভাপতি (সেই সময়) মামুন ভাই (ইত্তেফাকে কর্মরত) বলেছিল, আপনার সদস্যপদ হয়ে যাবে। পরে জানা যায়, উনি সাব এডিটর কাউন্সিলের নির্বাচনে ব্যস্ত থাকায় ঠিকভাবে সুপারিশ করার সময় পায়নি, তাই সদস্যপদ দেয়া হয়নি। একজন তরুণ সাংবাদিক হিসেবে ব্যাপারটা আমাকে এ ধরণের সাংবাদিক সংগঠনের সদস্য হতে নিরুৎসাহিত করেছে।
তিন.
দুটি লেখা পড়ি। বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত আদিত্য আরাফাতের লেখা, 'প্রেসক্লাব-ডিআরইউ কাদের জন্য? " আরেকটি খবর গোলাম আজম খানের খবর বার্তা ২৪ডটকমে প্রকাশিত, ' বিশ বছর পর কক্সবাজারে সাংবাদিকদের ঐক্যের সুর। " আদিত্য আরাফাত লিখেন, অনলাইন মিডিয়া তাই অফিসে গিয়ে সংবাদ দেওয়া সম্ভব হয় না। যখনকার সংবাদ তখনই অফিসে পাঠাতে হয়। দ্রুত সংবাদ আপলোড করতে হয় তাই সংবাদ সম্মেলন বা যে কোনো অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ দ্রুত নিউজ ডেস্কে দিতে তৎপর থাকি। ডিআরইউতে সদস্য ছাড়া অন্য সাংবাদিকদের জন্য কম্পিউটার ব্যবহার নিষিদ্ধ (কারো কারো জন্য সিদ্ধ থাকলেও আমি এসব সংগঠনের কম্পিউটার এ পর্যন্ত ব্যবহার করিনি কিংবা করতে চাইনি) আসি প্রেসক্লাব থেকে। বাইরে তখন বাংলানিউজের ফটো সাংবাদিক নাজমুল হাসানের সঙ্গে দেখা। নাজমুল আমাকে প্রেসক্লাবের বাইরে এক জায়গায় চার্জ দেওয়ার সুযোগ করে দেন। নাজমুল জানান- ফটো সাংবাদিকদের অনেকেই প্রেসক্লাবের বাইরে থেকে ছবি পাঠান। অন্য একটি সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকও তখন বলেন-‘প্রেসক্লাবের সামনে এক স্টেশনারি দোকানে ল্যাপটপ চার্জ দিয়ে একটু আগে সংবাদ পাঠিয়েছি।’ আমরা যেসব সাংবাদিক প্রেসক্লাব ও ডিআরইউর সদস্য নই আমাদের কম্পিউটার ব্যবহার করা কিংবা ন্যূনতম ল্যাপটপের চার্জ দেওয়া হারাম কেন জানতে চাই সাংবাদিক নেতাদের কাছে। ...........কেন আমাকে প্রেসক্লাবের বাইরে গিয়ে সংবাদ পাঠাতে হয়? প্রেসক্লাবের সামনে স্টেশনারির দোকানের মালিক সাংবাদিকদের কম্পিউটারে চার্জ দেওয়ার সুযোগ দেন অথচ প্রেসক্লাব কিংবা ডিআরইউর ভেতর কেন দেওয়া হয় না?
একজন সাংবাদিক হয়ে কেন আমি পেশাগত কাজ প্রেসক্লাব কিংবা ডিআরইউর ভেতর করতে পারি না? আমি সাংবাদিক; আমার প্রেসকার্ড কি প্রেসক্লাব-ডিআরইউতে পেশাগত কাজ করার জন্য যথেষ্ট নয়? কেন আমাকে অন্যের পরিচয় দিয়ে ডিআরইউতে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নিতে হবে? কেন আমাকে প্রেসক্লাবের সভাপতি এলাকার বড় ভাই কিংবা নিজ জেলার পরিচয় দিয়ে সুযোগের কথা আসবে?
প্রেসক্লাব কিংবা ডিআরইউর বর্তমান কমিটির কাছে এক তরুণ সাংবাদিকের প্রশ্ন- সদস্যের বাইরে আমরা যারা সাংবাদিকতা করছি আমরা কেন আপনাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে পেশাগত কাজ করতে পারবো না? বলা হয়ে থাকে এগুলো সাংবাদিকদের পেশাগত কাজের জন্য। প্রেসক্লাব-ডিআরইউ কি শুধু সদস্যদের বিনোদনের জন্য? নাকি সাংবাদিকদের পেশাগত কাজের জন্য? [সূত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম ]
চার.
আর গোলাম আজম খান লিখেছেন, কক্সবাজারের জাতীয় ও স্থানীয় সাংবাদিকদের ঐক্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন কক্সবাজার প্রেসক্লাবে পাশাপাশি বসেন ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের এক অংশের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও রহুল আমিন গাজী। তাদের সামনে বসেন জেলায় কর্মরত সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশের সব সাংবাদিক। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া হঠাৎ ইকবাল সোবহান চৌধুরী দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, “আজ থেকে এ মুহূর্ত থেকে আমি সরকারপন্থি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নই। একই ভাবে রুহুল আমিন গাজী বিরোধী দল তথা বিএনপি-জামায়াতপন্থি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নন। আজ থেকে আমাদের পরিচয় শুধু সাংবাদিক আর সাংবাদিক নেতা। বাংলাদেশে আর দু’টি ইউনিয়ন নয় একটি সাংবাদিক ইউনিয়নের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ চলবে। আমরা দেশবাসীকে জানিয়ে দিলাম সাংবাদিকরা এক হয়েছে।” তিনি বলেন, “রাজনৈতিক গোষ্ঠী আর পত্রিকার মালিকরা সাংবাদিকদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে তাদের সুবিধার জন্য আর আমাদের অধিকার খর্ব ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার জন্য।” “দীর্ঘ ২০ বছর পর কক্সবাজার থেকে শুরু হয়েছে সাংবাদিকদের ঐক্যের সুর। তাই কক্সবাজারের সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইতিহাসের অংশীদার হয়ে থাকবেন।”
“১৯৯২ সালে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীরা সাংবাদিকদের ঐক্যের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে। আর দুষ্ট রাজনৈতিক চক্র দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ফায়দা আদায় করে। সেই সুযোগকে পুঁজি করে মিডিয়ার মালিকরা। ফলে সাংবাদিকরা খুন, নির্যাতনের শিকার হন। ন্যায্য পাওনা ও অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়।” “এবার সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। তাতে দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতা হবে আর সাংবাদিকদের অধিকার সুরক্ষিত হবে।” এসময় মুহূর্মুহূ করতালিতে উচ্ছ্বসিত হন সাংবাদিকরা। ঠিক সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যান রুহুল আমিন গাজী। তিনি বলেন, “ইকবাল সোবহান চৌধুরী যা বলেছেন তার সঙ্গে আমি একমত। আমরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ঐক্যের আহবান জানাতে ঘর থেকে বের হয়েছি। ঐক্য চাইবেন না রাজনৈতিক নেতা আর মিডিয়ার মালিকরা। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।” [ সূত্র : বার্তা ২৪ডটনেট ]
পাঁচ.
এসব লেখার প্রতিক্রিয়ায় প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী লিখেছেন, প্রিয় আদিত্য আরাফাত, আপনি অনেক ভালো কাজ করছেন। আপনাদের অনেক অনেক চমৎকার তরুণের কাজ দেখে মুগ্ধ হই। গর্ব হয়। প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়া না হওয়ার সঙ্গে সাংবাদিক হওয়া বা না হওয়ার সম্পর্ক নেই। উনাদের তাদের মতো থাকতে দিন। পথেঘাটে দেখা হলে সেলাম দিয়ে বলবেন, আপনারা তাদের ডালপুরিতে ভাগ বসাবেন না। এ নিয়ে উনাদের এত উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই। আর যারা আজ প্রেসক্লাবের কর্মচারীদের দিয়ে তরুণ সাংবাদিকদের কুকুরের মতো দাবড়ায়, দূর্ব্যবহার করায়, তাদের এইদিনই কিন্তু দিন না। আরও দিন আছে। আরেকটা কথা, উনারা মরে গেলে কিন্তু জানাজায় যাবেন। সেখানে মুর্দার সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি কথাটাই বলবেন। দুর্ব্যবহার বা ভালো ব্যবহার কোনটাই লুকোবেন না। রিপোর্টেও লিখবেন তাদের আমলনামা। আর পারলে রিপোর্টার্স ইউনিটির সদস্য হোন। এটি আমাদের সংগঠন। অন্তত এখানে এখনো সদস্য হতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সাজা লাগেনা। মন না চাইলে তাও করার দরকার নেই।
প্রেসক্লাবের সামনে যেখানে ল্যাপটপ চার্জ করার জায়গা পেয়েছেন সেখানেই করুন। তারপরও সমুন্নত রাখুন আত্মমর্যাদা। মনে রাখবেন, একজন রিপোর্টারের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার প্রতি আমার সম্পূর্ণ সমর্থন থাকবে আদিত্য। আপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সব সংগ্রামী রিপোর্টার বন্ধুদের শুভেচ্ছা।
ছয়.
এখন বাংলাদেশে মিডিয়ার স্বর্নযুগ বলা যায়। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায়। দারুণ সম্ভাবনাময়ী একটি ক্ষেত্র (কর্মসংস্থান) হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এসব গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা স্মার্ট জীবন যাপন করছে। কিন্তু প্রশ্ন এধরনের সাংবাদিক সংগঠন কতটা প্রয়োজন বা জরুরী। হয়তো অনেকেই বলবেন, ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন বাড়ানো, সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে সংগঠনই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এর আড়ালে সাংবাদিক সংগঠনগুলো গণমাধ্যম কর্মীদের মাঝে বিভাজনও তৈরি করছে। এখন দেখা যায়, কোন মিডিয়ায় চাকরি নিতে গেলে কারো রেফারেন্স ছাড়া চাকরি হয়না কিংবা সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের সাথে লবিং থাকলে সহজেই চাকরি জুটে যায়। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি কাজ। শুধু তাই নয়, এখন সংগঠনগুলো রাজনৈতিক হওয়ায় সাংবাদিকদের মাঝে বিভাজন তৈরি হয়েছে। তাই ভেবে দেখার সময় এসেছে এসব সাংবাদিক সংগঠন কতটা জরুরী, তা নতুন প্রজন্মের গণমাধ্যম কর্মীরা উপলব্দি করছে। চলবে..
আগামী পর্বে পড়ুন- বাংলাদেশে মিডিয়ার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও গবেষক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন